Summit Group Aziz Khan cancelled BD Citizenship

বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন সামিটের আজিজ খান

ডেস্ক রিপোর্ট: সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। দীর্ঘদিন ধরেই স্থায়ী নিবাসী (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করে আসছেন তিনি। তবে তার নাগরিকত্ব ছিল বাংলাদেশের। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশটির আইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আজিজ খানকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে।

আইন ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পেতে চাইলে তাকে আগে বর্তমান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে এর তথ্যপ্রমাণ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। এরপরই তিনি দেশটির নাগরিক হওয়ার সুযোগ পান। আজিজ খানের ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটেছে।

এ বিষয়ে হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের আইনে যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে আগে তাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হস্তান্তর করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনুমোদন নিতে হবে যে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নেবেন এবং তিনি আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি এ ধরনের অনুমোদন এরই মধ্যে নিয়েছেন এবং সেটি সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার কারণেই দেশটির নাগরিকত্ব পেয়েছেন বলে ধরে নেয়া যায়।’

সাত বছর ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের করা এ তালিকায় তিনি প্রথম জায়গা করে নেন ২০১৮ সালে। ২০২২ সাল থেকে তিনি ফোর্বসের বৈশ্বিক বিলিয়নেয়ার তালিকায়ও রয়েছেন। এতদিন পর্যন্ত এ তালিকায় তার নাম এসেছে একমাত্র বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে। পাশাপাশি তাকে উল্লেখ করা হয়েছে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী নিবাসী হিসেবেও।

তবে সম্প্রতি ফোর্বস প্রকাশিত সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আজিজ খানকে দেশটির নাগরিক হিসেবেই পরিচয় দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আজিজ খান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করায় ফোর্বসের হালনাগাদ তালিকায় তার এ-সংক্রান্ত তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে।

গত বছর সিএনএ লাক্সারিতে মুহাম্মদ আজিজ খানের ব্যক্তিগত চিত্র সংগ্রহশালা ও শিল্পপ্রেম নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে ব্যবসায়িক কারণে তার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ ও দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাসের বিষয়টি উঠে আসে। এতে বলা হয়, আজিজ খান সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা ১৯৮৮ সাল থেকে। ২০১৬ সালে তিনি দেশটিতে তার কোম্পানি সামিটের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করেন।

এ বছরের সেপ্টেম্বরে ফোর্বস সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর ২০২৪ সালের বার্ষিক তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ধনীদের সম্পদ ও অন্যান্য তথ্যও হালনাগাদ করা হয়ে থাকে। ফোর্বসের হিসাবে গতকাল পর্যন্ত আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ডলার। তাকে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়া হলেও সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন আজিজ খান, তার স্ত্রী ও সন্তানরা দীর্ঘদিন ধরেই সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে তারা বাংলাদেশে এলেও বছরের বেশির ভাগ সময় সিঙ্গাপুরেই থাকেন। তার ভ্রাতুষ্পুত্রও দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন।

এ বিষয়ে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার কাছ থেকে সাড়া মেলেনি।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সামিটের আজিজ খানের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নথি যাচাই না করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

আজিজ খান প্রথমবারের মতো ফোর্বসের সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন ২০১৮ সালে। সে বছর তিনি ছিলেন ৩৪ নম্বরে এবং তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে তার সম্পদ কমে ৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তবে ২০২০ সালে সম্পদ বেড়ে ৯৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়। ২০২১ সালে আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ডলার। পরের বছরই তা ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয় এবং তিনি দেশটির ৪২তম শীর্ষ ধনীর তালিকায় ছিলেন। ২০২৩ সালে মুহাম্মদ আজিজ খানের মোট সম্পদ দাঁড়ায় ১১২ কোটি ডলারে এবং শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ফোর্বসের তালিকায় সিঙ্গাপুরের ধনীদের মধ্যে তার অবস্থান ছিল ৪৩তম এবং মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলার। ২০২২ সাল থেকে আজিজ খানের সম্পদ শতকোটি ডলার স্পর্শ করার পর থেকেই তিনি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকার পাশাপাশি ফোর্বসের বৈশ্বিক ধনীদের তালিকায় জায়গা করে নেন। ফোর্বসের হিসাবে বর্তমানে তিনি বিশ্বের বিলিয়নেয়ার তালিকায় ২ হাজার ৬৭৪তম অবস্থানে রয়েছেন।

১৯৫৫ সালে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ আজিজ খানের উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয় মাত্র ১৮ বছর বয়সে। বাবার কাছ থেকে নেয়া ৩০ হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকায় জুতা তৈরির মাধ্যমে তার ব্যবসায় হাতেখড়ি। এসব জুতার একটি অংশ বাটা কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন তিনি। জুতা তৈরির পাশাপাশি পিভিসি (পলি ভিনাইল ক্লোরাইড) আমদানি শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি চিটাগুড়ের রফতানি ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেন। দেশের হয়ে তিনিই প্রথম চিটাগুড় রফতানি করেন। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

প্রায় অর্ধশতকের ব্যবসায়ী জীবনে ট্রেডিং থেকে শুরু করে জ্বালানি, বন্দর, ফাইবার অপটিকসহ নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়েছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। তবে তার সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বিদ্যুতের ব্যবসা। এ ব্যবসার হাত ধরেই গত এক দশকে সম্পদে বড় উল্লম্ফনের দেখা পেয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান।

ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, আজিজ খানের বয়স এখন ৬৯ বছর। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিক ও অবকাঠামো খাতের ব্যবসা আছে সামিট গ্রুপের। সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অধীনে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ ব্যবসার পাশাপাশি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) এবং এলএনজি টার্মিনালসহ সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের মাধ্যমে বন্দর ব্যবসা, সামিট কমিউনিকেশনসের মাধ্যমে ফাইবার অপটিকসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসা এবং আবাসন খাতের ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে সামিট গ্রুপের।

শীর্ষ এ ব্যবসায়ী তার স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিএনএ ডিজিটালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক বন্ধুর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। বন্ধু তখন বাংলাদেশে পাইকারিভাবে প্লাস্টিক আমদানি করছিলেন। আজিজ খান নিজেও এক পর্যায়ে সার রফতানি শুরু করেন। ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে আজিজ খানকে বিভিন্ন বন্দরে অপেক্ষা করতে হতো। তার প্রধান কারণ ছিল বিদ্যুতের সংকট। বিষয়টি তাকে কয়েক দফা ভুগিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের আবেদন জানান তিনি। এরপর ১৯৯৭ সালে আজিজ খানের হাতে প্রতিষ্ঠা পায় সামিট পাওয়ার।

বর্তমানে আজিজ খানের সম্পদের বড় একটি অংশে অবদান রাখছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেড। কোম্পানিটির গত ২০ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০০৮ হিসাব বছর পর্যন্ত কোম্পানিটির সম্পদ ও নিট মুনাফায় যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সে তুলনায় এর পরের হিসাব বছরগুলোয় প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরো বেশি। ২০০৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির সম্পদ ছিল ১০০ কোটি ৮২ লাখ এবং নিট মুনাফা হয় ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ১১ হাজার ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং নিট মুনাফা ১৭১ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে গত আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যবসায়িকভাবে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে সামিট গ্রপ। এরই মধ্যে বেশকিছু তদন্ত চলছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। সামিটের দ্বিতীয় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ারের মালিকানায় থাকা ১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে পাঁচটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়িকভাবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে সামিট গ্রুপ।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)