নরসিংদীতে বিলুপ্তির পথে দেশি জাতের মাছ

মো: শাহাদাৎ হোসেন রাজু, নরসিংদী: কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙ্গালি। মাছের প্রতি বাঙালির ঝোঁক চিরকালের। কিন্তু দিনে দিনে কমছে নদী-খাল-জলাশয়। যা আছে তার বেশিরভাগেই হয় বাণিজ্যিকভিত্তিতে মাছ চাষ। উন্মুক্ত জলাশয়ে বিনা বাধায় মাছ শিকারের সুযোগ আর তেমন মেলে না। নরসিংদীর খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় দেশি জাতের পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ছোট মাছ। এ জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসভূমি এতটাই দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, টিকে থাকার উপযোগী জায়গা সংকীর্ণ হতে হতে কোথাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া এবং ছোট মাছ সংরক্ষণে সরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ না থাকায় ছোট জাতের মাছ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। আবার পুকুরে বড়মাছ চাষের আগে ছোট মাছ বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ মাছের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট প্রজাতির বিভিন্ন মাছ।

বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা এসব মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: চ্যাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, শোল, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, ছোটচিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইম, তারা বাইম, শালবাইম, চিকরা বাইম, কাকিয়া, কুচিয়া, তারা, খোকসা, খরকুটি, দেশি জাতের পটকা, কাশ খররা, টাটকিনি, গোলসা, রয়না, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। একসময় দেশি জাতের এসব ছোট মাছের উৎস ছিল হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও বিভিন্ন নদী-নালা। জেলার রায়পুরা, মনোহরদী, শিবপুর, পলাশ, বেলাব ও সদর উপজেলরা বিভিন্ন জলাশয় ছাড়াও মেঘনা, আড়িঁয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র,পাহাড়িয়া ও শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এক দশক আগেও প্রতিদিন জেলার ছোট-বড় বিভিন্ন বাজারে দেশি জাতের পর্যাপ্ত ছোট মাছ আসত। এখন বর্ষাকাল জেলার নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে ভরে আছে, এসময় প্রচুর দেশি জাতে মাছগুলো এসকল জলাশয় থেকে ধরা পড়লেও এখন আর তা মিলছেনা। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন এ জাতীয় মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শিবপুর উপজেলার দুলালপুর এলাকার আনোয়ার হোসেন স্বপন জানান, ‘কোনো রকম চাষ ছাড়াই এ এলাকার বিলে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশি মাছে। বিলের অধিকাংশ এলাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা এবং বাকি অংশ এখন ফসল চাষের আওতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার ও পানি স্বল্পতার কারণে এখন আর মাছই পাওয়া যাচ্ছে না।’
নরসিংদী মৎস্য ব্যবসায়ী হারাধন দাস জানান, ‘ছোট জাতের মাছের সরবরাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। দুটি কারণে ছোট মাছের চালান কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়া হচ্ছে প্রধান কারণ। এর সঙ্গে বেড়ে গেছে স্থানীয় চাহিদা।’

জেলার মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে বহু মাছ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে হাওর-বাঁওড় ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, প্লাবনভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার। তাই দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় মৎস্য বিভাগের নজর দেয়া প্রয়োজন।’

(এসএইচআর/এসএএম/ ২১ জুলাই ২০১৭)


Comment As:

Comment (0)