আইএমএফের মিশন শুরু ৩ ডিসেম্বর
গুরুত্ব পাবে বিদ্যুৎ ও সারের বকেয়া পরিশোধ
নিজস্ব প্রতিবেদক: সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট মোকাবেলায় ২০২২ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ঋণ কর্মসূচির আওতায় তিন কিস্তিতে ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছে বহুজাতিক দাতা সংস্থাটি। ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে অবশ্য বিভিন্ন ধরনের সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আগামী ৩ ডিসেম্বর আইএমএফের মিশন শুরু হচ্ছে। এবারের মিশনে বিদ্যুৎ ও সারে সরকারের বকেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আইএমএফের গবেষণা শাখার উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জ্জিওর নেতৃত্বে ৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিশনটি বাংলাদেশে অবস্থান করবে। এ সময় তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। এর আগে গত ২৪-৩০ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করে গেছে। আগামী ডিসেম্বরে যে মিশন আসবে সেটির প্রস্তুতিমূলক হিসেবেই গত সেপ্টেম্বরের মিশনটি বাংলাদেশে এসেছিল। এছাড়া গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে আইএমএফের কাছে নিয়মিত ঋণ কর্মসূচির বাইরে আরো ৩ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চায়। বিষয়টি মূল্যায়ন করাও ছিল ওই মিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অনুসারে, কোয়ান্টিটেটিভ পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়া (কিউপিসি) বা পরিমাণগত সক্ষমতার মানদণ্ড, ইন্ডিকেটিভ টার্গেটস (আইটি) বা নির্দেশক লক্ষ্যমাত্রা এবং স্ট্রাকচারাল বেঞ্চমার্ক (এসবি) বা কাঠামোগত মাপকাঠি পূরণের শর্ত রয়েছে। সংস্থাটির আসন্ন মিশন গত জুন পর্যন্ত যেসব শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সেগুলো মূল্যায়ন করে দেখবে। পাশাপাশি তারা গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেসব শর্ত বেঁধে দেয়া ছিল সেগুলো অর্জিত হয়েছে কিনা সেটিও মূল্যায়ন করবে।
এ বছরের জুন শেষে বাংলাদেশের জন্য তিনটি পরিমাণগত সক্ষমতার মানদণ্ড বেঁধে দেয়া ছিল। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ, প্রাইমারি ব্যালান্স (রাজস্ব আয় ও সরকারের ব্যয়ের ব্যবধান) ঋণাত্মক ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখা এবং বৈদেশিক বকেয়ার পরিমাণ শূন্য রাখা। গত জুন শেষে বাংলাদেশের জন্য চারটি নির্দেশক লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল আইএমএফ। এর মধ্যে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা পর্যন্ত রিজার্ভ মানি সংরক্ষণ, ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণ, সামাজিক খাতে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয় এবং ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা মূলধনি বিনিয়োগের শর্ত রয়েছে। এছাড়া এ বছরের জুনের মধ্যে রাজস্ব আহরণ সংহতকরণ, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতির কাঠামো ও জলবায়ুসংক্রান্ত পাঁচটি কাঠামোগত মাপকাঠি পূরণের শর্তও রয়েছে।
আইএমএফের যেসব শর্ত রয়েছে এর মধ্যে পরিমাণগত সক্ষমতার মানদণ্ড ও নির্দেশক লক্ষ্যমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ। ঋণের কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে এ দুই ধরনের শর্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। চলতি বছরের জুন শেষে আইএমএফের ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ রাজস্ব কম আয় হয়েছে।
আইএমএফ মিশন সামনে রেখে বুধবার সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকও হয়েছে। সেখানে আইএমএফের বেঁধে দেয়া বিভিন্ন শর্ত ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রগতির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ এবার আইএমএফের প্রায় সব শর্তই পূরণ করতে পেরেছে। পরিমাণগত সক্ষমতার মানদণ্ড ও নির্দেশক লক্ষ্যমাত্রাসংক্রান্ত শর্তগুলো হালনাগাদ পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। এবারের মিশনে বিদ্যুৎ ও সার বাবদ সরকারের বকেয়া অর্থ পরিশোধের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। এসব বকেয়া পরিশোধের জন্য আইএমএফ গত মিশনের সময় থেকেই চাপ দিয়ে আসছে। এবার তারা সেটির ক্ষেত্রে আরো বেশি জোর দেবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সার ও বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধের জন্য ৪০ হাজার কোটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ দুই খাতে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা এ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষ বন্ড এবং ৭ হাজার কোটি টাকা নগদ পরিশোধ করা হয়েছে। তবে এখনো বড় অংকের বকেয়া রয়ে গেছে। আইএমএফ মিশনের আগে মোট বকেয়ার পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে।
গত জুনে বাংলাদেশের জন্য ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনে আইএমএফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি পরিশোধের জন্য বন্ড ইস্যু না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। সে সময় নতুন করে বকেয়া পুঞ্জীভূত হওয়া এড়ানোর পাশাপাশি জমে থাকা বকেয়া পাঁচ বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বাজেট থেকে পরিশোধের পরিকল্পনা করা হবে বলে আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর যে চাপ যাচ্ছে এবং এর কারণে বিভিন্ন ধরনের দেনা পরিশোধ আটকে যাচ্ছে, আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে, সেই সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রারও যথেষ্ট অবমূল্যায়ন হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের বাজেট সহায়তা প্রয়োজন সেটি আগেই অনুমেয়। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু আইএমএফ নয়, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছেও বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তৃতীয় কিস্তির সময় দেখা গেছে আমরা কিছু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সে সময় টাকা পেয়েছে। এবারো হয়তো দেখা যাবে যে কিছু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। তবে এখানে দুটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, চতুর্থ কিস্তির জন্য শর্ত পূরণের চাপ তো রয়েছেই, তার ওপর নতুন করে যে অর্থ চাওয়া হয়েছে সেজন্য আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির যে ভিত্তি রয়েছে সেটি যদি আইএমএফের কাছে যথেষ্ট মনে না হয় তাহলে ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর হবে। কিন্তু ইতিবাচক দিক হচ্ছে দেশে সম্প্রতি যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে সেটিকে আইএমএফও স্বাগত জানিয়েছে। নতুন ঋণের ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে সামষ্টিক অর্থনীতিসংক্রান্ত ভিত্তিরেখা ও শর্ত নির্ধারণ করে দেয়ার পাশাপাশি যেসব কাঠামোগত বিষয় আমাদের অর্থনীতি ও আর্থিক ভিত্তিকে প্রভাবিত করছে সেগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা এবং তাদের শর্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। তাহলে সেটি আমাদের জন্য ভালো হবে।’
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//