undefined

অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার মজুরি তত্ত্বের আবিষ্কারে

ড: মিহির কুমার রায়: নোবেল পুরস্কার প্রর্বতন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক আলফ্রেড  নোবেল। আলফ্রেড তার জীবদ্দশায় ডিনামাইটসহ ৩৫৫টি উদ্ভাবন করেন। এ সবের মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তিনি। অর্জিত সব অর্থ ১৮৯৫ সালে উইল করেন তিনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তি এই পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। পরে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ীকে পদক, সনদ ও মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীরা যে পদক পেতেন, সেটা ছিল ২৩ ক্যারেট স্বর্ণের। এরপর থেকে ১৮ ক্যারেট সবুজ স্বর্ণের ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া পদক দেওয়া হচ্ছে আর অর্থের পরিমাণ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার।

চলতি বছর তিনজন পেয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার। এই বিজয়ীরা হলেন ডেভিড কার্ড, জসুয়া ডি অ্যাংগ্রিস্ট ও গুইডো ইমবেনস। নোবেল পুরস্কারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে শ্রম অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ডেভিড কার্ড এবং কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণে পদ্ধতিগত অবদানের কারণে জসুয়া ডি অ্যাংগ্রিস্ট ও গুইডো ইমবেনসকে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ১ কোটি ক্রোনারও (১১ লাখ ডলার) ভাগাভাগি করে নেবেন তারা। এর মধ্যে ডেভিড একাই অর্ধেক, বাকি অর্থ পাবেন জসুয়া ডি অ্যাংরিস্ট ও গুইডো ইমবেনস ও এছাড়া প্রত্যেকে পাবেন স্বর্ণপদক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ৬৫ বছর বয়সী ডেভিড কার্ড, এছাড়া ৬১ বছর বয়সী জসুয়া ডি অ্যাংগ্রিস্ট ম্যাসেচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক গুইডো ইমবেনসের বয়স ৫৮ বছর যিনি ন্যূনতম মজুরি, অভিবাসন ও শিক্ষার শ্রম বাজারে প্রভাব বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন নূনতম মজুরী বৃদ্ধি কর্মের উপর  কি ধরনের প্রভাব ফেলে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নোবেল  কমিটি মনে করেন এই ত্রয়ী অর্থনীতিবিদ শ্রমবাজারের এবং প্রাকৃতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে কি ধরনের কার্যকারন সম্পর্ক নিরুপন করা যায় সে বিষয়ে নূতন দৃষ্টিদান করেছেন।

শ্রম অর্থনীতি বর্তমান সময়ের এ্কটি উল্লেখযোগ্য গবেষনার বিষয়, যার সাথে শ্রমিক, শ্রম বাজার ও শ্রমিকের মজুরি জড়িত রয়েছে। কোন শ্রমিক তার শারীরিক ও মানসিক শ্রমের বিনিময়ে  উৎপাদন কাজে সহায়তা করার জন্য পারিশ্রমিক বাবদ কোন নির্দ্দিষ্ট সময়ে যা উপার্জন করে তাই হলো অর্থনীতির ভাষায় শ্রমিকের মজুরি। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে  উদ্যোক্তা, চুক্তি, পারিশ্রমিক ও মজুরির হার, যা নির্ধারিত হয় শ্রমের চাহিদা ও যোগানের প্রভাবের উপরে। শ্রম উৎপাদনের এক মাত্র উপাদান নয় এবং ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির বক্তব্য হলো, মজুরি বাড়লে শ্রমিক চাকরি হারাবে এবং এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে এবারের নোবেল পাওয়া তিন অর্থনীতিবিদ। ডেভিড কার্ড কানাডীয় বংশোদ্ভূত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত তিন দশক ধরে তিনি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ব্রিটেন ও আমেরিকায় যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেটির ওপর গবেষণা করেছেন। ইইউর অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা সত্যিই কি ব্রিটিশ নাগরিকদের বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রধান কারণ অথবা আমেরিকান শ্রমবাজারের তথ্য সংগ্রহ করে দেখতে চেয়েছেন গোটা পৃথিবী থেকে অভিবাসী শ্রমশক্তি এনে আমেরিকা কি নিজ জনগণের প্রতি অবিচার করছে?

এই শক্তিশালী দুটি দেশের রক্ষণশীল এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল অভিবাসী লোকজন ঢুকে পড়ায় দেশের মানুষ চাকরি পায় না। ডেভিড কার্ড তথ্য হাজির করে দেখালেন, অভিবাসী শ্রমিকরা ছোট খাট চাকরিতে ঢোকার ফলে দেশের জনগণ ভালো চাকরিগুলোতে ঢোকার সুযোগ পায়। উনার মূল বক্তব্য ছিল, শ্রমিকদের বেতন বাড়ালে অনেকে চাকরি হারাবে এটা ভুল কথা বিধায় বেতন বাড়ালে শ্রমিক কাজে আগ্রহী হয়, দক্ষতা বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, মজুরি বাড়ালে শিল্পপতিরা নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের সুযোগ পায়, এতে অর্থনীতি আরও চাঙা হয়। বেশি মজুরি ও অভিবাসী শ্রমিকের পর তাদের পরবর্তি বক্তব্য ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে বেশি দক্ষ করে না অভিজ্ঞতা বেশি দক্ষ করে। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো টেকনিক্যাল শিক্ষার ওপর যে হারে গুরুত্ব দিচ্ছে, ডেভিড কার্ডের বক্তব্য এক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য হাজির করেছে। টেকনিক্যাল শিক্ষা ন্যূনতম হলেই যথেষ্ঠ। ন্যূনতম শিক্ষার পর জনশক্তিকে চাকরিতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ৫ বছর লেখাপড়া করে একজন মানুষ যা শেখে, ১ বছর সরাসরি কাজ করে একই লোক অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এই তত্ত্বটি গোটা পৃথিবীর সাধারণ শিক্ষা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও শ্রমবাজারের জন্য একটি যুৎসই নতুন চিন্তা।

ডেভিড কার্ডের এই চিন্তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন, দুই বন্ধু অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্স। এরা অর্থনীতিকে সমাজ বিজ্ঞানের টেবিলে রেখে শ্রমবাজার ব্যাখা করেছেন হঠাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, এথনিক ক্লিঞ্জিংসহ বিভিন্ন কারণে একটি বড় জনগোষ্ঠী যখন অন্য কোন দেশে রিফিউজি হয়, তখন ওই দেশের শ্রমবাজার কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দুই দশক ধরে গবেষনায় দেখেছেন উদ্বাস্তু শ্রমিকরা উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক এবং  উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণেই কোন দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে। উদাহরণ তো সামনেই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগান সংকট সৃষ্টির পেছনে রাশিয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সামরিক দাবা খেলাই মূলত দায়ী, রোহিঙ্গা সংকটতো প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে চীন আর ভারতের অসহযোগিত ইত্যাদি।

অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য অর্থনীতির চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব বেশি পেয়েছে, যেমন -  যখন একটি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হবে সে যে দেশেই হাজির হউক, শ্রম বাজারে তাদের ঢুকতে দিতেই হবে, যা মজুরি তত্ত্বের ছকে আবদ্ধ করেছেন গবেষক গন। এক কথায় উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিই কার্যত শক্তিশালী হবে। উদ্বাস্তু শ্রমিক এমন কিছু পরিশ্রমী কাজ করতে রাজি হয় যা নিজ দেশের মানুষ করতে আগ্রহী হয় না যেমন - ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হোটেলে ক্লিনারগুলো সব আফ্রিকা, সিরিয়া, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হওয়া শ্রমিক, রোম আর প্যারিসে আসা বাঙালি আর পাকিস্তানি যুবকদের শতকরা আশি ভাগই, আমেরিকায় ট্যাক্সি চালায়। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ানদের এখন আর এমন ছোটখাট কাজ ভালো লাগে না। একটি নতুন চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তিনজনকে যৌথভাবে অর্থনীতির ২০২১ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ।


Comment As:

Comment (0)