মিহির স্যার

এলডিসি সম্মেলন ও বাংলাদেশের অবস্থান

ড: মিহির কুমার রায়: স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) বিষয়ে পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলন ৫ মার্চ থেকে কাতারের দোহায় ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি ৫: সম্ভাবনা থেকে সমৃদ্ধি) ৫ম জাতিসংঘ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ  সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব এলডিসির জন্য টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের নেতারা বক্তব্য রাখছেন। জাতিসংঘ যেসব দেশকে স্বল্পোন্নত হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, সেগুলোর প্রবৃদ্ধির জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এলডিসির ৪৬টি দেশ বিশ্বে জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ হলেও তাদের জিডিপি বিশ্বে মোট জিডিপির মাত্র ১.৫ শতাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের অবদান কম – মাত্র ১ শতাংশ। এটা স্পষ্ট যে, সেখানে আরও কিছু করা দরকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৫ই মার্চ রোববার কাতার সম্মেলনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এলডিসিতে উত্তরণে তাদের পারফরম্যান্সের জন্য কিছু প্রণোদনা থাকা উচিত। তিনি আরও বলেন, অনুদান নয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকৃত কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য তাদের প্রাপ্য চায়। আমি আশ্বস্ত করতে পারি যে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোও দর কষাকষিতে তাদের পক্ষ রাখবে। আমাদের দেশগুলো দান চায়না; আমরা যা চাই তা হল আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির অধীনে আমাদের পাওনা। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দোহা কর্মসূচি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য আশার আরেকটি আশ্বাস, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এলডিসিতে বাস্তব কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য তার প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তাদের জন্য কিছু উদ্ভাবনী ও ক্রান্তিকালীন অর্থায়ন ব্যবস্থা থাকতে পারে, তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বৈশ্বিক বাণিজ্যে তাদের অংশ দ্বিগুণ করার জন্য টেকসই সহায়তা প্রয়োজন, উন্নত দেশগুলোর এলডিসির জন্য ওডিএ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে হবে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণ টেকসই করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যম রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণ টেকসই করার জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যম রয়েছে। এলডিসিগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নকে নমনীয় এবং অনুমানযোগ্য করা উচিত, এলডিসিগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর বাস্তব এবং অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের তাদের অধিকার এবং মঙ্গলের জন্য সুরক্ষা প্রয়োজন, আমরা এলডিসিতে ২২৬ মিলিয়ন যুবকদের ব্যর্থ করতে পারিনা। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারী এবং তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ এলডিসি অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে, জলবায়ু সংকট এবং কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দীর্ঘকাল ধরে টানা সংঘাত চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের গল্পের বেশিরভাগ অংশই আমরা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আলোচনা করেছিলাম এবং সহযোগিতার জন্য আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরেছি।

৬ই মার্চ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাস্ত সময় কাটান এবং কাতারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত দোহা ইনভেস্টমেন্ট সামিট ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: পটেনশিয়ালস অব ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’-এ ভাষন দেন। প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে  দুই সরকারের একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যৌথ ব্যবসায়িক ফোরাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও কাতারের বেসরকারি খাতগুলোকে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের জন্য একক প্লাটফর্মে আনতে হবে। সরকারপ্রধান বলেন, ‘দুই  দেশকে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করতে হবে,’ বাংলাদেশ থেকে আরও রপ্তানির সুযোগ অন্বেষণে কাতারকে অনুরোধ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কাতারের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দলকে শিগগির বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান, তিনি কাতারে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান এবং জাতি গঠন প্রচেষ্টায় তাদের অংশগ্রহণ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের কিছু থ্রাস্ট সেক্টরের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন, তিনি জানান, তার সরকার অবকাঠামো ও লজিস্টিক খাত বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাতে কাতারের বিনিয়োগের সুযোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অফশোর গ্যাস অনুসন্ধান ও জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থায় কাতারের দক্ষতা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে। বাংলাদেশের কৃষি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এটিও কাতারের সঙ্গে বাই-ব্যাক ব্যবস্থায় কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি সরকারের তিনটি বিশেষ পর্যটন অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘সেখানে কাতার রিয়েল এস্টেট এবং হসপিটালিটি উভয় ক্ষেত্রেই জড়িত হতে পারে।’ এছাড়া কাতারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বিবেচনা করতে পারেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজারের আরও উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছে।’ ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে ব্যাঘাত বাংলাদেশের মতো দেশকে কঠিন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমরা কাতার থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে আগ্রহী, আমরা বাংলাদেশ থেকে আরও রপ্তানির সুযোগ অন্বেষণ করতে কাতারকে অনুরোধ করছি। বাংলাদেশ ও কাতার দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা দুই দেশের মানুষের মধ্যে একটি চমৎকার সেতুবন্ধন।’ বাংলাদেশে এই অঞ্চলের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সুবিধা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার একটি আঞ্চলিক সংযোগ এবং লজিস্টিক হাবের জন্য উপযোগী অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে।’ এসময় তিনি পদ্মা বহুমুখী সেতু, কর্ণফুলী নদীর টানেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সম্প্রসারিত তৃতীয় টার্মিনাল,  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রো-রেল ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন মেগা-প্রকল্পের কথাও উল্লেখ করেন। সরকার ইতোমধ্যে সমগ্র জাতিকে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট কভারেজের আওতায় এনেছে। বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দেশের ছেলে-মেয়েরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যোগদানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে, আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল ব্যাকবোনের বিকাশে বড় লাফ দিয়েছি, ধীরে ধীরে ৩৮টি হাইটেক পার্ক তৈরি করছি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ থেকে শক্তি নিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা। কাতার ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। আমরা কাতারে উন্নত কর্মসংস্থানের বাজার পূরণে আমাদের কর্মীবাহিনীকে জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করতে পারি, বাংলাদেশ এখন ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি সহ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি, ২০৩০ এর প্রথমার্ধের মধ্যে ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠব বলে অনুমান করা হচ্ছে।

সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সার্বিক অর্জন ও অংশীদারিত্বের সম্ভাবনাগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন যা একটি কূটনৈতিক বিজয় বলে প্রতিয়মান হয় যা একদিনে অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশকে তারপরও অনেক পথ হাটতে হবে যা বন্দুর যার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরিত হতে কঠোর শ্রম দিতে হয়েছে যা অনেক  মূল্যের বিনিময়ে প্রাপ্তি। আমরা যদি নিকট অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় যে ২০২১ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়া দেশের জন্য একটি ‘একটা অনন্য  উত্তোরণ’ এবং ‘বিরল সম্মান অর্জন’। এই রেজুলেশনটি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে পরবর্তী ধাপ উন্নয়নশীল  দেশে উত্তরণের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করল। এই যুগান্তকারি অর্জন বাংলাদেশ পায় যা বাঙালি জাতির জন্য এটা একটা বিরল  সম্মান অর্জন তথা বিশ্ব সভায় বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির জন্য একটা অনন্য উত্তোরণ। তাত্বিক বিশ্লেষনে দেখা যায়  অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত হিসেবে বিভাজন করা হয়ে থাকে। সত্তর দশকের  গোড়ার দিকে জাতিসংঘের উদ্যোগে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে কোন কোন দেশ বের হবে, সে  বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য তিন বছর পর পর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই  তিন সূচকের ভিত্তিতে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কিনা, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২  পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে, মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে, মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার  থাকতে হবে। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৮ ও ২০২১ সালের মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু  ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে  উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সিডিপি। সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত  স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে প্রস্তুতি নিতে বাড়তি দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। এর  আগে বাংলাদেশও বাড়তি সময় চেয়েছিল সিডিপির কাছে। সে হিসাবে এলডিসি থেকে বের হতে বাংলাদেশকে ২০২৬  সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। 

তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। উল্লেখ্য, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলো বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে-যেমন, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা, জিএসপি সুবিধা ইত্যাদি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়  অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এসব সুবিধা আর পাবে না। তখন এলডিসির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে রপ্তানির ক্ষেত্রে  বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ কমেও যেতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ হতে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখাসহ মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বেসরকারী খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় নীতিকৌশল ও পদক্ষেপ প্রণয়ন করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ইতোমধ্যে ১৩টি ক্ষেত্রে  সুপারিশমালা দিয়ে এলডিসি উত্তরণে ‘এ্যাকশন প্লান’ তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। কোন মন্ত্রণালয়,  সংস্থা বা অধিদফতর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে সেটিও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণের ‘পলিসি মোট্রিক্স  ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’ নামে একটি সুপারিশমালা দিয়েছে জিইডি। এর মধ্যে রাজস্ব নীতি, মুদ্রা নীতি, শিল্প ও বাণিজ্য  নীতি, অবকাঠামো খাত উন্নয়ন, সরকারী- বেসরকারী অংশীদারিত্ব (পিপিপি) এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো কর্মসূচী রয়েছে। এলডিসি  উত্তরণের পর কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যেই পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি  গ্র্যাজুয়েশন শীর্ষক একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হবে তা হলো; এক: জাতিসংঘের এই  স্বীকৃতির ফলে বিশ্ব বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো, যেমন উন্নয়নশীল  দেশের কাতারে উঠলে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ, এর পাশাপাশি ওষুধ শিল্পে  মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইন কানুনের অব্যাহতিও থাকবে না, যদিও এ ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সময় পাব; দুই:  কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে; উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা  বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে; তিন: ২০১৬ সালেই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশকে 'ব্লেন্ড কান্ট্রি' হিসেবে চিহ্নিত করেছে,  ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উচ্চ সুদ পরিশোধে অভ্যস্ত হয়েছে সুতরাং সহজ শর্তে ঋণ না পেলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়; চার: উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলায়  প্রস্তুতি নিতে হবে,  বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে, তবে মূল সমস্যা হলো, একমাত্র ভুটান ছাড়া আর কোনো  দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। উন্নত দেশগুলো ছাড়াও ভারত ও চীনের মতো বড় বড় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে  এফটিএ বা পিটিএ করতে হবে, দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে; পাঁচ: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য   চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যদি জিএসপি প্লাস পাওয়া কঠিন হয় বা পাওয়া না যায়, তাহলে এর বিকল্প কিছু পেতে হবে। কিন্তু এই  প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে ধরনের সুরক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তার ঘাটতি রয়েছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য  চুক্তির এই প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ করতে হবে; ছয়: পরিবহন, বন্দর,  আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যয় কমানো যেতে পারে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও  জ্বালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। সাত: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে  খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সব  সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর  অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে; অষ্ঠমত: তবে কিছু কৌশল গ্রহণ করা গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক রফতানিতে জিএসপি পাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি পাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্মপরিবেশ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের  ঘটনা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। গরিব দেশগুলোকে সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সুবিধা থেকে  বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। অবশ্য এখন আর বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখে না দাতারা। 

বাংলাদেশ সরকার এই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ় প্রত্যয়ি এবং বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল হিসাবে বিবেচিত। এলডিসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া পাওয়া পরিস্কার: যাহা পাই যেন জয় করে পাই, গ্রহন না করি দান।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)