মিহির

চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে হবে

ড. মিহির কুমার রায়: চালের দাম বাড়ছে। আমদানি এবং উৎপাদনও কম। সরকারি মজুদও তুলনামূলক কম। চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন চালের মজুদ আছে সরকারের। তারপরও চালের দাম হুহু করে বাড়ছে। চালের দাম বৃদ্ধির জন্য চালকল মালিক ও কিছু করপোরেট গ্রুপকে দায়ী করা হলেও দায় অস্বীকার করছেন তারা। চাল ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, খুচরা বাজারে স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও সংকট থাকতে পারে, তবে সরবরাহ বা উৎপাদনে সংকট নেই। কিন্তু সরবরাহ বা উৎপাদনে সমস্যা না থাকলে চালের দাম আকাশছোঁয়া কেন?

বাজারে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চালের ব্যাপক আমদানি হচ্ছে এবং সরকারি গুদামে মজুদ আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাবই পড়ছে না। কমছে না চালের দাম। বরং গত কয়েক সপ্তাহে কিছু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর বাজার প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে চালের দাম এখনও ১৩ শতাংশ বেশি। ব্যবসায়ীরা পূর্বাভাস রেখে বলেছেন, বাজারের এ ঊর্ধ্বগতি আরও কিছুদিন থাকবে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ধানের নতুন ফলন বাজারে এলে তখন দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

সঠিক নীতি ও পরিসংখ্যানের অভাবে চালের বাজার যেকোনো সময় অস্থিতিশীল হতে পারে। কিন্তু যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। তাতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ পরিসংখ্যান অতিমূল্যায়িত, স্ফীত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে এবার আমন মৌসুমে ফলন হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ টন। চলতি আমন মৌসুমে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ লাখ হেক্টর। দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আমন মৌসুমে রেকর্ড ১ কোটি ৬৬ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। এবার সে রেকর্ড অতিক্রম করেছে বলে দাবি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, আমন উৎপাদন কোনোভাবেই দেড় কোটি টন ছাড়ানো সম্ভব না। কেননা এবারের বন্যায় আমন উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগ কৃষি উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য দিতে প্রায়ই বেশি সময়ক্ষেপণ করে। যেমন গত বছরের মে মাসে বোরো ধান উৎপাদনের কাজ শেষ হয়েছে। তার পরিসংখ্যান এসেছে সেপ্টেম্বরের শেষ প্রান্তে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্ভুল ও হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

চাল সিন্ডিকেটের ভিত খুবই শক্ত। তারা মৌসুমের সময় কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে। অভিযোগ রয়েছে, কৃষকের হাতে সামান্য যে ধান থাকে সেগুলোর মজুদ ফুরালে শুরু হয় করপোরেট ও মজুদদারের খেলা। এরপর বাজার চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে। সংকটসহ নানা ছুতায় ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে দর। খুচরা ব্যবসায়ীদের তরফে বলা হচ্ছে, মিলার এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে চালের বাজার অস্থির হচ্ছে। তারা ধানের সংকট বললেও চালের ঘাটতি নেই। চাহিদা অনুযায়ী চালও মিলছে। তবে অজানা কারণে দাম বেশি নিচ্ছে। তারা বলছেন, সাধারণত রোজায় চালের চাহিদা কম থাকে। ফলে বাজার স্বাভাবিক থাকার কথা। 

এত বেশি মজুদ থাকার পরও চালের বাজারে মূল্যহ্রাসের প্রভাব পড়ছে না। বরং রোজার আগে চালের দাম কয়েক দফা বেড়েছিল এবং রোজার পরেও কিছু কিছু চালের দাম বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে ভালো মানের সরু চালের দাম প্রতি কেজি এখন ৮০ থেকে ৯০, মাঝারি মানের চাল ৭০-৭৬ এবং মোটা চাল ৫৮-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের প্রদত্ত তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে তিন দফায় চালের দাম বেড়েছে এবং প্রতি কেজিতে গড়ে ৮ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি গুটিস্বর্ণা বা মোটা চালই বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায়, পাইজাম ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এসব চাল ২ টাকা কমেও কেনা যেত। বিআর-২৮ জাত বা মাঝারি চালের কেজি গত সপ্তাহের চেয়ে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায়। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু, অর্থাৎ মিনিকেট জাতের চালের দর। বর্তমানে ১ কেজি মিনিকেট চালের দাম সর্বোচ্চ ৯০ টাকা। গত সপ্তাহে এ ধরনের চালের কেজি ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, বাজারে গত এক বছরে মিনিকেট চালের দর বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। মাঝারি চালের প্রায় ১৪ এবং মোট চালের ৫ শতাংশ দর বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে নাজিরশাইল ও মিনিকেট জাতীয় চালের দাম। অন্য চালের দাম কেজিতে ২-১ টাকা বেড়েছে, কিন্তু মিনিকেটের কেজি এখন ৯০-এর ঘর পেরিয়ে।

গত বছর যেখানে চালের আমদানি ছিল না, সেখানে এবার সরকার ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম থেকে বিপুল চাল আমদানি করছে। স্থানীয় কৃষকের কাছ থেকেও চাল সংগ্রহ চলছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকারি গুদামে চালের মজুদ ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে মোট খাদ্য মজুদ ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে। বেসরকারি পর্যায়ে গত আট মাসে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১০ লাখ টন চাল ও গম আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৬ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৬ লাখ ২৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে এবং আমন মৌসুম থেকে সরকার ৫ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল সংগ্রহ করেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের বাজারে কৃত্রিম সংকটও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখিতায় কাজ করছে। উৎপাদন মৌসুম শেষে চাল আমদানির পরও চালের বাজার এতটা বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক। বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি-না সে বিষয়ে জোরালো নজরদারি জরুরি। বর্তমানে কম উৎপাদন ও আমদানির সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বড় মিলারদের বিরুদ্ধে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে দর অস্থিতিশীল করে তোলার অভিযোগ উঠছে। এ অবস্থায় আমদানি না বাড়ালে চালের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের মজুদ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বছরে মোট উৎপাদনের অন্তত ১০ শতাংশ চাল মজুদ রাখা দরকার, যা হওয়া উচিত ৪০ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে ১০ লাখ টনের কিছু বেশি চাল মজুদ থাকলেও তা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশে প্রতি মাসে ২৫ লাখ টন চালের চাহিদা থাকায় খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অন্তত সাড়ে ১২ লাখ টন চাল সার্বক্ষণিক মজুদ রাখা প্রয়োজন। গত বোরো মৌসুমে মিনিকেট ও জিরাশাইল ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় সরু চালের সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে এবং কৃষকের মজুদও শেষ হয়ে গেছে। তবে আশা করা হচ্ছে, বৈশাখে নতুন বোরো ধান বাজারে এলে চালের দাম কমবে। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, মৌসুমের পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনের পর চালের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ১০ টাকা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রধান খাদ্যশস্য চালের পেছনে দরিদ্র মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায়। আমন চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম। দেশে আমনের মৌসুম সবে শেষ হয়েছে। ভরা মৌসুমে যেকোনো পণ্য সরবরাহ বাড়ে এবং দাম কমে। কিন্তু চালের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আমনের ভরা মৌসুমেও পাইকারিতে চালের দাম বেড়েছিল। মৌসুম শেষ হতে না হতেই আবার চালের দাম বেড়েছে। দেশের চাহিদা ও আমনের উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রেখে চাল আমদানি যথাসময়ে করা না গেলে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তাই আগেই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেমন কঠিন হবে, বাজারের অস্থিতিশীলতা রোধ করাও সম্ভব হবে না। সরকার ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে খোলাবাজারে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সরবরাহের অভাবে এর কার্যকারিতা সীমিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে তদারকি বাড়ানো, ব্যবসায়ীদের মজুদের ওপর নজরদারি ও সরাসরি ভোক্তাদের কাছে সুলভ মূল্যে চাল পৌঁছানো দরকার।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ), সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)