প্রধানমন্ত্রীর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তোরণ ভাবনা ও আগামীর করনীয়
ড: মিহির কুমার রায়: বিগত ০২ জানুয়ারী ২০২২, রবিবার বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ উদযাপন উপলক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উদ্যোগে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার বলেছেন, মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে এই অর্জন যুক্ত করেছে এক নতুন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। জাতির পিতার আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৪১তম অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের পর এই অর্জন জাতির সামনে তুলে ধরতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সরকার। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার ওপর বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র, তথ্য চিত্র, উন্নয়নের ছোঁয়া লাভকারী সাধারণ জনগণের মতামতও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ নারী দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা আমন্ত্রিত ছিলেন। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিরা ভিডিওবার্তা দেন। এ অর্জনে সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন তারা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন প্রাপ্তিকে টেকসই করতে উত্তরণের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি ‘জাতীয় সরল উত্তরণ কৌশল (স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি) প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে টেকসই করতেই এই কৌশল প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি উদযাপনের অনুষ্ঠানে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক এ্যান্ড ডিপ, বাট আই হ্যাভ প্রমিজেস টু কিপ, এ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, এ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা আরও বলেন, এই জাতীয় দলিলে উত্তরণের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সব ধরনের দিক-নির্দেশনাসহ কার্যকর কৌশল থাকতে হবে। সম্যক গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রমাণনির্ভর সময়োপযোগী কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম- ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। তাই তরুণ প্রজন্মকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পারে। কেননা, তারুণ্যের শক্তিকে আমরা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই। আমরা বিজয়ী জাতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। বিশ্ব দরবারে বিজয়ী জাতি হিসেবে সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে আমরা চলবো।
সরকারপ্রধান বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রথম স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক আমাদের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমরা সব শর্ত পূরণ করে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছি যাতে চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাই। ২০২১-এর ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এ অর্জন জাতির জন্য কৃতিত্ব ও গৌরবের বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তাঁর সরকার বিগত ১৩ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ও মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যার মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ। করোনার পূববর্তী সময়ে জিডিপি ৮ শতাংশের ওপর উঠে যাবার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইএমএফ-এর হিসাব মতে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আরও বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল মাত্র ৮৭ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৭ গুণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় রফতানি আয় এবং প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকের উন্নয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা বাড়িয়েছি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, যা এবার ৮ গুণ বাড়িয়ে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করেছি। এতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী সুবিধাভোগী। ২০০৫ সালে দরিদ্র ও হতদরিদ্রের হার ছিল যথাক্রমে ৪০ ও ২৫ দশমিক ১ শতাংশ, যা কমে বর্তমানে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। করোনার মধ্যেও দেশব্যাপী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান অব্যাহত আছে-২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৪শ’ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯১১ কপি বই, প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা এবং সেখান থেকে বিনামূল্যে ৩০ পদের ওষুধ প্রদান এবং ১৩ বছরে ২২ হাজার ৬৬৪ ডাক্তার এবং ৩৫ হাজারের বেশি নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ প্রদানের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
অতীতের বিপর্যস্ত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দেশের সকল গৃহহীনকে অন্তত একটি ঘর করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের ঠিকানা গড়ে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের কর্মসূচীর কথাও উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়াতেও তাঁর সরকারের উদ্যোগও তুলে ধরেন।
করোনা শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষের জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন প্রণোদনার পাশাপাশি নগদ অর্থে টিকা কিনে বিনামূল্যে প্রদান করছে এবং করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করেছে। ইতোমধ্যে ১৩ কোটি ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর বুস্টার ডোজ দেয়াও আমরা শুরু করেছি। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন লাভ তাঁর সরকারের পরিকল্পিত উন্নয়ন পদক্ষেপের ফসল উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। এটা হঠাৎ করে আসেনি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়েছি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি, আশু করণীয়, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করেছি এবং পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছি।
এই অর্জন ধরে রেখে বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা) তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করেছে এবং এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা) বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কেননা, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে আমরা উচ্চ আয়ের উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে চাই। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলা করে উন্নয়নের গতিধারাটা অব্যাহত রাখতে এবং আগামী প্রজন্মকে সুন্দর জীবন দিতে তাঁর সরকারের শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়নের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি মাননীয় স্পীকার বলেন, ২০২১ সালের রূপকল্পের আলোকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল দেশ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে বাংলাদেশ।
তিনটি মানদন্ড পূরণ করে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হয়েছে- জাতিসংঘ এটিকে মিরাকল বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের উত্তরণের ক্ষেত্রে আরেকটি অন্যতম সোপান হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ নারী দলের দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ মহিলা ফুটবল দল, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারাদেশে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও আপনার কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, দেশের হয়ে খেলতে পেরেছি এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার- আমরা আপনার জন্য চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিয়ে আসছি।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সশরীরে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করে মারিয়া বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। আমাদের খুব ইচ্ছা আমরা চ্যাম্পিয়নরা আমাদের চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ-এর সঙ্গে একবার দেখা করব। নিশ্চয়ই আপনি আমাদের আপনাকে সশরীরে ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগটা করে দেবেন।’ মারিয়ার বক্তব্য বেশ উপভোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এলডিসি উত্তরণের পর কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যেই পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন শীর্ষক একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হবে তা হলো:
এক: জাতিসংঘের এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাজারে বর্তমানে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো। যেমন- উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতিও থাকবে না, যদিও এক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সময় পাব;
দুই: কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে; উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে।
তিন: ২০১৬ সালেই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশকে 'ব্লেন্ড কান্ট্রি' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উচ্চ সুদ পরিশোধে অভ্যস্ত হয়েছে সুতরাং সহজ শর্তে ঋণ না পেলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়;
চার: উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে মূল সমস্যা হলো- একমাত্র ভুটান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। উন্নত দেশগুলো ছাড়াও ভারত ও চীনের মতো বড় বড় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করতে হবে। দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে।
পাঁচ: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যদি জিএসপি প্লাস পাওয়া কঠিন হয় বা পাওয়া না যায়, তাহলে এর বিকল্প কিছু পেতে হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে ধরনের সুরক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তার ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির এই প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ করতে হবে।
ছয়: পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যয় কমানো যেতে পারে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। কাজেই শুধু আন্তর্জাতিক বাজার সুবিধার দিকে নজর রাখলে চলবে না বরং বাজার সুবিধা না থাকলেও যে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে, সে দৃষ্টান্ত আমাদের আছে।
সাত: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকবে। তা ছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে;
অষ্ঠমত: তবে কিছু কৌশল গ্রহণ করা গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে দেশের প্রধান রফতানিপণ্য তৈরি পোশাক রফতানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্ম পরিবেশ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। গরিব দেশগুলোকে সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। অবশ্য এখন আর বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখে না দাতারা। ২০১৬ সাল থেকে মিশ্রিত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এলডিসি থেকে বের হওয়ার অনেক সুবিধাও রয়েছে। যেমন:
এক: এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ;
দুই: আন্তর্জাতিক বাজারে নাগরিকদের কদর বাড়বে এবং উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আত্ম মর্যাদা পাব;
তিন: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন, দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে;
চার: বর্তমান অর্থনীতি উদীয়মান এবং এখানে বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে-এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম হচ্ছে, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া যা বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে বিধায় অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। ইতোমধ্যে ১১টি দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্যতা ও সমীক্ষা যাচাই করা হয়। ভুটানের পর এবার নেপালের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। এরপর ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে পিটিএ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এফটিএ এবং বৃহৎ অংশীদারিত্ব বাণিজ্য চুক্তির (সিপা) মতো বড় বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়
সবশেষে বলা যায়, মুজিব জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অনেক বড় ও বিরল অর্জন- যা বাংলাদেশের জনগণেরই অবদান। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা।