বারী সিদ্দিকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক: ‘শুয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি’ যে গানের পাখি এই গান দরাজ কণ্ঠে ধারণ করে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার প্রত্যেকটি শ্রোতার অন্তরে, সেই বারী সিদ্দিকীকে ছাড়া কেটে গেছে একটি বছর। ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন এই বরেণ্য শিল্পী।

আজ বারী সিদ্দিকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটিকে ঘিরে সংগীত অঙ্গনে কোনো আয়োজনের কথা জানা যায়নি। তার স্মরণে কোনো দোয়া-মাহফিলের খবরও পাওয়া যায়নি। তবে বারী সিদ্দিকীর পরিবার থেকে তার জন্য দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে বলে শোনা গেছে।

বারী সিদ্দিকীর বাঁশির সুরে মন হারাননি, এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দুই দশক তিনি বাঁশি বাজিয়ে জয় করেছেন বিশ্ব। বারী সিদ্দিকীর বাঁশির সুরে কেঁদেছেন অগণিত মানুষ। প্রাকৃতিক এই বাদ্যযন্ত্র দিয়ে তিনি যে বিষাদময় হাহাকার সৃষ্টি করতেন, সেটা মানুষের কান হয়ে পৌঁছে যেতো হৃদপিণ্ডের অতলে। আর সেখানে তৈরি হয়ে যেতো অপার সুন্দর এক অনুভবের।

ছোট বেলায় মায়ের অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় বাঁশিতে হাতেখড়ি হয় বারী সিদ্দিকীর। কিন্তু সেই সময় নেত্রকোণায় বাঁশি শেখার কোনও পদ্ধতিগত ব্যবস্থা ছিলো না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বাদ্যযন্ত্র শেখার সুযোগ হয় যখন বারী সিদ্দিকী হাইস্কুলে পড়তেন। নেত্রকোণা শিল্পকলা একাডেমিতে ওস্তাদ শ্রী গোপাল দত্তের কাছ থেকে বাঁশি শিখতে শুরু করেন তিনি। এরপর বারী সিদ্দিকী ওস্তাদ তাগাল ব্রাদার্স, পণ্ডিত দেবেন্দ্র মুৎসুদ্দী, ওস্তাদ আয়েফ আলী খান মিনকারীর মতো গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ থেক একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বারী সিদ্দিকী অংশ নেন। সেই সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই বাঁশি বাজান বারী। তাও একটানা ৪৫ মিনিট। তার বাঁশিতে মুগ্ধ হয় বিশ্ব শ্রোতারা। বারী সিদ্দিকী পান উপমহাদেশজোড়া খ্যাতি। এরপর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন মঞ্চে বংশী বাদক হিসবে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছান বারী।

ছোট বেলা থেকে গানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও গায়ক হিসেবে বারী সিদ্দিকী পরিচিতি পান নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। তার ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে গান করেই দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পান বারী। চলচ্চিত্রের গান দিয়ে জনপ্রিয়তার পাওয়ার পর বারী সিদ্দিকীর দুটি একক অ্যালবাম প্রকাশ হয়। ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং অপরাধী হইলেও আমি তোর’ শীর্ষক অ্যালবাম দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে লোকজ সুরের গানগুলো সহজেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। তারপর থেকে লোক ও আধ্যাত্মিক গানের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন বারী সিদ্দিকী। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় সম্মানের সঙ্গে তিনি অংশ নিতে থাকেন। একাধিক প্রজন্মের শিল্পী তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লোকজ ঘরানার গানে আসেন। বারী সিদ্দিকীর প্রকাশিত অন্যান্য অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সরলা’, ‘ভাবের দেশে চলো’, ‘সাদা রুমাল’, ‘মাটির মালিকানা’, ‘মাটির দেহ’, ‘মনে বড় জ্বালা’, ‘প্রেমের উৎসব’, ‘ভালোবাসার বসত বাড়ি’, ‘নিলুয়া বাতাস’ ও ‘দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি’।

মূলত বিরহ-বিচ্ছেদ আর মরমী সুর উঠে আসে বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে। তার গাওয়া ‘শুয়া চান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘রজনী’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ’, ‘পুবালি বাতাসে’, মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ও ‘আমার মন্দ স্বভাব জেনেও’ গানগুলো বাংলা সংগীতকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বারী সিদ্দিকীর ‘প্রবাস প্রজন্ম জাপান সম্মাননা’ উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। অথচ খ্যাতিমান এই সংগীত সাধক দেশের বড় সব সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তেমন কোনও সম্মাননায় তাকে ভূষিত করা হয়নি। তবে সম্মাননা কিংবা পুরস্কারে নয়, বারী সিদ্দিকী অমর হয়ে থাকবেন তার সৃষ্ট গানে আর বাঁশির সুরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে বারী সিদ্দিকীর সুর। চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি সংগীত ভুবনে।

(কেএইচকে / ২৪ নভেম্বর ২০১৮)


Comment As:

Comment (0)