বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন
ড: মিহির কুমার রায়ঃ বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমায় অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন যে, কেবল কৃষিই হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক। তিনি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে স্বনির্ভর কৃষি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ১৯৭২ সালে কৃষকদের মাঝে ১৬১২৫ মেট্রিক টন উফশী ধান বীজ, ৪৪হাজার মেট্রিক টন পাটবীজ, ১০৩৭ মেট্রিক টন গম বীজ, ১ লাখ হালচাষের বলদ গরু, ৫০ হাজার গাভী এবং ৩০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ, ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণ, ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কৃষকদের মাঝে ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ, ২৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন, নদীখনন, বাঁধ নির্মাণ, কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি ৫ শত কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটে (এডিপি) ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কৃষি গবেষণার ওপর জোর দিয়ে নার্স সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার আওতায় ছিল সাতটি গবেষনা ইনষ্ঠিটিউট এবং এ গুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা পরিষদকে (বার্ক)। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে বর্তমান সরকার কৃষি খাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে কৃষিতে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ৮৭,২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সাধিনতাত্তোর বাংলাদেশের পাঁচ দশকের পথ পরিক্রমায় আওয়ামিলীগ মাত্র একুশ বছরের কিছু বেশি সময়ে ক্ষমতায় আসিন রয়েছেন এবং বর্তমান সরকার কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পকিল্পনা গ্রহণ করেন যার মধ্যে রয়েছে এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্ল্যান: ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা। করোনাকালীন বিশ্বে যখন সকল দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কৃষকদের সাথে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে এসেছে, শাকসবজি উৎপাদনে ৩য় অবস্থানে, ‘সোনালি আঁশ’ পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়, বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, ইলিশ মাছ উৎপাদনে ১ম স্থানে রয়েছে যা কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্যেরই প্রমান। এর জন্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যেমন ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও এর কারন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি। ধান বাদে অন্য সব ধরনের ফসল নিয়ে গবেষণা করা এই সংস্থা বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ৪৪টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। এ জাতসমূহের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনেরও বেশি এবং চিনি আহরণের হার ১২% এর ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেই সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ঘোষণা করেন ‘মাছ হবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ।’ তাঁর এই উদ্যোগে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তৎসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয় ১০টি মাছ ধরার সামুদ্রিক ট্রলার। আহরণ শুরু হয় সামুদ্রিক মাছের। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিশাল সমুদ্র এলাকা জয় করে এবং বর্তমানে দেশের সমুদ্রসীমার আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যেখান থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশীয় গরুর জাত উন্নয়নের জন্য প্রথম কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করেন, যা আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অব্যাহত আছে। অধিদফতরটির তথ্য মতে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশে তরল দুধ উৎপাদন হয়েছে ৯৪.০৬ লাখ টন, মাংস-৭২.৬০ লাখ টন, ডিম-১৫৫২ কোটি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে- তরল দুধ-৯৯.২৩ লাখ টন, মাংস-৭৫.১৪ লাখ টন এবং ডিম-১৭১১ কোটি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশের তরল দুধের উৎপাদন ১০৬.৮০ লাখ টন, মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লাখ টন, ডিমের উৎপাদন ১৭৩৬ কোটি। ইতোমধ্যে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে আমরা শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই হইনি, বরং দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রাণিজ উৎপাদন রফতানি করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি সরঞ্জাম, হস্ত ও শক্তিচালিত যন্ত্রপাতির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত শ্রমিকের মাধ্যমে পরিচালিত অনেক কৃষিকাজ শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তবে এর গতি আরো বাড়তে হবে। কৃষিকাজের আধুনিকীকরণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ চারা রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য সংযোজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বলতে কেবল কৃষি যন্ত্রপাতি বিকাশের অগ্রগতিকেই বোঝায় না; বরং এটি কৃষির পরিবেশ, কৃষির মান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এটি গতিশীল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির বিকাশ, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক এমনকি কৃষি মৌসুম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের চিত্র হলো জমি চাষে ৯৫ ভাগ, সেচ ব্যবস্থায় ৯৫, ফসল তোলা বা হারভেস্টে ১.৫, ধান মাড়াইয়ে ৯৫, রোপণে দশমিক ৫ ভাগেরও কম। মূল সংকটের জায়গাটি এখানেই। ফসল উৎপাদন-পূর্ববর্তী যান্ত্রিকীকরণে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, উৎপাদন ও তার পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণে পিছিয়ে থাকায় আমাদের বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। জমি চাষ, মাড়াই ও সেচের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ হলেও সিডার, হারভেস্ট ও সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ ততটা হয়নি। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, চাষ, মাড়াই ও সেচের জন্য যে ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেগুলো টেকনোলজি বেজড। আর সিডার, হারভেস্ট ও কীটনাশক বা সার প্রয়োগের জন্য যে যন্ত্রগুলো রয়েছে তা টেকনোলজির পাশাপাশি নলেজ বেজড। ফলে যন্ত্র ব্যবহারে যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটিরও কিছুটা দক্ষতা অর্জনের বিষয় আছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে পারলে ওই যন্ত্রগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, ব্যবহার বাড়বে।
সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সব উপজেলায় কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এক বছর শেষ না হতেই অর্থ ছাড়সহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার খবর মিলছে। অর্থ ছাড় না হওয়ায় গত অর্থবছরেই শতভাগ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ কথা সত্য, ভর্তুকি সুবিধাসহ আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছানো ও টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আক্ষরিক অর্থেই কঠিন একটি কাজ এবং এটি নিশ্চিতের জন্য আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন ও তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা।
ডিএফই/ এসএএম//