বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি
টেকসই প্রবৃদ্ধির রূপরেখা হতে পারে কৃষি বাজেট ২০২৫-২৬
ড: মিহির কুমার রায়:-
ভূমিকা: বিগত ৩রা মে, ২০২৫ (শনিবার) রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কৃষি বাজেট ২০২৫-২৬: টেকসই প্রবৃদ্ধির রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন কৃষি বাজেট নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সার্বিকভাবে কৃষিকে মূল্যায়ন করে এই খাতে বাজেটের আকার বাড়ান না। দেশে বর্তমানে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রয়েছে তার মূল কারণ কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক খাদ্য নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতি–সম্পর্কিত হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশ দুই বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঝুঁকির ‘লাল শ্রেণি’তে রয়েছে। এই শ্রেণি মানে হচ্ছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি লাল শ্রেণিতে রয়েছে ভারত, কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়া। বাংলাদেশের আরো অবনতি হয়েছে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির। গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি আবারো দুই অংক ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে এ হার খাদ্যপণ্যে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময় শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা বেড়েছে। অক্টোবরে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে তা ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর প্রচলিত পথেই হাঁটছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা কম। এ কারণে বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের মতো কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা না নিয়ে পণ্যমূল্য নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সেভাবে কার্যকরী হয় না। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা- বিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। এর আগের টানা এক বছর বাংলাদেশ লাল তালিকায় ছিল। প্রতি ছয় মাস পর এই চিত্র প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। সেই অনুসারে, প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ লাল তালিকায় অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির (বিএইএ) উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনার প্রাসঙ্গিক এবং এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিএইএ সভাপতি মো. আহসানুজ্জামান লিন্টুর সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ মো: মিজানুর রহমান।
প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ:
প্রবন্ধ উপস্থাপক বলেছেন দেশে প্রতিবছর ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণে হারাচ্ছে। অথচ ভিয়েতনাম ও চীনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাই দেশেও জলাশয়কে রিজার্ভ হিসেবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করতে হবে। ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরে বছরে ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়। এটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ মাত্র শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন টন আহরণ করা হয়। তিনি বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে কৃষকরাই সরাসরি উপকৃত হন। তাই কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের উন্নয়ন করতে হবে আমাদের। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে ফসল সংগ্রহের পর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি কমাতে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়া প্রয়োজন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ প্রয়োজন।
পণ্য সংরক্ষণে সরকারের বাজেট সহায়তা দেওয়ার কথা তুলে ধরে বলা হয়, সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। জেলা ও উপজেলায় আধুনিক হিমাগার নির্মাণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেল প্রবর্তন করে কাজ করতে হবে। কৃষক থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করতে হবে। টমেটো, পেঁয়াজ, আম, লিচু ইত্যাদি পচনশীল মৌসুমি ফল ও সবজির নষ্ট হওয়া ঠেকাতে - ব্লাস্ট ফ্রিজিং সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় ভাজা মাছ, শুকনা শাক-সবজি, ফলের জুশ ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল গঠনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, কৃষি পণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধকার বলেন, ভিয়েতনামে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ২০ শতাংশ সরকারি ভর্তুকি রয়েছে, যার ফলে রপ্তানি গত এক দশকে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে তাদের। প্রসঙ্গত, কৃষি পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা সুবিধা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও এক সময় এই হার ২০ শতাংশ ছিল।
বিশ্ব খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রতিবেদন বলছে, বছর দুয়েক আগে পাকিস্তান ও অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়ে। পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশে পৌঁছায়। মূলত খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানও আইএমএফের কাছ থেকে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ছিল। বিশ্বব্যাংকের সবুজ তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। আর কয়েক বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে ভারতও চাপে পড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে ছিল দেশটি। কিন্তু দেশটির মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও ভারত এখনো বিশ্বব্যাংকের ‘লাল’ তালিকায় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’ (নেতিবাচক), অর্থাৎ খাদ্য পণ্যের দাম কমছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই চিত্র। নেপাল ও মালদ্বীপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম। সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তানেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন মাইনাস। জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে নিত্য পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। অনেক দেশ নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়তে শুরু করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি ছিল। বেশি বিপাকে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। তারা এখন মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে পেরেছে। ভারতও চাপ সামলে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ আফগানিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক বছর ধরে মাইনাস রয়েছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল মাইনাস ৩ শতাংশ। দেশটিতে ব্যাপকহারে খাদ্যের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, নেপালে গত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে নেপালে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। মালদ্বীপে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। ভুটানের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়নি বিশ্বব্যাংক। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের তালিকায় টানা এক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ শ্রেণি বেগুনিতে রয়েছে ছয়টি দেশ। এই দেশগুলো হলো মালাবি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক। খাবারের দাম নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছে আটটি দেশ। সবুজ শ্রেণিভুক্ত দেশগুলো হলো সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন। তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো গত এক বছরে কখনো লাল, কখনো বেগুনি, কখনো-বা হলুদ বা সবুজ তালিকায় ছিল। কেউ নিজেদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নতি করেছে, কারও অবনতি হয়েছে।
সেমিনারে বক্তারা যা মন্তব্য করেন:
সেমিনারে বক্তারা বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। এর মূলে রয়েছে কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। দেশে প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমছে। তার বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ রাজনীতি ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তাই স্থানীয়ভাবে কৃষিকাজ ও খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো দরকার। এজন্য আসছে বাজেটে কৃষি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ হারে বাজেট বাড়লেও কৃষি বাজেট বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। মোট বাজেটের মধ্যে ১০ শতাংশ হারে কৃষি ও ৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিতে হবে। সভায় অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদরা কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বলেন, স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। অপরদিকে উৎপাদন ব্যয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এতে কৃষকের আয় বাড়বে ৩০-৪০ শতাংশের বেশি। এজন্য কৃষি বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষি বাজেট যারা প্রণয়ন করেন তারা কৃষির সার্বিক মূল্যায়ন করে বাজেট বাড়ান না। আমরা খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত। অথচ এর মূলে রয়েছে কৃষির উৎপাদন হ্রাস পাওয়া। মূল্যস্ফীতি কমাতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে পণ্যের যথাযথ মূল্য নিশ্চিতে কাজ করতে হবে জানিয়ে এই খাতে প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিতে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও অধ্যাপক ড: মিহির কুমার রায় বলেন আগামী বাজেট জুনের ৩ তারিখে মিডিয়াতে উপস্থাপনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এরি মধ্যে অর্থ বিভাগ তাদের বাজেটের খসরা চূড়ান্ত করেছে।
এমন একটা সময়ে এই সেমিনারের সুপারিশমালা সংযোজনের কোন সুযোগ নেই। ড: রায় প্রস্তাব করেন যে আগামী বাজেট উপস্থাপনার পর এক মাসের মধ্যে আরও একটি পোষ্ট বাজেট সেমিনার করা যায় কিনা যা প্রচলিত রীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আলোচক আরও উল্লেখ করেন যে সেমিনারের যে শীরোনাম টেকসই প্রবৃদ্ধির রূপরেখা’ তা তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি যদিও উপস্থাপনাটা ছিল বর্ণনামূলক। তিনি বলেন মূল্য নিয়ন্ত্রন করতে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্য পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া এবং খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় সাময়িকভাবে একক গ্রাহক ঋণসীমায় ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার নজরদারি বজায় রাখা হলেও এক্ষেত্রে বেশি কঠোর অবস্থানে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, যেটা আমরা ডিমের বাজারে দেখেছি। তাই সরকার বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের তারল্য প্রবাহে লাগাম টানা হয়েছে এবং এতে করে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এক্ষেত্রে এর সুফল পেতে হলে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।’ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার জেলায় জেলায় ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে অভিযান। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযানে যুক্ত হচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। নজরদারির পাশাপাশি কৃষি পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো বাজারে সবজি বিক্রির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এমনকি নিত্য পণ্যের মূল্য হ্রাসে পেঁয়াজ, চাল, তেল, চিনি, আলু ও ডিমের মতো পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে এসব উদ্যোগের সুফল মেলেনি। শুল্ক ছাড় দেয়া হলেও চাল-পেঁয়াজের দাম কমছে না। তাহলে এসব অর্থ কি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাচ্ছে? সরকার পরিবর্তন হলেও সুবিধাভোগীরা আগের মতোই বহাল রয়েছে। অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। বাজার তদারকির পদক্ষেপগুলোও দায়সারাভাবে করা হচ্ছে।’ সভায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কৃষিতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। এসময় পোল্ট্রি ফিড তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট-শুল্ক কমানোর পাশাপাশি খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
প্রধান অতিথির অবলোকন:
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, কৃষিতে গবেষণা বাড়ছে। এখাতে অভূত উন্নতি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস, রেমিটেন্স ও কৃষি অর্থনীতি। ‘তিনটি সেক্টর বাংলাদেশের রূপান্তরে ভূমিকা রাখছে। সেগুলো হলো-গার্মেন্টস, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও কৃষি। তিনটির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হচ্ছে কৃষি সেক্টর। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিকে উপেক্ষা করতে পারব না। অনেকে বলছেন, কৃষির গ্রোথ (বিকাশ) কম। গ্রোথ বাড়ানো যাবে। তবে আমাদের কোয়ালিটি গ্রোথ বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউ থেকে বের করে এনেছি। রুগ্ন দশা কেটে গেছে। ভয় পাবেন না, আমরা আছি। বাংলাদেশকে ভর্তুকি থেকে আস্তে আস্তে বের হতে হবে, গবেষণা ও উন্নয়নের অর্থ বেশি খরচ করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
কৃষিকে জাতীয় অর্থনীতির ‘মেরুদন্ড’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষির উন্নয়ন ছাড়া উন্নত দেশ হওয়া যাবে না। খাদ্য মূল্য স্থিতিশীল ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকের অবস্থা জানতে হবে। কৃষিতে নারী কর্মীর মূল্যায়ন করতে হবে। কৃষি হচ্ছে আমাদের মেরুদন্ড, কৃষির উন্নয়নে আমাদের কাজ করতে হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতির বক্তব্য:
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি মো. আহসানুজ্জামান লিন্টু বলেন, কৃষকের ছেলেরা কিন্তু এখন কৃষি কাজ করতে চাচ্ছে না। তাই কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে দ্রুত। যখন ফসল তোলার মৌসুম হয়, তখন শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। কৃষি পণ্যের দাম কৃষকের কাছ থেকে সরে গেলেই বেড়ে যায়, তাই কৃষক যেন পণ্য সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্য সরকারকেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার টাকা লুট হয়েছে অথচ কৃষক সহজে ঋণ পাচ্ছে না। কৃষক যেন সহজে ঋণ পায় সে ব্যবস্থাটা থাকতে হবে। কৃষক যখন ফসল তুলবে, তখনও যেন ঋণ নিতে পারে সেটাও চালু করা উচিত; কারণ টাকা না থাকায় তখন কম দামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য হন কৃষক। এ ঋণ দেওয়া হলে কৃষকের জন্য তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার সহায়ক হবে। সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা কম। যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় তাদের ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণও থাকে, সেটা মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অ্যাডহক ভিত্তিতে হয়তো পণ্য মূল্যের দাম বেঁধে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটি ভুল চিন্তা। বরং সিন্ডিকেট কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় জোর দিতে হবে। যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে বলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। বন্যার কারণে বেশ কিছু জেলায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজদের এখনো বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিম সরবরাহ সংকটের চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা, সেটি দেখতে বাজার ব্যবস্থাপনাকে আরো জোরদার করতে হবে।
উপসংহার:
আর্থিক ও রাজস্ব নীতিতে কৃচ্ছ্র সাধন এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলায় আমদানি উদারীকরণের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে কেবল আমদানি শিথিল করলেই হবে না, এর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোও প্রয়োজন। এছাড়া চাঁদাবাজি বন্ধ করার মাধ্যমে উৎপাদনকারী পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্যের অবাধ সরবরাহের বাধা দূর করতে হবে, যা পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হবে।
এই বিষয়গুলো যাতে আগামী বাজেটে স্থান পায় সেই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//