এপার-ওপারের বাঙ্গালিদের মিলন মেলায় বাঁধা কাটাঁতারের বেড়া

বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক, ঢাকা: মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার দুই পাশে দুই দেশের কয়েক হাজার মানুষ। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার হাজারো বাঙালিকে শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) একত্রিত করেছে বাঙালিদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষের আনন্দ।

সম্পর্কের টানের কাছে যেন হার মেনেছে কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়েই অনুষ্ঠিত হলো দুই বাংলার মিলনমেলা।

ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভক্তি ভুলে পাসপোর্ট-ভিসা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিজিবি-বিএসএফের বাধা-সবকিছু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ-ভারতের নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার উপচে পড়া এ ঢল শুধুই উচ্ছ্বাস আর আবেগের।

নববর্ষ উপলক্ষে শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল থেকে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার অমরখানা সীমান্তের ৭৪৪ নং মেইন পিলারের ১ থেকে ৭ নম্বর সাব-পিলার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে অনুষ্ঠিত দুই বাংলার মানুষের এ মিলন মেলা চলবে বিকেল পর্যন্ত।

সূর্যোদয়ের পর থেকেই পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে কাঁটাতারের কাছেকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে অপরদিকে ভারতীয়রাও তাদের কাঁটাতারের কাছকাছি আসার চেষ্টা করে।

পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) একমত হয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছ যাওয়ার অনুমতি দিলে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো উভয় দেশের মানুষজন কাঁটাতারের দুই পাশে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তারা কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী আদান-প্রদান করে।

কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের অমরখানা ও বোদাপাড়া এবং ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানার খালপাড়া, ভিমভিটা ও বড়ুয়াপাড়া, চাউলহাটিসহ উভয় দেশের বিভিন্ন বয়সী হাজারও মানুষ জড়ো হন। সেই সঙ্গে স্বজনদের দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন নানা রকমের উপহার সামগ্রী।

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা ছত্রমোহন রায় (৭০) বলেন, ‘আমার ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে ভারতের চাউলহাটিতে। আজকে নববর্ষের দিনে সুযোগ হয়েছে তাই মেয়ে-জামাই আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওদের জন্য কিছু কাপর-চোপড় আর খাবার জিনিস নিয়ে এসেছি।’

পঞ্চগড়ের জগদল এলাকার স্কুলছাত্রী কানিজ শারমিন সম্পা বলেন, ‘আমার দাদির বাবার বংশের প্রায় সবাই ভারতের জলপাইগুড়িতে বাস করে, আজকে আমার বাবা মায়ের সঙ্গে আমার দাদু (দাদির ভাই) ও অন্যন্য আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দীর্ঘ ১০ বছর পর তাদের সঙ্গে করতে পেরে খুবই ভাল লাগল।’

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পূর্বে পঞ্চগড় জেলার পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে ছিল। বিভক্তির পর এসব এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশ বিভাগের কারণে উভয় দেশের নাগরিকদের আত্মীয়-স্বজন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুই দেশের নাগরিকরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া আসার সুযোগ পেলেও ভারত তাদের সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে প্রায় এক যুগ ধরে বিজিবি ও বিএসএফের সহযোগিতায় অমরখানা সীমান্তে দুই বাংলার মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

অমরখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু বলেন, ‘সকাল থেকেই কাঁটাতারের দুই পাশে দুই বাংলার লোকজন উপস্থিত হতে থাকেন। নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এই মিলনমেলায় যাতে কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেই সঙ্গে বিজিবি এবং পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।’

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ‘নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মিলানমেলায় আমি নিজেও গিয়েছি, সেখানে দুই বাংলার মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভ্রাতৃত্ববোধের বহির্প্রকাশ ঘটেছে বলে আমি মনে করি। দীর্ঘদিন পর স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারা মানুষের আত্মার পরিতৃপ্তি যেন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জোরদার করে তুলবে।’

(এসএএম/ ১৪ এপ্রিল ২০১৭)


Comment As:

Comment (0)