শিল্প-বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নধারা সুসংহতকরনে রপ্তানি-পণ্যের বৈচিত্রকরণ অপরিহার্য
আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমানে এ প্রবণতা মূলত সেবা ও শিল্প নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটি সময়ের চাহিদা, কালের বির্বতন - সময়ের দাবি।
স্বাধীনতার পর যেখানে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল মাত্র ৯ ভাগ, তা এখন বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৩৫ ভাগ হয়েছে, যার মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ২৪.২ শতাংশ। অন্যদিকে, স্বাধীনতার পর যেখানে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ছিল ৫০ শতাংশের বেশি, তা এখন হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩ শতাংশ হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা, অর্থনেতিক চাহিদা কৃষিপ্রধান অর্থনীতির দেশেকে ক্রমান্বয়ে শিল্প ও সেবা নির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে কৃষির তুলনার 'সেবা' ও 'শিল্প' খাত থেকে বাংলাদেশ বেশি পরিমাণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে।
বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরো ২০১৮ সালের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের জিডিপি 'সেবা', 'শিল্প' ও কৃষি খাতে অবদান যথাক্রমে ৫২.১১; ৩৩.৬৬ এবং ১৪.২৩%। এটি আমাদের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে অভূতপূর্ব অবদান রাখছে। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গ জনপদের মঙ্গার অভিশাপ হতে মুক্তি দিয়েছে শিল্প-কারখানার বিকাশ (নীলফামারীতে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেড)। যেখানে কর্মরত ৬৫%ই নারী শ্রমিক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পসমূহের অধিকাংশই গার্মেন্টস শিল্প। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দাবী অনুযায়ী, দেশে এ খাতে শ্রমিক সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। এর মধ্যে নারী শ্রমিক ৮০ শতাংশ। দেশের রপ্তানী আয়ের ৮৩% এই খাত হতে আসে (অর্থবছর ২০১৯-২০)। পোশাক রপ্তানিতে আমরা বিশ্বের ২য় অবস্থানে আছি। তৈরি পোশাক ব্যতিত বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রপ্তানী পণ্যগুলো হলো: পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, চামড়া শিল্প, চিংড়ি মাছ ইত্যাদি। সময় এগিয়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে বাড়ছে প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন চাহিদা, নতুন নতুন সমস্যা। সময়ে সাথে আমাদেরও নতুন নতুন সমস্যা ও সম্ভবনার সাথে টিকে থাকতে হবে, অর্জন করতে হবে সক্ষমতা।
ইপিবির দেওয়া তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সোমবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বা ৩৮ শতাংশ বেশি। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ১০২ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই তিন মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ দশমিক ২০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি কমেছে ৩১ শতাংশ। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, কৃষি পণ্যসহ অন্য সব খাতের রপ্তানি আয় বেড়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ২১ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের এ তিন মাসে আয় হয়েছিল ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ কোটি ২৮ লাখ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পাট খাতের রপ্তানি আয় কমেছে ৩১ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৩৮ শতাংশ। এ তিন মাসে হিমায়িত মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৭ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ শতাংশ। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম (তথ্যসুত্রঃ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। গত এক দশকে ঔষধ শিল্প থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে এগারো গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২০/১০ /২০২১ তারিখ বৃহস্পতিবার রাজধানীর পূর্বাচলে নবনির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনীকেন্দ্র উদ্বোধনকালে বলেন ‘রপ্তানি বাস্কেট আরো বৃদ্ধি করতে হবে এবং আমরা কোন ধরনের পণ্য কোন দেশে রপ্তানি করতে পারি- সে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ সবাইকে অনুরোধ করব আপনারাও আমাদের পণ্যের আরো বহুমুখীকরণের চেষ্টা করবেন। ’ মূলতঃ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ তার এই বক্তব্য। শুধুমাত্র পোষাক রপ্তানী নির্ভরশীলতায় আগামী দিনে আমাদের অর্থনীতি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে । সময়ের বিবর্তনে আমরা যেমন কৃষি থেকে শিল্পের দিকে ধাবিত হয়েছি এখন তেমনি অবস্থার প্রেক্ষিতে রপ্তানি পণ্যকেও লম্বা সারিতে সাজাতে হবে।
পোশাক রপ্তানী ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বহু পন্য বিদেশে রপ্তানী করা হয়ে থাকে। কভিড-১৯ মহামারীকালে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। সে বাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেড়েছে বাইসাইকেলের চাহিদা। কভিডকালে কেবল বাংলাদেশেই বাইসাইকেল রফতানি বেড়েছে ৪২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা বৃদ্ধিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশের বাইসাইকেলের রফতানি বেড়েছে, তার বেশির ভাগই গেছে ইউরোপের বাজারে। আর অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল জার্মানি। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা পূরণে টেকসই বাণিজ্যের জন্য সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রফতানি করছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে মেঘনা গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, চট্টগ্রামের সিরাজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে প্রাণ-আরএফএল রফতানি বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি করতে পেরেছে (তথ্যসুত্রঃ দৈনিক বণিক বার্তা; ১লা মে ২০২১)। এটি একটি উদাহরণ মাত্র।
বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন বূ্যরো এর জুলাই সেপ্টেম্বর ২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এছাড়াও অনেক অপ্রচলিত পণ্যের তালিকা আছে -যার চিত্র অনেক বড়। এগুলো হচ্ছে- পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, চারকোল, টুপি, মাছ ধরার বড়শি, মশারি, শুকনা খাবার, পাঁপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, কাজুবাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, গলফ শাফট, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, শাকসবজির বীজ, নারিকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, ব্লেড ইত্যাদি। এ ধরনের ১০০ এর বেশি পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু পণ্য রপ্তানির বিপরীতে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিও দিয়ে থাকে সরকার। একদম অপরিচিত পণ্যও রয়েছে এ তালিকায়। যেমন- শরীর থেকে রক্ত নেওয়ার পাইপ (ব্লাড টিউবিং সেট), অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই), সি আর কয়েল, তামার তার ইত্যাদি। এসব পণ্যের কারখানা সাধারণত বড় হয়, বিনিয়োগও একটু বেশি। তালিকার অন্য কারখানাগুলো ছোট ছোট। আবার এমন পণ্যও রয়েছে, যার একটিমাত্র কারখানা রয়েছে দেশে।
ইপিবির তথ্যানুসারে, কাজুবাদাম আমদানি করে আবার রপ্তানিও করে বাংলাদেশ। মাঝে প্রক্রিয়াজাত করার পর কিছুটা মূল্য সংযোজিত হয়। রেশম, রাবার, ফেলে দেওয়া কাপড় থেকে তৈরি পণ্য, ভবন নির্মাণসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, গ্লাস, তোয়ালে ইত্যাদিও রপ্তানি করা হয়। মসলা আমদানিকারক বাংলাদেশ আবার মসলা রপ্তানিকারকও। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় উল্লেখ করার মতো প্রসাধন পণ্যও। দেশে বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান পণ্য উংপাদনে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে এবং রপ্তানীর ক্ষেত্রেও সাফ্যল্য পাচ্ছে। নীলফামারীতে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেডে পরচুলা, চশমা, কসমেট্রিস, শিশুদের খেলার পুতুল ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও মোংলা ইপিজেডে আর্ন্তজাতিক ব্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের ব্যাগ তৈরি হয়ে থাকে। ইপিজেডেস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক Nike, Reebok, Lafuma, H&M (সুইডেন), Gap, Brouks, J.C Penny, Walmart, YKK Zipper, Kmart, Ospig (জার্মানি), মাদার কেয়ার (Uk), Lee, Wrangler, Dockers, Nba, Tommy Hilfiger, Adidas, Falcon ( ইউএসএ), এডি বাউয়ার, ঈগল, রিলি (ইউকে), এম্মিলি, ফ্রি স্পিরিল (ইউকে), মাইলস (জার্মানি), আমেরিকান ঈগল, হাই-টেক (ইউকে), ফিলিপ-মরিস (ইউকে), উইন্স মোর, ডেক্যাথলন ব্রান্ডের বিভিন্ন প্রোডাক্ট প্রস্তুত করে পৃথিবীর বহু দেশে তা রপ্তানি করে থাকে। ইপিজেডে স্থাপিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অটোমোবাইল পার্টস, ক্যামেরা র্পাটস, বাই-সাইকেল, এলইডি লাইট ইত্যাদি উংপাদন ও রপ্তানী করে সাফল্য পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীগন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইপিজেডসমূহে বিভিন্ন ধরণের পণ্য উৎপাদনের উর্দ্দেশে শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারে।
পোশাক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মধ্যমেয়াদি প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিকাশ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিল্প শ্রমিকের দক্ষতা/আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষায় কর্মদক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে যে ধরনের দক্ষতা আবশ্যকতা রয়েছে, তার সবটা বর্তমান শ্রমিকদের দিয়েই হবে- এমন মনে করছেন না উদ্যোক্তারা। শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী ও স্বল্প শিক্ষিত একটি অংশকে হয়তো এ খাত থেকে ছেড়ে যেতে হবে। হালকা প্রকৌশল, প্রযুক্তি সেবা নির্ভরর খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতির দৃশ্যমান কোন উন্নতি লক্ষনীয় নয়। প্রযুক্তি সেবার পরিধি সম্প্রসারণ, বিভিন্ন খাতের উৎপাদনের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি, সহায়ক আইন ও বিধিমালা প্রনয়ন, ঋণ সুবিধা, আর্থিক প্রণোদনা, কর রেয়াত, পরিবেশ ও শিল্প অঞ্চলে অবকাঠামো তৈরি, জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিতকরন ইত্যাদি বিষয়ে সর্বান্তকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি এক গবেষনায় উল্লেখ্য করা হয়েছে, “বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং সুনামের সহিত লাভজনকভাবে ব্যবসা করে আসছে, যা অন্যদের জন্য ও অনুকরনীয় হতে পারে। বাংলাদেশ বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০১টি দেশে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ছয় ধরনের পণ্যই হলো ৯২ শতাংশ। এগুলো হচ্ছে- ওভেন ও নিট পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য এবং হিমায়িত খাদ্য।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে। এ ছাড়া উত্তর আমেরিকায় ২২ শতাংশ, এশিয়ায় ১৩ শতাংশ, পূর্ব ইউরোপে ৩ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্যে ২ শতাংশ এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে ১ শতাংশের কম পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ইইউর ২৭ সদস্যদেশের পাশাপাশি সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, কানাডা, তুরস্ক, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, চিলি, বেলারুশ—এসব দেশেও শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। আফ্রিকার ২৯ কোটি জনগোষ্ঠীর ১৪টি দেশের একটি জোট রয়েছে সাউথ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি (এসএডিসি) নামে। রপ্তানির জন্য বিপুল সম্ভাবনার এই বাজার পুরোটাই পড়ে আছে। এদিকে হালকা প্রকৌশল, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, সিরামিক, মুদ্রণ, আসবাবপত্র, মসলা, আগর, ফলের জুস, সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতের পণ্য রপ্তানিতে জোর দিতে হবে।
সরকারের ডেডিকেটেড সংস্থা কর্তৃক রপ্তানীযোগ্য নতুন নতুন পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করে- তা প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী নতুন পণ্যের নতুন বাজার অনুসন্ধান করে তা বিনিয়োগকারীদের নিকট তুলে ধরার ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক। এ জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দিতে হবে। দেশে বিদেশে আর্ন্তজাতিক মেলার আয়োজন করা এবং বিদেশে রপ্তানী করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন। রপ্তানি বৃদ্ধিতে তৈরি পোশাকের বিকল্প পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানীতে নজর দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ‘দেশে রপ্তানী বৃদ্ধিতে বড় সমস্যা হলো করকাঠামো। চূড়ান্ত পণ্যে কর অনেক বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যে সেবা খাতের অবদান ৫২ শতাংশ, সেবা খাতের রপ্তানিকে অনেকটাই উপেক্ষা করা হচ্ছে।’ এদিকে নতুন বাজারের চেয়ে প্রতিষ্ঠিত বাজারের দিকেই রপ্তানিকারকদের ঝোঁক বেশি বলেও সমালোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা। সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করা গেলে তবেই সুমংহত হবে আমাদের অর্থনীতির গতিধারা। ফলস্বরূপ দৃঢ় বুনিয়াদ পাবে দেশের আমদানী-রপ্তানী,কর্মসস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক রির্জাভ এবং বহুপাক্ষিক অর্থনীতির সম্মুখ গতি।
লেখকঃ বি.কম (সম্মান), এম.কম (হিসাব বিজ্ঞান), মার্ষ্টাস অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস (ঢা.বি), এম বি এ (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট), উচ্চতর কোর্স, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য (ফেডারেশন ইউনিভার্সিটি অব অষ্টেলিয়া)।