পহেলা বৈশাখ

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন

ডেস্ক রিপোর্ট: পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা দিনটি সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। পাঠকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও জাপানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চিত্র তুলে ধরা হলো।

যুক্তরাষ্ট্রে পহেলা বৈশাখ

যুক্তরাষ্ট্রে নববর্ষের সবচেয়ে বড় উন্মাদনা দেখা যায় নিউইয়র্কে। মূলত বেশির ভাগ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নিউইয়র্কে থাকে। টাইম স্কয়ারে সহস্র কণ্ঠে বাংলা গানসহ নববর্ষের উৎসব ছড়িয়ে পড়ে জ্যাকসন হাইটসেও। রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের সঙ্গে মিল রেখে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শনিবার (১৩ এপ্রিল) শুরু হয় এ আয়োজন। দেশ ও প্রবাসের সাংস্কৃতিক কর্মীদের পরিবেশনায় বর্ণিল হয়ে ওঠে উৎসব। এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক সংগঠনের শতাধিক শিল্পী অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের নিয়ে এ আয়োজন। ভিন দেশে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের কাছে দেশ ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে চান আয়োজকরা। আগামী বছর লাখো কণ্ঠে বর্ষবরণের আয়োজনের লক্ষ্য তাদের। বাংলা বর্ষবরণের কথাগুলো বণিক বার্তাকে বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোর পিএইচডি শিক্ষার্থী সানজিদা বারী।

তিনি বলেন, ‘আমার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের প্রায় তিন বছর হতে চলল। বাংলাদেশে থাকার সময় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রায় এক মাস ধরে পরিকল্পনা করতাম, কীভাবে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পালন করা যায়। দেশের বাইরে আসার পর আর সবকিছুর সঙ্গে নববর্ষের এ উন্মাদনাও ভীষণভাবে মিস করি। তবে এখানে আসার পর দেখলাম, বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ এখানেও ভীষণ আনন্দের সঙ্গে উদযাপন হয়। বাংলা নববর্ষের উৎসবে নারীর পরনে থাকে সাদা-লাল শাড়ি আর পুরুষদের পাঞ্জাবি। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব এলাকায় বাঙালি অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী বেশি সেখানে আরো ব্যাপকভাবে বাংলা নববর্ষ পালন হয়। সেখানে দেখা যায় লাল-সাদা রঙের স্রোত। সবাই আসে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে। সবাই এসে একসঙ্গে গান, কবিতা শোনে, আপনজনের সঙ্গে ছবি তুলে মুহূর্তটি ধরে রাখে।’

শিকাগোর পহেলা বৈশাখ উদযাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। শিকাগোয় মোটামুটি অনেক বাংলাদেশীর বসবাস হওয়ায় এখানে বাংলা নববর্ষ পালনের প্রচলন রয়েছে। মূলত বাংলা নববর্ষ দুভাবে পালন করা হয়, বাংলাদেশী অ্যাসোসিয়েশন অব শিকাগোল্যান্ড নামে একটি সংগঠন বড় পরিসরে পালন করে। এছাড়া মূলত যেটা বেশি হয়, সবাই তার পরিচিত বন্ধুদের নিয়ে কোনো একটা পার্ক বা কারো বাড়িতে বা কোনো রেস্তোরাঁয় একত্র হয়ে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পালন করে থাকে। পার্ক বা বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে মূলত সবাই একটি করে বাংলাদেশী খাবার নিয়ে আসা হয় এবং সবাই মিলে একত্রে খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব এবং আড্ডা দেয়া হয়। পান্তা ভাত থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ সবই থাকে মেনুতে। বাংলা গান হয়ে ওঠে সে অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যমণি। আড্ডা, গানে সবাই স্মরণ করে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। দিন শেষে, যে যেখানেই থাকি, আমাদের প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে আমরা বাঙালি। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক জাতি, যার রয়েছে নিজস্ব ভাষা এবং গর্ব করার মতো সংস্কৃতি। বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম স্মারক।’

যুক্তরাজ্যে পহেলা বৈশাখ 

উত্তর লন্ডনের বৈশাখ উদযাপন নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। সাধারণত এপ্রিলে বৃষ্টিপ্রবণ হয়ে থাকে এ অঞ্চল। ফলে ২০ বছর ধরে জুন-জুলাইয়ের কোনো এক রোদ ঝলমলে দিনে পালন করা হয় পহেলা বৈশাখ। কোথাও হাজার হাজার বাঙালি আবার কোথাও শতাধিক বাঙালি জড়ো হয়ে পহেলা বৈশাখ পালন করতে দেখা যায়। তবে প্রতিটি বাঙালি বাড়ির আঙিনা বিশেষ এ দিনটিতে ভরে ওঠে কাছের মানুষের আড্ডায়। যেখানে আল্পনা থেকে শুরু করে খাবার কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই ওঠে বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এভাবেই যুক্তরাজ্যে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কথা বণিক বার্তাকে তুলে ধরেন লেখক ও সাংবাদিক বুলবুল হাসান।

তিনি বলেন, ‘প্রায় দুই দশক ধরে আমি লন্ডনে অবস্থান করছি। প্রথম দিকে বাঙালির বৈশাখী উৎসব ছিল পূর্ব লন্ডনকেন্দ্রিক। সেখানে বড় ধরনের মেলা, কনসার্ট হতো। এসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পীরা আসতেন। বলা হতো যে, এ মেলায় অংশ নিতে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০-৪০ হাজার মানুষ এসে জড়ো হতো। বাঙালি ছাড়াও বাঙালি নন এমন মানুষও এ অনুষ্ঠানে যোগ দিত। অর্থাৎ বাঙালির নানা বৈশিষ্ট্যের প্রতিচ্ছবি এ মেলায় আমরা দেখতে পেতাম। গত কয়েক বছরে মেলাটি কাউন্সিল থেকে বা সরকারি পর্যায়ে গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলেও বিগত বছরগুলোয় যেসব বাঙালি এখানে এসে জড়ো হয়েছে তারা কিন্তু নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছে। এভাবে ছোট ছোট উদ্যোগ লন্ডন, বার্মিংহাম ও ম্যানচেস্টারসহ বড় বড় শহরে পালন করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন ভেন্যুতে আলাদা করে বৈশাখী মেলা হচ্ছে। আমি যে অঞ্চলে থাকি এ জায়গার নাম হচ্ছে ইলফোর্ড। এখানে আজকে মেলা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার কারণে আজকের মেলা জমজমাট। পান্তা ভাত, ইলিশ মাছসহ নানা ধরনের বাঙালি খাবারের মাধ্যমে দিনটিকে বরাবরের মতো আজকেও উদযাপন করছি। একটি বিষয় হলো, প্রবাসে যেসব ছেলেমেয়েরা বড় হয় অনেকেই মনে করে তারা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা প্রথম প্রজন্ম এখানে যারা এসেছি আমাদের জন্য পহেলা বৈশাখ একটি বড় উপলক্ষ, এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখাতে পারি যে এটি আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে এটিকে যুক্ত করার একটি বড় মাধ্যম।’

বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা করার সময় বৈশাখের ব্যঞ্জনাটা অন্য রকম ছিল। সবকিছুই নতুন লাগত। তরুণ বয়সে আমাদের কাছে এটি অন্য রকম ব্যাপার ছিল। খুব উন্মুখ হয়ে থাকতাম বৈশাখের বিশেষ দিনটিতে। চারুকলাসহ পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে রঙের আমেজ আমাকে মোহিত করে রাখত। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রত্যেকটি জায়গায় বৈশাখ উদযাপন আমার সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।’

ভারতে পহেলা বৈশাখ

প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বেশ বড় পরিসরে পালন করা হয় বাংলা নববর্ষ। এর কিছুটা হলেও আঁচ করা যায় ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চিত্র দেখে। এবারের পহেলা বৈশাখ শুরু হয়েছে বৈশাখ শুরু হওয়ার আরো দুইদিন আগে।

গত শুক্রবার (১২ এপ্রিল) বিকালে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যকার প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ছিল। মজার ব্যাপার হলো, এ ফুটবল ম্যাচের পক্ষ ও বিপক্ষ দল গঠন করা হয় ’৪৭-এর দেশভাগের সময় কেন্দ্র করে। দেশভাগের সময় যাদের পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তারা হলো ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালির খেলাধুলার সংস্কৃতিতে যে ফুটবল একটি বিরাট জায়গা দখল করে আছে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া শনিবার (১৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় ‘ক্যাও কুইজ’। বাঙালি সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয় এ কুইজে। এছাড়া এদিন রাতে ছিল বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরতে সিনেমা প্রদর্শনীর আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩১’ উপলক্ষে চঞ্চল চৌধুরীর আয়নাবাজি সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। আগামীকাল সোমবার (১৫ এপ্রিল) জমকালো এ নববর্ষ আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। এতে থাকবে গান, কবিতা ও ছোট নাটকের মঞ্চায়নে এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। এছাড়া বাঙালি খাবারের সংস্কৃতি তুলে ধরতে থাকবে ‘খাবার উৎসব’। এতে থাকবে সাদা ভাত, আলু পোস্ত, ঝুরি আলু ভাজা, আমের চাটনি, পাপড়, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, দই কাতলা, মটন কষা, ধোঁকার ডালনা ইত্যাদি।

বাঙালির এ অনুষ্ঠানে ভারতের সব অঞ্চলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বিদেশী শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করে থাকেন। এভাবেই ভারতের পহেলা বৈশাখের চিত্রটি তুলে ধরেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মাহবুব আলম।

জাপানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন

বাংলা নববর্ষের দিনটি উদযাপন করা থেকে বাদ যায়নি জাপানে থাকা বাঙালিরাও। জাপানে আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাঙালি কমিউনিটির সবাই শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে একত্রে জড়ো হয়। খাবারের ক্ষেত্রে বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরার জন্য পান্তা ভাত, ইলিশ, নানা পদের ভর্তা, পিঠাসহ নানা খাবার খেয়েছি। তবে এ খাবারগুলো কিন্তু বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসতে হয়। সেক্ষেত্রে একেকজন একেকটা খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন। কথাগুলো বণিক বার্তাকে বলছিলেন জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ (প্রায়োগিক) বিভাগে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী লিয়ানা খাতুন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো পেন্টিং কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে পারিনি। কিন্তু এখানে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই বাঙালি সংস্কৃতিকে দেখেনি। আজকের এ বিশেষ দিনে আমাদের জড়ো হওয়ার মাধ্যমে সবাই খুব উপভোগ করেছে। অনেক জাপানিজ আমাদের এভাবে উদযাপন করা দেখে আমাদের আনন্দে শরিক হয়েছে। এভাবেই আমরা পালন করেছি। এ উৎসবের মাধ্যমে সবাইকে আরো আপন করে নেয়া হয়। আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদেশে থেকেও উপভোগ করছি। পাশাপাশি জাপানিজদের মধ্যেও আমাদের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছি।’

বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//

 

 


Comment As:

Comment (0)