জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নেমে আসবে: গভর্নর
নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি অর্থবছরের শেষ মাস জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
শুক্রবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও সমসাময়িক ব্যাংকিং ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিগত সময়ে মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হতো উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির বিষয়ে আমরা বলবো- আমাদের প্রচেষ্টা আংশিক সফল হয়েছে। আগে তথ্যটাকে কমিয়ে দেখানো হতো। ফলে মূল্যস্ফীতি ৯, সাড়ে ৯ এর উপরে উঠতো না। গত আগস্ট মাসে যখন নতুন তথ্য আসলো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি তখন সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আমরা ৫-৬ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছি, যা সন্তোষজনক।
তিনি বলেন, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ততটা কমেনি, তবে কিছুটা কমেছে। যেটা আগে সাড়ে ১২ শতাংশ ছিল, সেটা এখন ৯ শতাংশের কিছুটা উপরে আছে। এতে ৩ শতাংশ কমেছে। আমি আশাবাদী, সামনে এটা আরও কমবে। কারণ আমাদের মতো দেশে খাদ্যমূল্যটা যখন বাড়ে, তখন খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুই-তিন শতাংশ বাড়ে। কমার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। সামগ্রিকভাগে আমরা একটি স্বস্তির জায়গায় যেতে চাই।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আশা করছি মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মতো পাবো জুনের শেষে। জুলাই মাসে যে ডেটা পাবো, তখন হয়তো সে চিত্রটা আমরা পাবো। ইনশাল্লাহ আগামী বছরের দিকে ৫ শতাংশ কিংবা তারও নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবো। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা গেলে ইন্টারেস্ট রেটও আমরা কমিয়ে আনতে পারবো। ইন্টারেস্ট রেট আমরা ১০ শতাংশ রেখেছি।
মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে পলিসি রেট পজিটিভ রাখতে হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই মূল্যস্ফীতির পলিসি রেট বেশি, অর্থাৎ পজিটিভ। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ছিল না। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪, পলিসি রেট ছিল সাড়ে ৮। বিশাল একটা গ্যাপ ছিল। আমি আসার পরে এটাকে বাড়িয়ে ১০ করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ ১০ থেকে কমবে। যখন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে আসবে, তখন আমরা ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে আনবো। আমাদের পলিসি এখন সঠিকভাবে কাজ করছে।
অর্থপাচারে বাংলাদেশ একটি বড় ভিকটিম দাবি করে তিনি বলেন, কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী ব্যাংকিং খাতের বড় একটি অংশ অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ বাইরে নিয়ে গেছে। সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।
রোগ সারানোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, চুরি (অর্থপাচার) হওয়ার পরেই বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই, চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যা গেছে তা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা আমরা নেবো। ভবিষ্যতে যাতে অর্থপাচার না হয়, অর্থপাচার রোধ করা যায়, সে ব্যবস্থাও আমরা নেবো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমার মূল দায়িত্ব হলো দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি, আরও হবে আশা করি। আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি এখন আর নেই, একসময়ে বিশাল অংকের ঘাটতি ছিল, সেটা আমরা মিটিয়ে ফেলেছি। এখন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আমাদের রিজার্ভটাও স্থিতিশীল অবস্থায় আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।
গভর্নর আরও বলেন, আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিগত সময়ে বিভিন্ন রকমের আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি। গত ৮-৯ মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পেয়েছি ডাবল ডিজিট গ্রোথ আমরা এখন দেখতে পারছি না। তবে রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, ২৬-২৭ শতাংশে রয়েছে। সবমিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনোমিক্সে আমরা একটি স্বস্তির জায়গায় চলে আসছি। কোনো ধরনের ক্রাইসিস আছে এবং হবে বলে আমরা মনে করি না। আমরা একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আছি।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে তিনি বলেন, অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করছি। যে দেশে পাচার হয়েছে, সে দেশের আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন দেশের ল’ ফার্মের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদের বিষয়ে সঠিক তথ্য নিয়ে আসতে হবে। আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। তারপরও বিষয়টি সহজ নয়, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য হলো আগামী ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে পাচার হওয়া সম্পদ যদি ফ্রিজ করতে পারি, তাহলে এটি হবে আমাদের প্রাথমিক অর্জন।
গভর্নর বলেন, চট্টগ্রামেরই বড় গ্রুপ সোয়া লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে, এসব নিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। আরও কিছু আছে, বেক্সিমকো ৫০ হাজার, আরও অনেকগুলো ৩০ হাজার, ৪০ হাজার, ৫০ হাজার, ২০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। সবমিলিয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ছোটগুলো আমরা ধরছি না।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন, বিএফআইইউয়ের পরিচালক মো. আনিসুর রহমান, চট্টগ্রাম অফিসের পরিচালক মো. সালাহ উদ্দীন, মো. আরিফুজ্জামান, মো. আশিকুর রহমান, স্বরুপ কুমার চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক মো. জোবাইর হোসেন।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//