শেয়ারবাজারে দর ওঠা-নামা করাই স্বাভাবিক, জেনে বুঝে বিনিয়োগ করুন: শাকিল রিজভী

শামীম-আল-মাসুদ, বিনিয়োগবার্তা, ঢাকা: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি, বর্তমান পরিচালক ও শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার পথ চলায় বাজারের নানা উত্থান-পতনের কিংবদন্তী স্বাক্ষি হয়ে রয়েছেন তিনি। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা) পর তিনিই প্রথম পরিচালক যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ বিদেশের পুঁজিবাজার সম্পর্কে তার রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি বিনিয়োগবার্তার হেড অব নিউজ শামীম-আল-মাসুদ এর সঙ্গে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা করেছেন। বিনিয়োগবার্তার পাঠকদের জন্য এর চুম্বক অংশ উপস্থাপন করা হলো।

বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থাকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

শাকিল রিজভী:  বর্তমানে দেশে অর্থনীতির সব সূচক ভালো। তারপরেও আস্থার সংকটে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। গত কয়েক মাসে দেশে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় পুঁজিবাজারও কিছুটা গতি ফিরে পেয়েছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে আগামী দিনে বাজার ভালো হবে।
তবে এ বাজার কোনদিন পরিপূর্ণ স্থিতিশীল হবে না বলে আমার মনে হয়। কারণ হিসাবে তিনি বলেন,  এখানে কেউ তার পন্য নিয়ে লাভ করবে। আবার কেউ লোকসান করবে। দর ওঠানামা করবে এটাই শেয়ারবাজারের নিয়ম। তাই সকল পক্ষের জন্য কখনোই বাজার স্থিতিশীল হবে না।

বিনিয়োগবার্তা: বাজারের নাজুক অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বিধিমালাকে দায়ী করছেন অনেকে। বাস্তবে অবস্থাটা কি?

শাকিল রিজভী: এটি সত্য যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিমালার কিছু প্রভাব বাজারে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি গঠন করার মাধ্যমে তাদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ওই সময়ের আইনে যা ছিল সেটি দেখে তারা বাজারে বিনিয়োগ করেছে। বর্তমান আইনে এটি বাড়তি বিনিয়োগ। আইন পালন করতে গিয়ে তাদের বাড়তি বিনিয়োগ তুলে নিতে হচ্ছে। এই চাপ বাজারের জন্য কষ্টকর। তাই আমি মনে করি পুঁজিবাজারসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে সময় দেওয়া উচিত।

বিনিয়োগবার্তা: বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

শাকিল রিজভী: বড় কোম্পানিগুলোকে আনতে তিনটি বিষয় জরুরি। প্রথমত ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ও মেয়াদ বেঁধে দেওয়া;  দ্বিতীয়ত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ)বাস্তবায়ন এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির কর হারের ব্যবধান আরো বাড়ানো।

ঋণ ও মূলধনের অনুপাত বেঁধে দেওয়া হলে অল্প মূলধনের কোম্পানি বড় ঋণ নিতে পারবে না। আবার মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হলে শুধু চলতি মূলধনের জন্য ঋণ পাওয়া যাবে। তখন চাইলে কোনো কোম্পানি ব্যাংক থেকে বড় ঋণ নিতে পারবে না। তাকে পুঁজিবাজারে আসতেই হবে।

অন্যদিকে এফআরএ বাস্তাবায়ন হলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বাড়বে। এতে নীরিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজশ করে কোম্পানির আয় কমিয়ে দেখানো বা লোকসান দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে আসবে। এ সুযোগের জন্য অনেকে পুঁজিবাজারে আসতে চায় না। কারণ পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিনিয়োগকারী এবং মিডিয়ার কাছে জবাবদিহীতা থাকে।

বর্তমানে তালিকাভুক্ত এবং তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে করের ব্যবধান থাকলেও তা তেমন বেশী নয়। এই ব্যবধান বাড়লে কোম্পানিগুলো রেয়াতের সুবিধা নিতে পুঁজিবাজারে আসবে।

বিনিয়োগবার্তা: আইপিওর গুণগত মান ও প্রিমিয়াম নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

শাকিল রিজভী: আইপিও নিয়ে আমাদেরও বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়। অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আর দূর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। আসলে দূর্বল কোম্পানির আইপিও ঠেকাতে বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত ও সচেতন হতে হবে। তারা সাড়া না দিলে এমনিতেই এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
তবে আমরা আশা করি,  নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ বিষয়ে আরও যত্নবান হবে। আর আগে আইপিওর বিষয়টি এককভাবে বিএসইসি দেখলেও এখন এই বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এরফলে নতুন আইপিও আনতে যাচাই বাচাইর ক্ষেত্রটি আরো প্রসারিত হবে বলে আমি মনে করি।

বিনিয়োগবার্তা: স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা আলাদা হয়েছে (ডি-মিউচুয়ালাইজড) অনেক দিন হল। এর মধ্যে বাজার কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে আপনি মনে করেন?

শাকিল রিজভী: স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা আলাদা হওয়ার পর বাজারে বেশ কিছূ গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম গুণগত পরিবর্তন হলো যিনি স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান তিনি শেয়ারধারীও না,  শেয়ার ব্যবসায়ীও না। একেবারে স্বতন্ত্র। তার মানে তার বিচারটা হবে ফেয়ার। পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ স্বতন্ত্র এবং আরেকটি পরিবর্তন হলো পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা শুধুই নীতিনির্ধারক। ডিএসই পরিচালনা করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ম্যানেজমেন্ট টিম। আর ডি-মিউচুয়ালাইজেশন প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। অল্প সময়ে এর মূল্যায়ন করা যাবে না। পরিপূর্ণ ডি-মিউচুয়ালাইজড বাজার হতে আরো কিছু সময়তো লাগবেই।

বিনিয়োগবার্তা: সাম্প্রতিককালে বিশ্ব পুঁজিবাজারেই অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে;  এর কারন কি?

শাকিল রিজভী:  সাম্প্রতিককালে বিশ্ববাজারে তেল ও স্বর্ণের দাম কমে যাওয়া, আরএমবি রি-ভ্যালুয়েশন বা পূণনির্ধারন শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারন। তবে সেসব দেশে বাজারে মন্দা নেমে আসলে সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রণোধনা দেওয়া হয়,  তার নূন্যতম অংশও আমাদের এখানে করা হয় না। আর আমাদের এখানে তেল বা স্বর্ণের কোম্পানিও নাই। তারপরও আমরা বাজারকে শক্তিশালি করতে পারছি না।

বিনিয়েগবার্তা: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

শাকিল রিজভী: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে একটাই কথা, উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন। কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে তার ম্যানেজম্যান্ট, নেট এসেট ভ্যালু (এিএভি), প্রাইস আর্নিং রেশিও (পিই), কোম্পানির গুডউইল বা সুনাম এগুলো দেখে বিনিয়োগ করবেন। পুঁজিবাজারে দর উঠানামা করবে এটাই স্বাভাবিক। এনিয়ে হতাশার কিছু নাই। তবে বিনিয়োগ করবেন দীর্ঘমেয়াদের জন্য। সর্বোপরি শেয়ারবাজার সম্পর্কে জেনে বুঝে তারপরে বিনিয়োগে আসবেন।

(শামীম/ ০৩ অক্টোবর ২০১৫)


Comment As:

Comment (0)