Train Environment Friendly

পরিবেশবান্ধব হবে রেলপথ, চাপ কমবে সড়কে

ডেস্ক রিপোর্ট: পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে বাংলাদেশ এখনো সড়কপথনির্ভর। বন্দরগুলো থেকে ৯৬ শতাংশ মালামাল দেশের বিভিন্ন জেলায় যায় সড়কপথে। রেল ও নৌপথে যায় মাত্র ৪ শতাংশ পণ্য। এতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। সড়কে চাপ কমিয়ে পরিবেশ দূষণ রোধে ‘গ্রিন রেলওয়ের’ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।

সড়কে পণ্য পরিবহনের চাপ কমাতে দেশের রেলপথগুলো নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে রেলপথের ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডিজেল। এতে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। এই দূষণ রোধে কিছু রুটে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

নেওয়া হবে কয়েকটি মেগা প্রকল্প:
রেলওয়ে জানায়, গ্রিন রেলওয়ে রূপ দেওয়ার জন্য কয়েকটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হবে। মেগা প্রকল্পের রুট নির্ণয় ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে কি পরিমাণে ব্যয় হবে সেটা নির্ণয় করার জন্য টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (টিএপিপি) হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার।

গ্রিন রেলওয়ে রূপ দিতে প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় কত হবে, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) কবে নাগাদ সম্পন্ন করতে হবে, বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ও কী ধরনের কার্যক্রম থাকবে তা বিশ্লেষণ করা হবে। টিএপিপি ‘গ্রিন রেলওয়ে পরিবহন প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা’ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হবে ৯৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২৮ কোটি ৩৭ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প ঋণ ৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত।

সড়কে চাপ কমাতে একগুচ্ছ প্রকল্প:
সড়কের চাপ কমাতে নানান ধরনের উন্নয়ন কাজে গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে কমলাপুর মাল্টিমোডাল (পণ্যগুলো একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার) পরিবহন হাব নির্মাণের সুবিধার্থে বিদ্যমান অপারেশনাল এবং রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা স্থানান্তরসহ স্টেশন বিল্ডিং ইয়ার্ড পুনঃনির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে।

বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব নির্মাণে স্টেশন ভবন ও সুবিধা পুনঃনির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে। ফৌজদারহাট থেকে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড রেল সংযোগ এবং ইয়ার্ডের উন্নয়ন, ইয়ার্ড থেকে স্থাপন করা হবে বে টার্মিনাল লিংক। মালবাহী লোকোমোটিভ, রিলিফ ট্রেন ও হুইল লেদ কেনা, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে রেল সংযোগকারী অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য করা হবে ফিজিবিলিটি স্টাডি ও হালনাগাদ। এই কারিগরি প্রকল্পসহ মূল অবকাঠামো বিনিয়োগ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে প্রাথমিকভাবে সম্মতি জানিয়েছে।

পরিবেশবান্ধব রেলওয়ে পরিবহন: 
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, পরিবেশবান্ধব রেলওয়ে পরিবহন নিশ্চিতকল্পে একটি প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা প্রকল্প নেওয়া জরুরি। প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটি পরিবেশবান্ধব তথা টেকসই পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন করার জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন, অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন।

এই প্রকল্প সড়কপথের তুলনায় রেলপথে অধিক পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অধিকতর পরিবেশ দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। জ্বালানিও সাশ্রয়ী হবে। প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য- মূল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে ডিটেইলড নকশা প্রণয়ন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ক্লাইমেট চেঞ্জ বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপী পরিবেশবান্ধব রেলপথ নির্মাণে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই মেগা উদ্যোগ বাস্তবায়নে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। তবে এর আগে আমাদের প্রকল্পগুলোর ডিপিপি চূড়ান্ত করতে হবে। দ্রুতসময়ে আমরা এগুলো চূড়ান্ত করবো।’

গ্রিন রেলওয়ে রূপ দিতে কোন বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন দেশের পোর্ট থেকে ৯৬ শতাংশ মালামাল সড়কপথে সারাদেশে সাপ্লাই দেওয়া হয়। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েল বেশি ব্যবহার করা হয়। আমরা যদি সড়কের চাপ কমিয়ে রেলওয়ের মাধ্যমে মালামাল পরিবহন করি তবে কম জ্বালানি পুড়িয়ে স্বল্প খরচে পোর্ট থেকে মালামাল সারাদেশে সাপ্লাই দিতে পারবো।’

আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, ‘আমরা রেলপথের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত ও রূপান্তর করবো। রোড ট্রাফিকের চাপ কমাবে। বড় ধরনের পণ্য রেলপথের পরিবর্তে সড়কপথে পরিবহন করবো। ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর উন্নয়ন করবো। অবকাঠামোও ঢেলে সাজানো হবে। কীভাবে সড়কের চাপ রেলপথে স্থানান্তর করা যায় সেটা নির্ণয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে।’

ইলেকট্রিক রেলপথ:
প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশের রেলপথে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলে। কিন্তু বাংলাদেশে মেট্রোরেল ছাড়া ইলেকট্রিক রেলপথ নেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানোর জন্য পরিকল্পিত বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৫ দশমিক ৫ কোটি ডলার বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন রেলওয়ে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মেট্রোরেল সিস্টেমের মতোই ক্যাটেনারি তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ট্রেন চালানো হয়। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে পুরোপুরি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশার কাজ করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে তুরস্কের আঙ্কারাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তুমাসের সঙ্গে ৫ লাখ ২৪ হাজার ডলারের চুক্তি সই করে। ২০২৩ সালের আগস্টে নকশার কাজ শুরু করে তুমাস। দেশের ৩৪৮ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ট্র্যাকে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশের ৩৩৬ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার ও টঙ্গী-জয়দেবপুর অংশের ১১ দশমিক ২৭ কিলোমিটার রয়েছে।

২০৩২ সালের মধ্যে ৩৪৮ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ট্র্যাককে ৭০টি স্টেশনসহ বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন সিস্টেমে রূপান্তর করার লক্ষ্য রয়েছে। এটি চালুর লক্ষ্য ২০৩৩ সালে। প্রস্তাবিত সিস্টেমে দুই ধরনের লাইন থাকবে—মেইন ও কমিউটার। এতে ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার, যা পরে আপগ্রেড করা যাবে। এই নতুন সিস্টেম যাত্রী ও ট্রেন ব্যবহারকারীদের জন্য সময় সাশ্রয়, সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ হ্রাস, জ্বালানি সাশ্রয় এবং পরিবেশগত প্রভাবের দিক থেকে উপকারী হবে।

কমিউটার লাইন থেকে (জয়দেবপুর-নারায়ণগঞ্জ) ২৪ শতাংশ অর্থনৈতিক রিটার্ন আশা করা হচ্ছে, আর মেইন লাইন থেকে (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম) রিটার্ন আসবে ৪১ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বলেও আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কমিউটার লাইনে ১৫ শতাংশ ও মেইন লাইনে ২৫ শতাংশ রিটার্নের সম্ভাবনা রয়েছে।

বৈদ্যুতিক রেলপথ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, ‘আপনারা জানেন দেশের রেলপথের ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। এর পরিবর্তন ছাড়া গ্রিন রেলওয়ে রূপ শতভাগ দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম রেলপথে বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা শতভাগ বাস্তবায়নে একদিকে পণ্য পরিবহন বাড়বে অন্যদিকে রিটার্নও বেশি আসবে। আমরা সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ কমাবো ও পরিবহনের গতিবেগ বাড়বে। সড়কে চাপ কমলে জ্বালানি সাশ্রয় হবে এবং সবুজ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ফলে রেল পরিচালন ব্যয় কমবে, গড় গতিও বাড়বে।’

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)