মহানায়ক উত্তম কুমার: কর্ম ও জীবন

ডঃ মিহির কুমার রায়: ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মদিন। ১৯২৬ সালের এই দিনে তিনি কলকাতায় আহিরীটোলায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম সাতকরি চট্রোপাধ্যায় এবং মাতার নাম চপলা দেবী। তিন ভাইয়ের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং ছোট ভাই তরুন কুমার ছিলেন একজন শক্তিশালী অভিনেতা। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এটি একটি অতি পরিচিত জনপ্রিয় নাম যার প্রকৃত পরিচিতি অরুন কুমার চট্রোপাধ্যায় নামে। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙ্গালী চলচ্চিত্র অভিনেতা, চিত্র প্রযোজক ও সঙ্গীত পরিচালক। এই ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে মহানায়ক আখ্যা দেয়া হয়েছিল এবং কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ অঞ্চলের স্টেশনটির নাম করা হয়েছে মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন। শিক্ষা জীবনের শুরুতে কলকাতার চক্রবেড়িয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরবর্তিতে কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং গোয়েঙ্কা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ন হন। তার পর আর গ্র্যাজুয়েশন করা হয়নি এবং এক সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে (১৯৪৮-১৯৮০) প্রতিষ্ঠা পেতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কেবল মাত্র প্রয়োজনের তাগিদে উচ্চমাধ্যমিক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৪৪ সালে পোর্ট কমিশনার্স হিসাবে চাকুরী জীবন শুরু করেন এবং ১৯৫২ সালে চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন।

এরই মাঝে তিনি অভিনয় জগতের দিকে ঝুকে পড়েন, যার শুরুটা হয় মাত্র তের বছর বয়সে যাত্রা পালা দিয়ে জনতা অপেরার জীবন সঙ্গীনি বইতে বলরামের ভুমিকায়। তার প্রথমে ছবি মায়াডোর (১৯৪৭) হলেও শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায়নি। উত্তম কুমারের প্রথমবাংলা চলচ্চিত্র ছিল দৃষ্টিদান, যার পরিচালক ছিলেন নিতীশ বসু। তারপর তার অভিনীত বসুপরিবার ছবিটি মুক্তি পায়। এর পর সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে তিনি সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন, যার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল উত্তম – সুচিত্রা জুটির সুত্রপাত হয়। এক সময় কলকাতার চলচ্চিত্র পাড়ায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময়ে কোন ছবি হিট হবে তা ভাবাই যেত না। এক সময় সাধারন পাবলিক ভাবতে শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্রের মত বাস্তবেও হয়ত তারা সম্পর্ক ধারন করবে। উত্তম কুমারের বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অনেকগুলি ছবি ব্যবসায়িক ভাবে সফল লাভ করে, যার মধ্যে ছিল হারানো সুর, পথে হলো দেরি, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃঞা এবং সাগরিকা। উত্তম কুমার অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত মোট একশত পনেরটি, তার মধ্যে তিনি ৩১টিতে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেনের বিপরীতে এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন যথাক্রমে দোসর (১৯৬১), অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭), চিড়িয়াখা (১৯৬৭) প্রভৃতি।

সাধারন অভিনেতা থেকে অরিন্দমের নায়ক হওয়ার গল্প নিয়ে ছবিতে উত্তম অভিনয় করতে গিয়ে খুজে পেয়েছিলেন নিজেকে এবং তিনি নিজেকে সু -অভিনেতা হিসাবে প্রমান করেছিলেন এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিতে, যাতে তিনি তার পরিচিত ইমেজ থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিলেন। উত্তমের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, প্রেমিক সুলভ আচরনের বাহিরে যে থাকতে পারে অভিনয়ের নানা ধরন মূলত: সেটাই তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত হারানো সুর ছবিতে অভিনয় করে রাষ্ট্রপতির সার্র্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পেয়েছিলেন, যা ইংরেজি উপন্যাস অবলম্বনে নিমিত ও উত্তম কুমার প্রযোজিত। কমেডি চরিত্রে তিনি সমান পারদর্শি ছিলেন, যার প্রমান দেয়া নেয়া ছবিতে হৃদয় হরন চরিত্রে অভিনয় করে। এক গান পাগল ধনীর পুত্র অভিজিৎ চৌধুরীর বাবা কমল মিত্রের সাথে রাগারাগি করে বন্ধু তরুন কুমারের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাবা গান পছন্দ করেন না কিন্তু অভিজিৎ চৌধুরীর ইচ্ছা বড় শিল্পী হওয়ার। নায়িকা তনুজার মামা পাহাড়ী স্যানলের বাড়ীতে হৃদয় হরন ড্রাইভারের কাজ করতেন। সাবলিল অভিনয় দিয়ে ফোটিয়ে তোলা হয় হৃদয় হরন চরিত্রটি। ছবিটির একটি আকর্ষনীয় সংলাপ ছিল টাকাই জীবনের সব কিছু নয়। তা ছাড়াও একটি চমকপ্রদ গানও ছিল জীবনের খাতায় প্রতি পাতায় যদি করো হিসাবনিকাশ পূর্ণ হবে না কোন দিন। উত্তম কুমার বহুল বাংলা চলচ্চিত্রর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ছোটিসি মুলাক্যা (১৯৬৭), দেশ প্রেমী (১৯৮০), অমানুষ ও মেরাকরন মেরা ধরম অন্যতম। তিনি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত নায়ক ও চিড়িয়াখানায অভিনয় করেছিলেন, যার মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল শরদিন্দু চন্দোপাধ্যায়ের সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা উপন্যাস অবলম্বনে চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভুমিকায়। রোমান্টিক ছবির ফাকে ফাকে ভিন্ন স্বাদের ছবিও তিনি করেছিলেন, যার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নায়ক অন্যতম। চলচ্চিত্র ছাড়াও মঞ্চের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা, যার ফলে শত ব্যস্ততার মাঝেও ১৯৫৭ সালে শ্যামলী নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সঙ্গীতের প্রতিও ছিল তার অগাধ ভালবাসা এবং আগ্রহ। ছবির গান রেকডিং এর সময় শিল্পি যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্নাদে ও শ্যামল মিত্র প্রমুখদের পাশে বসে তার অনুভুতি উপলব্দি করার চেষ্টা করতেন, যার ফলে গানের সাথে পর্দায় ঠেটি মেলানো তার জন্য খুবি সহজ হতো। তিনি গানের সুর দিয়েছিলেন কাল তুমি আলেয়া ছবিতে, যা ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। উত্তম কুমার অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসাবে সফল ছিলেন। তার পরিচালিত তিনটি চলচ্চিত্র যেমন কলঙ্কিনী (১৯৮০), বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), শুরু একটি বছর (১৯৬৬) এবং প্রযোজিত তিনটি চলচ্চিত্রে যেমন গৃহদাহ (১৯৬৭), ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭) এবং হারানো সুর সকলের হৃদয় কেড়েছে।

এখন আসা যাক উত্তম কুমারের জীবনের অন্যান্য কাহিনী নিয়ে, যা কখনও পূর্ণিমার চাঁদের আলোকে উদ্ভাসিত ছিল না। ১৯৫০ সালের ১লা জুন মাত্র চব্বিশ বছর রয়েছে তিনি গৌরী গাঙুলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯৫১ সালে ৭ই সেপ্টেম্বর তার একমাত্র পুত্র গৌতমের জন্ম হয়। ১৯৫২ সালে তার অভিনীত ছবি বসু পরিবার মুক্তি পায় এবং এই বছরের শেষের দিকে ডিসেম্বরে তিনি পোর্ট কমিশনার্স এর চাকুরী ত্যাগ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি স্টার থিয়েটারে শ্যামলী নাটকে অভিনয় করেন এবং এ বৎসরই মুক্তি পায় সাড়ে চুয়াত্তর নামক ছবি। এ বৎসরেই সুচিত্রা সেনের সাথে জুটি বাধা যার ভিতর দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন নবজন্ম ছবিতে এবং ১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার তার প্রযোজিত ছবি হারানো সুর নায়িকা হবার দুইবার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা সেন বলেছিলেন তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব। উত্তম কুমারের সঙ্গে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে যে সকল নায়িকারা অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয় দেবী, অপর্না সেন, সাবিত্রী চট্র্যোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, বৈজয়ন্তি মালা, তনুজা, সন্ধা রায়, সুমিত্রা মুখার্জী প্রমুখ। এই সকল কিংবদন্তী নায়িকাদের নিয়ে উত্তম কুমারের সাথে একটি কার্টুন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ প্রত্রিকা প্রকাশিত ছিল, সেখানে গোলকৃত ছবিতে দেখানো হয়েছিল মহানায়ক উত্তম কুমার একটি বৃত্তের মাঝখানে এবং এর মাঝখানে গোলাকৃত আকারে নায়িকারা ঘুরছে যেখানে লেখা ছিল “যৌবনে যারা সুদুর গগনে জ্বলিত তারার মতো উত্তমের সাথে নায়িকা সাজিয়া হরিত সবার চিত্ত — বিগত যৌবনে আজিকে তারা মনি হারা সব ফনি-বিধির বিধান অজিও উত্তম নায়কের শিরমণ”। উত্তম কুমারের অভিনীত জীবন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এবং সেই সময়ে তার অভিনীত ছবির সংখ্যা একশত আঠারটি (১১৮)। তার প্রথম ছবি দৃষ্টিদান (১৯৪৮) এবং সর্বশেষ ছবি কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১)। উত্তম কুমারের অভিনীত হিন্দি ছবির নাম ছোটিসি মূলাকাৎ (১৯৬৭), দেশপ্রেমী (১৯৮২) ও মেরা করম মেরা ধরম (১৯৮৭)। উত্তম কুমারের সুরারোপিত চলচ্চিত্র হলো কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬)। উত্তম কুমার অভিনীত ছবির মধ্যে ৩১ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেনের বিপরীতে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে উত্তম-সুচিত্রা তখনকার সময়ে শ্রেষ্ঠ জুটি হিসাবে বিবেচনা করা হতো, যা ছিল চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে একটি আকর্ষনীয় বিষয়। ১৯৫৪ সালে একটি পোষ্টার ঝর তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে যেখানে লেখা ছিল আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নী পরীক্ষা।

উত্তম কুমারের ব্যক্তিগত জীবন খুব একটা স্থিতিময়তার মধ্যে কাটেনি, যা অনেক নায়ক – নায়িকাদের জীবনে ঘটে থাকে। ১৯৫৭ সালে সুপ্রিয় দেবীর সাথে গভীর সম্পর্কের কারনে তার দাম্পত্য জীবনে সংকটের সৃষ্টি হয়। এই সুত্র ধরেই গৌরী গাঙুলীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয় এবং ১৯৬২ সালের ২রা ডিসেম্বর তিনি সুপ্রিয় দেবীকে বিয়ে করেন। তারও আগে উত্তম – সুচিত্রা জুটিকে ঘিরে অনেক গুঞ্জন রটে তাদের দাম্পত্য জীবনে, যা হালে আরও পানি পায়। এই খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সুচিত্রার স্বামী দিবা নাথ সেনের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং চলচ্চিত্র ছেড়ে দিতে তাকে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু দশটির মত ছবিতে এই জুটির চুক্তি থাকায় আর অভিনয় ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এই বর্নাট্য জীবনের অধিকারী মহানায়ক মাত্র ৫৩ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮০ সালে ২৪শে জুলাই মৃত্যু বরন করেন। সুচিত্রা সেনের অভিনীত ছবি প্রনয় আশা মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে এবং এর পরপরি তিনি চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। তখন তার এক কালের জুটি সুচিত্রা সেন মৃত্যুর খবর পেয়ে আড়াল থেকে বাহিরে আলোয় আসেন এবং মাঝ রাত পর্যন্ত বসে ছিলেন মরদেহের পাশে। উত্তম কুমার রেখে যান দুই স্ত্রী, একপুত্র গৌতম, এক কন্যা সোমা ও একমাত্র নাতি গৌরবকে। উত্তম কুমারের সর্বশেষ ছবি ছিল ওগো বধু সুন্দরী। এই নায়কের জন্ম দিনে শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরন করি এবং তার মৃত্যুর মাঝ দিয়ে শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে এক যুগের অবসান ঘটেছিল।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও সাবেক জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)