বিবিসি বাংলাকে প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই
ডেস্ক রিপোর্ট: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই। আমাদের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি এবং ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এত ক্লোজ সম্পর্ক, সেটা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে পারব না।’
বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সোমবার প্রকাশিত এ সাক্ষাৎকারে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সাত মাসে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্র নেতৃত্বে নতুন দল গঠন, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম পদক্ষেপ সম্বন্ধে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমার প্রথম চেষ্টা ছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে (দেশের) আসল চেহারাটা বের করে আনা। মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে আনা। সেই চেষ্টার মধ্যে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ভবিষ্যৎটা কী হবে, সেটার জন্য চিন্তা করা—কোনদিকে আমরা অগ্রসর হব। প্রথম চিন্তা এল যে একটা সংস্কার দরকার আমাদের। কারণ, যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী সরকার চলতে পেরেছে। ১৬ বছর ধরে চলতে পেরেছে, আমরা কিছুই করতে পারিনি। তিন-তিনটা নির্বাচন হয়ে গেল, ভোটারের কোনো দেখা নেই। এই যে অসংখ্য রকমের দুর্নীতি, ব্যর্থতা, মিসরুল ইত্যাদি, সেখান থেকে আমরা কীভাবে টেনে বের করে আনব। টেনে বের করে আনতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো করতে হবে।’
সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার বক্তব্যে দেশের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ না করলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’ এ বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা তো সবসময় থাকে। একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে (দেশ) আনসেটেল করার জন্য। এটা তো সবসময় থ্রেট আছেই। প্রতি ক্ষণেই আছে, প্রতি জায়গাতেই আছে। কাজেই এটা তো সবসময় থাকবে।’
হুমকিটা আওয়ামী লীগের দিক থেকে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই। এটা তো অবভিয়াস। তারা মাঝে মাঝেই ঘোষণা করছে। বক্তৃতা দিচ্ছে। অ্যাড্রেস করছে। আপনি-আমরা সবাই শুনছি। মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে।’
সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, ‘অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। আগের মতোই রয়েছে।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, পুলিশ এখনো পুরোপুরি আস্থার সঙ্গে কাজ করতে পারছে না।
তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে সমস্যা ছিল যে পুলিশ বাহিনী ভয়ে রাস্তায় নামছিল না। দুদিন আগে তারা এদের (জনগণকে) গুলি করেছে। কাজেই মানুষ দেখলেই সে ভয় পায়। কাজেই তাকে ঠিক করতেই আমাদের কয়েক মাস চলে গেছে। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। এখন আবার নিয়ম-শৃঙ্খলার দিকে আমরা রওনা হয়েছি। কাজ করতে থাকব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছি। আমাদের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার কথা। তারা দিতে পারে নাই। আমি অভিযোগ করছি না। কারণ বিশাল একটা কাজ। আরেকটু সময় চেয়েছে—এক মাস, দুই মাস। ওইটুকু একটু পিছিয়ে গেছে। এগুলো আর কী। কাজ করতে গেলে যা হয়।’
ড. ইউনূস জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, ‘খুবই ভালো (সম্পর্ক)। আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয় নাই। আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছি আমাদের সম্পর্ক সবসময় ভালো থাকবে। এখনো ভালো আছে, ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, আমাদের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি এবং ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এত ক্লোজ সম্পর্ক, সেটা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে পারব না। তবে মাঝখানে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, আমি বলেছি মেঘ দেখা দিয়েছে। এই মেঘগুলো মোটামুটি এসেছে অপপ্রচার থেকে। এ অপপ্রচারের ফলে আমাদের সঙ্গে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। সেই ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।’
আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া বা দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের দাবির ব্যাপারে সরকারের ভাবনা জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি অত ডিটেইলসে যাচ্ছি না। আমার বরাবরই পজিশন হলো যে আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক। আমাদের এ দেশের ওপরে সমান অধিকার। আমরা সব ভাই ভাই। আমাদেরকে এ দেশেই বাঁচতে হবে। কাজেই যে মত-দল করবে, তার মতো করে সবকিছু করবে। এ দেশ থেকে কারো অধিকার কেড়ে নেয়ার কোনো উপায় নাই। কিন্তু যে অন্যায় করেছে, যার বিচার হওয়া উচিত, তার বিচার হতে হবে।’
এক-এগারোর সময় রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, ‘প্রথম কথা, আমি রাজনৈতিক দল গঠন করিনি। গঠন করার কথা বলেছিলাম। ১০ সপ্তাহ যাবৎ এই কথা জারি ছিল। ১০ সপ্তাহ পর আমি বলেছি, না, আমি রাজনীতিতে যাব না। আমি বলেছি যে পলিটিকস ইজ নট মাই কাপ অব টি। ওটা ওখানেই সমাপ্ত, এরপর আমাকে রাজনীতির কাছে কেউ টানতে পারেনি। এই ১০ সপ্তাহ—দ্যাটস এনাফ। আমার রাজনীতিতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজনীতি করিও না।’
সরকারপ্রধান একটা রাজনৈতিক পদ—এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধান উপদেষ্টা ব্যাখ্যা দেন, ‘এটা টেকনিক্যালি হলে হবে। আমি তো এই পদে আসতেও চাইনি। আমাকে অনুরোধ করেছে, বহুবারই করেছে। তারপর আমি শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়েছি। সেটার দায়িত্ব নিয়েছি। রাজনৈতিক পদ যদি হয়ে থাকে, এটা বাই ডেফিনিশন। আমি রাজনীতি করি না।’
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//