Crab Cultivation

কাঁকড়া চাষে বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় নারীর জীবন

ডেস্ক রিপোর্ট: সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর। এ উপজেলার কোনো কোনো এলাকার রাস্তার দুই ধারে বিস্তৃত জলরাশি। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন তেমনই এক এলাকা। এ ইউনিয়নের কোনো কোনো এলাকায় আছে একের পর এক জলাশয়। এসব জলাশয় পার হতে গেলে চোখে পড়ে ভাসমান হাজার হাজার কালো ছিদ্রযুক্ত বাক্সের সারি। সেসব বাক্সে চাষ হয় কাঁকড়া। স্থানীয় লোকজন কাঁকড়া চাষের স্থানটিকে বলেন ‘কাঁকড়া পয়েন্ট’।

চলাচলের জন্য জলাশয়ের মাঝামাঝি স্থানে বাঁশ, কাঠ ও টিনের ছাউনি দেওয়া সেতু তৈরি করা হয়েছে। কাঁকড়া চাষের একটি প্রতিষ্ঠানের সেতুতে নেমে দেখা যায়, পাঁচজন কাজ করছেন। এর মধ্যে তিনজন নারী। পুরুষ দুজন সুপারভাইজার, আর নারীরা ‘চেকার’। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, চেকারের কাজ হচ্ছে তিন ঘণ্টা পরপর বাক্স খুলে দেখা—কাঁকড়ার জন্য বাক্সের পানি ও পরিবেশ ঠিক আছে কি না।

তাঁরা চার দিন পরপর বাক্সের কাঁকড়াগুলোকে খাবার হিসেবে তেলাপিয়া মাছ টুকরা টুকরা করে দেন। এই প্রক্রিয়ায় সফট শেল বা নরম খোলসের কাঁকড়ার চাষ হয়। আর এই চাষ ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে এলাকার বিপুলসংখ্যক নারীর। কাঁকড়াচাষি ও বিশেষজ্ঞরা জানান, কাঁকড়া পয়েন্টে কাজ করা ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশই নারী। মূলত ‘চেকার’ হিসেবেই তাঁরা কাজ করেন।

পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) রেসিলিয়েন্ট হোমস্টিড অ্যান্ড লাইভলিহুড সাপোর্ট টু দ্য ভালনারেবল কোস্টাল পিপল অব বাংলাদেশ (আরএইচএল) সহকারী প্রকল্প সমন্বয়ক শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরায় এখন সবচেয়ে বেশি কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। শুধু শ্যামনগর উপজেলায় কাঁকড়া খামার আছে। সেসব খামারে প্রায় ১০ হাজার ব্যক্তি কাজ করেন। নারীরাই চালাচ্ছেন ছোট খামারগুলো। তিনি বলেন, ‘কাঁকড়া চাষে নারীদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বেশি। উপার্জনের অর্থ তাঁরা সন্তানের লেখাপড়া, স্বাস্থ্যে বেশি খরচ করেন। কয়েকটি পরিবারে দেখেছি, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাজ করার ফলে তাঁদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন তৈরি হয়েছে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, মৎস্যসম্পদের মধ্যে চিংড়ির পর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় কাঁকড়া। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮৬৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকার কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে। কাঁকড়ার প্রায় ৯৮ শতাংশই রপ্তানি হয় চীনসহ ১৭টি দেশে।


মাসের আয়ে চলে সংসার:
কাকরাচাষী নারীরা জানান, পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য তাঁরা কাজ করেন। ঘণ্টায় ৪০ টাকা করে পান। মাসে ১০–১২ হাজার টাকা আয় হয়।

কাজের ফাঁকে এক নারী বলেন, সংসারের প্রয়োজনে এক বছর ধরে তিনি কাকরা খামারে চেকারের কাজ করেন। তাঁর স্বামী সুপারভাইজার হিসেবে রয়েছেন। তিনি দিনে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা কাজ করেন। তাঁদের ১০ বছর বয়সী একটা মেয়ে রয়েছে। সে স্কুলে পড়ে।

আরেক নারী জানালেন, তিনি তিন বছর ধরে কাজ করছেন। বছর কয়েক আগে থেকে তিনি কাঁকড়া পয়েন্টে কাজ করেন। পরিবারে সচ্ছলতা আনতেই তিনি কাজে ঢোকেন।

কাঁকড়া খামারে দুই পালায় কাজ হয় উল্লেখ করে এক সুপারভাইজার বলেন, দিনের বেলা নারীরা কাজ করেন। কাঁকড়াগুলোকে তিন ঘণ্টা পরপর পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ফলে রাতেও শ্রমিকেরা থাকেন।  

২২ বছর ধরে কাঁকড়া চাষে যুক্ত তোতা এন্টারপ্রাইজের মালিক জিয়াউর রহমান বলেন, সাতক্ষীরায় ২০১৩ সাল থেকে সফট শেলের (নরম খোলস) কাঁকড়া চাষ শুরু হয়। তিন বছর আগে ছয় বিঘা পরিমাণ জলাশয়ের ওপর তিনি এই কাঁকড়া পয়েন্ট গড়ে তুলেছেন। ২০ হাজার বাক্সে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। তাঁর ২০ জন কর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জন নারী।

চাষও করছেন নারীরা:
এক কাঁকড়াচাষী জানান, ২০২০ সালে নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নিজ নামে ১০ হাজার বাক্সের কাঁকড়া পয়েন্ট গড়ে তোলেন। তিনি স্বামী ও শ্বশুর–শাশুড়ি মিলে ৫ জন পালা করে ২৪ ঘণ্টা কাঁকড়া পয়েন্টে সময় দেন। খরচ বাঁচাতে তাঁরা কোনো শ্রমিক নেননি।

তিনি বলেন, মাসে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি কাঁকড়া উৎপাদন হয়। মাসে ৩০–৩৫ হাজার টাকা লাভ হয় তাঁর। কাঁকড়া পয়েন্টে এখন তাঁর বিনিয়োগ ১০ লাখ টাকা। নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের লাভের টাকা দিয়ে স্বামী–স্ত্রী মিলে ১৭ বিঘা আয়তনের জলাশয়ে চিংড়ি চাষের ঘের গড়ে তুলেছেন। ভিটেমাটিতে ভাঙা ঘরের জায়গায় উঠেছে দুই কক্ষের আধা–পাকা বাড়ি। একমাত্র সন্তান ১০ বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছেন।

কাঁকড়া চাষই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বলে জানালেন একই ইউনিয়নের আরেক নারী। তিনি ২০১৫ সাল থেকে কাঁকড়া চাষ করছেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে তিনিও দুই বিঘা আয়তনের জলাশয়ে ১০ হাজার বাক্স কাঁকড়া চাষ করেন। নাতনির নামে তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছেন আশা এন্টারপ্রাইজ। তিনি বলেন, বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস কাঁকড়া চাষ হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠানে মাসে ৪০০ কেজি কাঁকড়া উৎপাদন হয়, মাস শেষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়।  

এই দুই নারী জানান, তাঁদের কাঁকড়া পয়েন্টে খোলপেটুয়া নদী থেকে লবণাক্ত পানি আসে। জোয়ারের সময় জলাশয়ের পানি পরিবর্তন করতে হয়। ৪৫ থেকে ৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া কিনে এনে বাক্সে চাষ করেন। ২২ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে কাঁকড়াগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়। সামনের বড় দুটি পা ও সাঁতার কাটার দুটি পা রেখে বাকি ছয়টা পা ছেঁটে ফেলা হয়। এতে কাঁকড়া দ্রুত খোলস ছেড়ে নরম হয়। নরম খোলসের কাঁকড়া যখন তার পুরোনো শক্ত খোলস ফেলে নতুন খোলস গঠন করে, তখন সেটি সংগ্রহ করা হয়। এই সময় কাঁকড়াটি নরম অবস্থায় থাকে। বিক্রির উপযোগী হওয়ার পর সেসব কাঁকড়া বাক্স থেকে তুলে মিঠাপানির পাত্রে রাখেন। মিঠাপানিতে কাঁকড়ার খোলস শক্ত হয় না। ৫১ থেকে ৬১ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ৩৫০–৪০০ টাকা, ৬১ থেকে ৯০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ৮০০ টাকা এবং ৯০ থেকে ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ১৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন তাঁরা। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের কাঁকড়া কিনে নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে। কিছু অংশ বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। নরম খোলসের পাশাপাশি চাষের সময় যেসব কাঁকড়ার খোলস বেশি শক্ত হয়ে যায়, সেসবসহ প্রাকৃতিকভাবে আহরিত ও চাষের হার্ড সেল কাঁকড়াও দেশে–বিদেশে বিক্রি হয়। এগুলোর দাম তুলনামূলক কম।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, জেলায় মোট কাঁকড়াজীবী ১ হাজার ৬৭১ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা আলাদা করা নেই। জেলায় কাঁকড়া উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলায় ৬৪৫ মেট্রিক টন ও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ৭৫০ মেট্রিক টন সফট সেল কাঁকড়া উৎপাদিত হয়।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এস সেলিম বলেন, কাঁকড়া চাষে বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। সংসারে সচ্ছলতা বাড়ছে। কাঁকড়া চাষের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে পোনা। এখনো কাঁকড়া পোনার প্রায় শতভাগ প্রাকৃতিকভাবে আহরিত হয়। সুন্দরবনসংলগ্ন খাল ও নদী থেকে কাঁকড়া নিয়ে আসেন নারী-পুরুষেরা।

একটা কাঁকড়া ২০ লাখ ডিম দেয়। কিন্তু দেশে কাঁকড়ার ডিম থেকে পোনা উৎপাদন এখনো ট্রায়াল (পরীক্ষা) পর্যায়ে। সাতক্ষীরায় মাত্র একটি হ্যাচারি আছে বেসরকারি উদ্যোগে। তিনি বলেন, পোনা চাষ করার জন্য বিনিয়োগ ও নিবেদিতপ্রাণ লোক দরকার। পোনা উৎপাদন ১ শতাংশের বেশি করতে পারলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আমূল বদলে যাবে। 
সূত্র: প্রথম আলো।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)