ঈদকে সামনে রেখে সরগরম বাবুরহাট; পুরোদমে জমে উঠেছে বেচাকেনা

মো: শাহাদাৎ হোসেন রাজু, নরসিংদী: দেশের অন্যতম পাইকারি কাপড়ের হাট নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাটে পুরোদমে জমে উঠেছে ঈদের বেচাকেনা। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আমেজ আর বেচাকেনার ব্যস্ততায় বাবুরহাটের পরিবেশ সরগরম। ঈদ উপলক্ষে দোকানে দোকানে দেশীয় তৈরি নতুন নতুন কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। রমজানের শুরু থেকেই সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তের পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠছে প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার খ্যাত দেশীয় কাপড়ের এই বৃহত্তর বাজারটি। সপ্তাহে তিনদিন এখান থেকে পাঁচ শতাধিক ট্রাক বোঝাই কাপড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলাতে।

জানা গেছে, বাবুরহাটে প্রায় ৫ হাজারেরও অধিক ছোট-বড় পাইকারি দোকান রয়েছে। আর এসব দোকানে শাড়ি-লুঙ্গি থেকে শুরু করে থ্রি-পিস, থান কাপড়, পর্দা, সোফার কভার ও গামছাসহ এমন কোনো কাপড় নেই, যা বাবুরহাটে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া আমদানি করা বিদেশি কাপড়ও পাইকারি বিক্রি হয় এখানে। সাধারণত প্রতি হাটে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। আর ঈদের মৌসুমে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর দিকে এবং নরসিংদী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাশ ঘেঁষে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসংলগ্ন এলাকায় ১৯৩৪ সালে জমিদার হলধর সাহা প্রায় ১১ একর জমির উপর হাটটি গড়ে তোলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বাবুরহাট দেশব্যাপি খ্যাতি অর্জন করে। দেশের বৃহত্তম পাইকারী কাপড়ের বাজারটির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা সরাসরি এখানে এসে পাইকারি দামে কাপড় কিনে নিয়ে যায়।

সরেজমিনে বাবুরহাটে গিয়ে দেখা যায়, আসছে ঈদকে ঘিরে দেশের অন্যতম এই পাইকারি কাপড়ের বাজারটিতে বেড়েছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ব্যস্ততা। ব্যবসায়ী ছাড়াও পাইকারি দরে জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি কেনার জন্য আগেভাগেই আসছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা। যতই ঈদের দিন ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়।

ঈদ উপলক্ষে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, শার্ট পিস, প্যান্ট পিস, থান কাপড়, পাঞ্জাবির কাপড়, গামছা, বিছানার চাদরসহ প্রায় সব ধরনের কাপড়ের পসরা সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশের বেশির ভাগ শাড়ি, লুঙ্গি ও অন্যান্য বস্ত্র কারখানাগুলো নরসিংদী কেন্দ্রিক। এসব বস্ত্র কোম্পানির প্রধান শো-রুম রয়েছে বাবুরহাটে। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ও ন্যায্য দামে চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের কাপড় পাওয়ায় পাইকারি ক্রেতাদের আগ্রহের কমতি নেই বাবুরহাটকে ঘিরে। সপ্তাহের শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, ফেনী, বরিশাল, পিরোজপুর, জামালপুর, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত থাকছে বাবুরহাট। এর প্রতিটি অলিগলিতে হাটের দিনগুলোতে  সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত  চলে পাইকারি কাপড় বিক্রি। কেনা শেষ হলে শ্রমিকরা কাপড়ের গাঁইট বেঁধে তুলে দিচ্ছেন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রাখা ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনে। হাটের তিনদিনই এখান থেকে পাঁচ শতাধিক ট্রাক বোঝাই কাপড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলাতে।

বাবুরহাটে লুঙ্গি ও শাড়ির পাইকারি বিক্রেতা আমানত শাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে শাড়ি-থ্রি পিসসহ নতুন নতুন ডিজাইনের যাবতীয় কাপড় তোলা হয়েছে দোকানগুলোতে। গত ঈদের চেয়ে এবার বেচাকেনা অনেকটাই ভাল। খুচরা দোকানগুলোতে বেচাকেনা বাড়ায় পাইকারি বাজারে বেচাকেনা বেড়েছে।’

ডি আর পি টেক্সটাইলের স্বত্তাধিকারী সুশিল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ডি আর পি’র থ্রি-পিস গুলোতে আনা হয়েছে নতুনত্ব। দেশের অন্যান্য বাজারের তুলনায় দাম কম ও কাপড়ের মান ভালো হওয়ায় সারা দেশের পাইকারি ক্রেতারা ঈদের কাপড় কিনতে এই হাটে আসছে। রোজা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই পুরোদমে বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে। আমাদের কাপড়ের গোডাউন অনেকটাই খালি হয়ে গেছে।’

বাজারের বোখারী লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘বছরের দুটি ঈদেই মূলত বেশি বেচাকেনা হয় বাবুরহাটে। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে জাকাতের জন্য লুঙ্গি ও শাড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। বিগত কয়েক বছর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এবার বেচাকেনা ভালো হচ্ছে।’

নিউ মডেল লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী আলহাজ আবদুল বাতেন মিয়া বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বেচাকেনা ভালোই হচ্ছে। আমরা ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে নতুন নতুন ডিজাইনের লুঙ্গি বাজারে এনেছি।’

বাবুরহাটের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের বাজারে নরসিংদীর টেক্সটাইলে উৎপাদিত প্রিন্টের কাপড়ের চাহিদা বেশি। পাশাপাশি টাঙ্গাইল, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কাপড়ও ভালো বিক্রি হচ্ছে। তবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার লাভ কিছুটা কমে গেছে। কারণ হিসেবে ডাইংয়ের কেমিক্যালসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছেন তারা।

সেকেরচর বাবুরহাট বাজার বণিক সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুল বাকির বলেন, মূলত ঈদকে সামনে রেখে ৩ মাস ধরেই চলে বাবুরহাটের বেচাকেনা। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় এই ঈদে আশানুরূপ কাপড় বেচাকেনা হচ্ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও বাড়ছে।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিল্প এলাকা নরসিংদীর হৃদপিণ্ড হলো বাবুরহাট। পুরো জেলার ব্যবসায়ীরাই তাকিয়ে রয়েছে বাবুহাটের ঈদ বেচাকেনার দিকে। কারণ বেচাকেনা ভাল হলেই ভাল থাকবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।

(এসএইচআর/ এসএএম/ ০৫ জুন ২০১৭)


Comment As:

Comment (0)