অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বরূপ সন্ধানে
ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশে কতগুলো প্রবাদ অতি পরিচিত হিসাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেমন - ধর্ম যার যার উৎসব সবার, বাংলাদেশ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু প্রতিফলন এই সমাজে বিগত ৫০ বছরে কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিগত পাঁচ দশকে ১০ টি সরকার বাংলাদেশকে শাসন করেছে সত্যি কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি কেবল মুখেই রয়ে গেছে, বাস্তবে খুব কমই দেখা দিয়েছে, যার বলি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ ভাগের মত। প্রায়শই শুনা যায় দেশের সরকার প্রধানগন বলছেন দেশে সংখ্যালগু সংখ্যাগুরু বলতে কিছুই নেই, সব্ই আমরা বাংলাদেশী। আবার কোন কোন সরকার প্রধান বলছেন জাতী ধর্ম্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার নিয়ে এই দেশে বসবাস করবে এবং নিজ নিজ ধর্ম্ম পালন করবে। কিন্তু বাস্তবে কিছু ঘটনা এই ধারনাগুলোকে ম্লান করে দেয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যার জলন্ত প্রমান সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া শারদীয় দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিনষ্টের ঘটনা।
ঘটনার বিবরনে প্রকাশ বিগত ১৫ই অক্টোবর সদ্য সমাপ্ত দুর্গাপূজার সষ্টিতে ১১ই অক্টোবর সোমবার ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফের কথিত অবমাননার প্রচার চালিয়ে দেশের আরও অনেক স্থানে মন্দির আক্রমণ-ভাঙচুর ও প্রাণহানির ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং কুমিল্লার পরে পরপর ঘটল চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে, নোয়াখালীর চৌমুহনী, ফেনী শহরে একের পর এক মন্দির ও দোকান-বাড়িতে এবং সর্বশেষ রোববার বিকেলে রংপুরের পীরগঞ্জে মাঝিপাড়ায় অগ্নিসংযোগ যখন শারদীয় দূর্গা উৎসব শেষ হয়ে গেছে। তারপরও এ কুৎসিত কান্ড কেন? এরি মধ্যে জাতীয়/আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে এই মুজিব বর্ষে ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরে এবং টিলিভিশন চ্যানেলগুলো টকশোর আয়োজন করছে প্রতিদিনই নানা বিশ্লেষনের মাধ্যমে।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে বিগত ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে ১২টি বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ-অগ্নিসংযোগ তাণ্ডবের পর থেকে গত কয়েক বছর কি একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটেনি? ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে, ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিনে, এই তো গত মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুপল্লিতে? প্রতিটি ঘটনায় একই ছকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দরিদ্র, অসহায় কোনো মানুষের নামের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে, যা ভুয়া হওয়াই স্বাভাবিক, ইসলাম ধর্মের অবমাননাসূচক কিছু লেখা বা ছবি পোস্ট দিয়ে তা প্রচার করে উত্তেজনা সৃষ্টি, মিছিল বের করে হাঙ্গামা, মন্দির ও বাসাবাড়িতে হামলা, লুটপাট, ভীতি ছড়ানো ইত্যাদি। ওই ঘটনাগুলোয় বৌদ্ধ ও হিন্দুদের নাম যথাক্রমে উত্তম বড়ুয়া, রসরাজ দাস, টিটু রায়, সঞ্জু বর্মণ, বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য ও ঝুমন দাস পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে অন্যদের জেলহাজতে ঢুকিয়েছে, কারও ক্ষেত্রে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে জামিন বিলম্বিত হয়েছে। পরে জামিনে বেরিয়ে নিভৃত জীবনযাপন করছেন। কিন্তু হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়; একজনকেও সাজা দেওয়ার মতো মামলা এগিয়ে নিতে পারে না পুলিশ। আমরা এটাও দেখব যে, রামু থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত উল্লেখিত ঘটনাগুলো সকল গনতান্ত্রিক সরকারের আমলেই ঘটেছে। পীরগঞ্জে মাঝিপাড়ায় কয়েকজন সাংবাদিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আক্রান্ত শোভা রানীকে প্রশ্ন করলেন আপনাদের পোড়া ঘরগুলোকে সরকার নূতন করে তৈরী করে দেবেন, যা মাননীয় স্পীকারের নির্বাচনী এলাকা এবং উত্তরে শুভা রানী বললেন তারপরও এই নূতন ঘর আমার, এই মাটি আমার, এই দেশ আমার তা আমি কি ভাবে মেনে নেব যদিও আমি এই বাড়ীর মালিক, এই মাটি আমার, এই দেশ আমার, আমরা কারো করুণার উপর ভর করে বেঁচে থাকতে চাই না, নিজের সমঅধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই সংবিধানের আলোকে। এই জায়গাটিতে বিগত পাঁচ দশকে আমাদের অর্জন সীমিত হলেও এ দেশের সংগ্রামী জনগন ও সরকার আশাবাদি। কারন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারি দল বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ যেখানে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তার ধর্ম পালন করবে, দেশের সংবিধানেও সে নির্দেশনা দেয়া আছে, ইসলাম ধর্মও সে কথাই বলে। তিনি বলেন ‘ভৌগোলিক সীমারেখায় বাংলাদেশ ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে অনেক বড় বিধায় আমি চাই প্রতিটি মানুষের জীবন যেন সুন্দর হয়, উন্নত হয়, প্রতিটি মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র পায়; উন্নত জীবন পায় যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, সেটা যেন আমরা পূরণ করতে পারি। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এরি মধ্যে অনেক অবস্থার অগ্রগতি হয়েছে। তবে এর একটা গ্রহনযোগ্য টেকসই সমাধান দেখতে চায় ক্ষতিগ্রস্থ জনগন। অনেক বিশ্লেষক বলছেন পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা হয়েছে ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কারণে এবং সেটা আন্তদেশীয়, যা সিংহভাগ মানুষের মতামতও এমন। উন্নত দেশেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটে তবে এমন ঘটনা ঘটলে তাঁরা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাণী দিয়ে থেমে থাকেন না বরং সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ থাকে, তাঁরা সেগুলোর বিচার করেন। বিচার নিয়ে রাজনীতি হয় না, দাবি তুলতে হয় না, সরকার বিচার প্রক্রিয়াকে অনুগত রাখতে পারে না। বাংলাদেশে কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটলে তা দেখি সংকীর্ণ চোখে ও সংকীর্ণ স্বার্থেও, আমরা কেউ ধর্মের দোষ খুঁজি, রাষ্ট্রের দোষ খুঁজি না, সংবিধানের কথা বলি, আইনের শাসনের কথা বলি না। আবার কেউ কেউ বৈষম্যের স্বীকার হিসেবে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেখি, কেউ শুধু মুসল্লিদের। আমরা কয়েক পর্বে যেমন উসকানি, প্রতিক্রিয়া, পুলিশি হামলা আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া অপরাধ ঘটলে পুরোটার বিচার না চেয়ে পছন্দমতো পর্বের বিচারের দাবি করি। এই সবকিছুর মধ্যেও অন্য একটা পক্ষ আছে, তাদেরই কেউ পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছে, কেউ ফেসবুক, গুজব আর পুলিশ দিয়ে ধাপে ধাপে উত্তেজিত করেছে মানুষকে, কেউ এসব ঘটনাকে রাজনীতির জালে আবদ্ধ করছে, আবার কেউ কেউ আর্থিক লাভের হিসাব করছে। এখন আমাদের এই সকল সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে, বিশেষত: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এবং সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো নয়, বরংচ সর্বস্তরের জন প্রতিনিধিকে (সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপালিটি, ইউনিয়ন পরিষদ) এই অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাহত করতে কাজে লাগাতে হবে, যা সরকার এড়িয়ে যাচ্ছে। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ গড়ি উন্নয়নের স্বার্থে।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ