পুঁজিবাজারের দুর্নীতি ও বিনিয়োগ সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রয়োজন স্বদিচ্ছা
মোঃ সাইফুল ইসলাম: বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এটি যদি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার আওতায় পরিচালিত হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে, পুঁজিবাজার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিনিয়োগ সন্ত্রাসের কবলে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলছে। এই দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমনে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উত্তম সময়।
পুঁজিবাজারের দুর্নীতি বলতে বোঝায় এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুর্নীতির সঙ্গে মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা, বড় বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউসের মালিক বা কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত প্রভাবশালী গোষ্ঠী জড়িত। তারা একসঙ্গে কাজ করে বাজারের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে ব্যাহত করে। তাদের অপরাধের মধ্যে অন্যতম- ক) ইনসাইডার ট্রেডিং বা অভ্যন্তরীণ তথ্য আইন লঙ্ঘনঃ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কোম্পানির গোপন আর্থিক তথ্য আগে থেকেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সরবরাহ করে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ফেলে। খ) মার্কেট ম্যানিপুলেশনঃ বড় বিনিয়োগকারীরা একত্রিত হয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ায় বা কমায়, যা বাজারে কৃত্রিম চাহিদা ও সরবরাহ তৈরি করে। গ) আইন ও নীতিমালার অপব্যবহারঃ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে এবং আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা নেয়। ঘ) বাজার নিয়ন্ত্রণকারী লবির প্রভাবঃ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে বাজারের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
বিনিয়োগ সন্ত্রাস বলতে বোঝায় পরিকল্পিতভাবে বাজারে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করার পদ্ধতি। এর সঙ্গে সাধারণত হেজ ফান্ড অপারেটর, বড় ব্রোকারেজ হাউস, রাজনৈতিক শক্তি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এবং দলবদ্ধ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জড়িত। বিনিয়োগ সন্ত্রাসের কিছু প্রধান কৌশল হলো- ক) মিথ্যা গুজব ছড়ানোঃ কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। খ) Pump and Dump পদ্ধতিঃ প্রথমে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার পর হঠাৎ শেয়ার বিক্রি করে দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। গ) কৃত্রিম দর পতনঃ কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর পতন ঘটায়, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে কম দামে বিক্রি করে দেয়। ঘ) নির্দিষ্ট খাত বা কোম্পানিকে লক্ষ্যবস্তু বানানোঃ কিছু বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে বাজারে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
পুঁজিবাজার দুর্নীতিবাজ ও বিনিয়োগ সন্ত্রাসীরা মূলত পরস্পরের পরিপূরক। দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারা বিনিয়োগ সন্ত্রাসীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে এবং এর বিনিময়ে তারা আর্থিক সুবিধা পায়। অন্যদিকে বড় ব্রোকারেজ হাউস ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক শক্তির সাথে যুক্ত থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। পুঁজিবাজারের এই অপরাধচক্র ভাঙতে না পারলে বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের স্বদিচ্ছা ও সরকারের কঠোর অবস্থান, যেমন- ১. শক্তিশালী আইন ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থাঃ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা যেকোনো রাজনৈতিক ও কর্পোরেট প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে। ২. অভ্যন্তরীণ তথ্য লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শাস্তিঃ উন্নত বিশ্বের মতো তথ্য ফাঁসের অপরাধে কঠোর জরিমানা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, কারাদন্ড ও মৃত্যদন্ডের ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে আপরাধ করার আগে তাদের শাস্তির কথা মনে হয়ে গায়ের লোম শিহরে উঠে। ৩. বাজারে স্বয়ংক্রিয় নজরদারি প্রযুক্তিঃ সফটওয়্যার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সন্দেহজনক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে অপরাধীরা ছাড় না পায়। ৪. দ্রুত ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থাঃ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাজার সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি ও কার্যকর করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতাঃ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কৌশল ও বাজার বিশ্লেষণে দক্ষ করে তুলতে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে, সেইসাথে বিশ্লেষকদের সুবিধার্থে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ট্রেডিং ডেটা প্রদান করতে হবে।
যেমন- US SEC মার্কেট ম্যানিপুলেশন রোধে উচ্চমানের ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করেছে এবং আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে, UK FCA অভ্যন্তরীণ তথ্য লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কড়া আইন প্রয়োগ করে এবং তথ্য ফাঁসকারীকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করে, তেমনি সিঙ্গাপুর ও হংকং পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল নজরদারি ও বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে, সেইসাথে প্রায় প্রতিটি দেশের এক্সচেঞ্জ থেকেই ফ্রি বিনিয়োগ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় এবং বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে বিভিন্ন ধরণের ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে দুর্নীতি ও বিনিয়োগ সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আইন প্রয়োগের দৃঢ়তা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করবে। এখনই সময় বাজার নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা দূর করার এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার।
লেখক- পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//