এডিপি বাস্তবায়নে মন্থর গতি উন্নয়নে বড় বাধা
ড: মিহির কুমার রায়: বিগত সরকার গত জুন, ২০২৪ এ একটি বাজেট (২০২৪-২৫) মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন যেখানে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বছরের শুরুতে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সরকার ৫ই আগষ্ঠ পদত্যাগ করে এবং এ পরিস্থিতিতে এডিপি বাস্তবায়নের গতি মন্থর হয়ে পরে যা উন্নয়নের জন্য একটি বড় বিপর্যয় বলে প্রতিয়মান হয়। তথ্য বলছে অর্থবছরের শুরুর দিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি এমনিতেই ধীর থাকে। আর চলতি পরিস্থিতিতে এটা হবে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরিকল্পনা কমিশন জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছাড়া)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে লক্ষ করা গেছে। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এডিপি থেকে মোট ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই সময়ে এই হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এডিপি বাস্তবায়নে এটাই সবচেয়ে কম হার। করোনা মহামারির সময়েও এতটা নিম্ন হার দেখা যায়নি। এর কারণগুলো হলো- বিগত সরকারের পতন, উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় না করা, অন্তর্বর্তী সরকারের কড়াকড়ি, অদক্ষতায় সময়মতো কাজ করতে না পারা এবং পুরোনো সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক। এর আগেও দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা পার করেছে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়ন এত কম পরিমাণ অর্জন এর আগে কখনো হয়নি। যার ফলে এডিপি কাটছাট করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মূল বাজেটে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল বাজেটের তুলনায় এডিপির আকার ১৮ শতাংশ কমে গেছে, যা টাকার অঙ্কে ৩৮ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকার সমান। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বলছে, মূল এডিপি থেকে সাধারণত আরএডিপিতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বরাদ্দ কমানো হয়, তবে এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমানোর হার তুলনামূলক একটু বেশি হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় এই আরএডিপির প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। সভার সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা। এতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব, সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। এরপর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) এই প্রস্তাব অনুমোদন করে, যেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কমিশনের তৈরি চূড়ান্ত আরএডিপির খসড়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণত প্রতিবছর তিনটি ভাগে এডিপি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আর এডিপির ক্ষেত্রেও একই নিয়মে তিন ভাগ থেকেই টাকার অঙ্ক কমানো হয়েছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশন তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার মোট পরিমাণ ১০ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এরপর সরকার নিজেদের তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্পগুলো অর্থায়ন করবে। আর বিদেশি ঋণ বা অনুদান দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তার জন্য ৮১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছরে মোট আরএডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। এরপরেই রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৩১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা নিয়ে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে শিক্ষা খাত, যেখানে বরাদ্দ ২০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ, যার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বরাদ্দ ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। সংশোধিত উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাওয়া অন্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে—গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ১৯ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৬ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৮ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আর মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিবেচনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। পানিসম্পদের বরাদ্দ ১০ হাজার ২১১ কোটি টাকা, নৌ পরিবহনে বরাদ্দ ৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, সেতু বিভাগের বরাদ্দ ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরএডিপি বিষয়ে বলেন, ‘প্রতি বছর মার্চে উন্নয়ন বাজেট সংশোধন করা হয়। আমরা এটি আরও এগিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং জনগণের উপকার করা। এই সংশোধনীতে অবকাঠামোর চেয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের ব্যয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। এছাড়া দেশীয় অর্থায়নের চেয়ে বিদেশি অর্থ ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ২০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা, সংশোধনে ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা করা হয়। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে লক্ষ করা গেছে। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এডিপি থেকে মোট ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একইসময়ে এই হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এডিপি বাস্তবায়নে এটাই সবচেয়ে কম হার।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুটা রক্ষনশীল এবং বিগত সাত মাস সময়ে যে কয়টি একনেক সভা করেছে যাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে কোন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বরাদ্ধ যাবেনা এবং চলমান প্রকল্পগুলো প্রাধিকারের ভিত্তিতে চলমান থাকবে যা হবে উন্নয়নের অংশীদার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার যে কৃচ্ছতা সাধন নীতি গ্রহণ করেছে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আরএডিপিতে। সেই সঙ্গে তীব্র ডলার সংকটও অন্যতম কারণ। ‘উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়ার প্রকৃত কারণ বলা কঠিন। তবে কাজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দায়িত্ব যখন ভাগাভাগি হয়, তখন সবার ওপরই সমান দায়। কিন্তু সবাই সমানভাবে কাজ করতে পারেনা। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গুরুত্বপূর্ণ পদ হলেও এ ক্ষেত্রে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে তা সঠিক হয়না। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। এই জটিলতা শুধু আমাদের অংশে নয়, উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যেও রয়েছে। ফলে ঋণের অর্থ ছাড়ে দেরি হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে।
চলমান অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দ্বিতীয় পদ্মা সেতুসহ বড় ৯টি প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ ধরে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যুক্ত করা হয়েছে। পাটুরিয়া থেকে গোয়ালন্দে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮.১ মিটার। দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক হবে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার। নদীশাসনের কাজ হবে দুই প্রান্তে ১৮.৪ কিলোমিটার। প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে রাখা হয়েছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপান।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ মুহূর্তে এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসেছে, সবাই মনে করছেন যে ব্যাপক সংস্কার সাধনের এটাই উপযুক্ত সময় এবং এই দুর্লভ সুযোগটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে এমন কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, যেগুলো কিনা ইএসজি বাস্তবায়ন, ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, জনগণের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে একটি স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক ইকো সিস্টেম গড়ে তোলা, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং সব ধরনের দুর্নীতি দমন করবে। এ কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হবে এবং কোনোভাবেই বিশেষ করে আর্থিক খাতের দুর্বলতাগুলো উপেক্ষা করা যাবেনা। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে পুঞ্জীভূত বিপুল খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং অপর্যাপ্ত জবাবদিহিতার নজির তৈরি হয়েছে। এই ত্রুটিগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে এর মাশুল দিয়ে চলেছে জাতি। সেসঙ্গে যৌক্তিক সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ ‘মব জাস্টিসের’ মতো অনভিপ্রেত ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত ছয় মাসের মূল্যায়নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। এখন সময়ই বলে দেবে আমাদের আগামী ভবিষ্যত।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//