মিহির কুমার রায়       

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ভাবনায় আলোকিত বাংলাদেশ

ড: মিহির কুমার রায়: বিগত ২ জানুয়ারী রবিবার বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ উৎযাপন উপলক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উদ্যোগে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন তাঁর সরকার উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন প্রাপ্তিকে টেকসই করতে উত্তরণের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি ‘জাতীয় সরল উত্তরণ কৌশল (স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি) প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে টেকসই করতেই এই কৌশল প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি উদযাপনের অনুষ্ঠানে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক এ্যান্ড ডিপ, বাট আই হ্যাভ প্রমিজেস টু কিপ, এ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, এ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা আরও বলেন, এই জাতীয় দলিলে উত্তরণের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সব ধরনের দিক-নির্দেশনাসহ কার্যকর কৌশল থাকতে হবে। সম্যক গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রমাণনির্ভর সময়োপযোগী কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম- ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। তাই তরুণ প্রজন্মকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, যাতে তারা এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পারে। কেননা, তারুণ্যের শক্তিকে আমরা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই। আমরা বিজয়ী জাতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। বিশ্ব দরবারে বিজয়ী জাতি হিসেবে সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে আমরা চলব।

সরকার প্রধান বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রথম স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক আমাদের নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমরা সব শর্ত পূরণ করে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছি যাতে চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাই। ২০২১-এর ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এ অর্জন জাতির জন্য কৃতিত্ব ও গৌরবের বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর সরকার বিগত ১৩ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ও মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ  যার মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার, গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৫.১ শতাংশ। করোনার পূববর্তী সময়ে জিডিপি ৮ শতাংশের ওপর উঠে যাবার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইএমএফ-এর হিসাব মতে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আরও বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল মাত্র ৮৭ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৭ গুণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় রফতানি আয় এবং প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকের উন্নয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা বাড়ানো হয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, যা বর্তমান বছরে ৮ গুণ বাড়িয়ে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী সুবিধাভোগী। ২০০৫ সালে দরিদ্র ও হতদরিদ্রের হার ছিল যথাক্রমে ৪০ ও ২৫.১ শতাংশ, যা কমে বর্তমানে যথাক্রমে ২০.৫ ও ১০.৫ শতাংশ হয়েছে। করোনার মধ্যেও দেশব্যাপী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান অব্যাহত আছে-২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৪শ’ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯১১ কপি বই, প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা এবং সেখান থেকে বিনামূল্যে ৩০ পদের ওষুধ প্রদান এবং ১৩ বছরে ২২ হাজার ৬৬৪ ডাক্তার এবং ৩৫ হাজারের বেশি নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ প্রদানের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। অতীতের বিপর্যস্ত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দেশের সকল গৃহহীনকে অন্তত একটি ঘর করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের ঠিকানা গড়ে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের কর্মসূচীর কথাও উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়াতেও তাঁর সরকারের উদ্যোগও তুলে ধরেন। করোনা শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষের জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন প্রণোদনার পাশাপাশি নগদ অর্থে টিকা কিনে বিনামূল্যে প্রদান করছে এবং করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করেছে। ইতোমধ্যে ১৩ কোটি ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর বুস্টার ডোজ দেয়াও শুরু করা হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন লাভ তাঁর সরকারের পরিকল্পিত উন্নয়ন পদক্ষেপের ফসল উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। এটা হঠাৎ করে আসেনি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়ার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা নেয়া, আশু করণীয়, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে এগুচ্ছে দেশ। এই অর্জন ধরে রেখে বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা) তাঁর সরকার বাস্তবায়ন করেছে এবং এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা) বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কেননা, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলা করে উন্নয়নের গতিধারাটা অব্যাহত রাখতে এবং আগামী প্রজন্মকে সুন্দর জীবন দিতে তাঁর সরকারের শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়নের উদ্যোগের কাজ করে চলছে সরকার।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের ফলে তৈরি পোশাক, খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রফতানি উভয়ই সম্ভব হচ্ছে। দেশে ২০১৯ সালে জিডিপিতে শিল্পের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশে পৌঁছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের প্রসারের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। শুধু শিল্পে নয়, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটন প্রভৃতি সেবা খাত এবং অবকাঠামো উন্নয়ন, হাউজিং, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, আইসিটি প্রভৃতি খাতের ব্যাপক বিস্তৃতি ও কর্মসংস্থান লক্ষ করা যায়। সরকারি খাতে বর্ধিত বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে বৈদেশিক সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়নে কোনো সমস্যাই হয় না। এছাড়া বিদেশী বেসরকারি বিনিয়োগেও আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হবে।

তৈরি পোশাক রফতানি শুরুর আগে বাংলাদেশের রফতানি ঝুড়িতে ছিল মূলত পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে তৈরি পোশাক রফতানি শুরু হলে ক্রমে রফতানিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫ দশমিক ২ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয় দাঁড়ায় ৪২ বিলিয়ন (৪২০০ কোটি) ডলার। করোনাকালীন ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল, তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রায় দুই দশক ধরে রফতানি আয়ের ৮০-৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ও পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং ওষুধ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। উৎপাদনের পরিবেশ ও পণ্যের মান ও ছাড়পত্র নিশ্চিত হলে চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিভিত্তিকি খাদ্যপণ্য (মাছ, সবজি ও ফলমূল) রফতানিতেও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।

আগামী ২০২২-২৩ সাল নাগাদ বেশ কয়টি মেগা প্রকল্প সমাপ্ত হবে। শুধু পদ্মা সেতু চালু হলেই দেশের মোট জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। সুতরাং আরো কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘রূপকল্প ২০২১’- এর একটি অঙ্গীকার ছিল ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। বর্তমান সরকারের গত ১৩ বছরের প্রচেষ্টা ও কর্মপরিকল্পনায় দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, রেলওয়ে, বিমান প্রভৃতি স্থানে কম্পিউটারাইজড অনলাইন সেবা চালু হয়েছে। আইসিটি রফতানি ২০১৮ সালেই ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ৩৯টি হাইটেক পার্কের মধ্যে এরই মধ্যে নির্মিত নয়টিতে ১৬৬টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। করোনা মহামারীর সময়ও অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, করপোরেট অফিস এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে মুঠোফোনের সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি। বঙ্গবন্ধু-১ সাটেলাইট উৎক্ষেপণ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এতে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা প্রদান ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তা গ্রহন করতে পেরেছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক। সরকারের সচিব, করপোরেট গ্রুপের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। স্কুল-কলেজে উপবৃত্তি প্রদান করার ফলে নারীশিক্ষার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ শিক্ষক নারীদের মধ্যে থেকে নেয়ার বিধান করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে ৬০ শতাংশ শ্রমিক নারী হওয়ায় গ্রামীণ নারীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হয়েছে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমানে ৩৬ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও দেশের পার্লামেন্টের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রী, এমপি পদে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায়ও নারীদের নির্বাচনের ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। এসব কারণে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য স্থানে রয়েছে। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম।

জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের পর এই অর্জন জাতির সামনে তুলে ধরতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বর্তমান সরকার  যা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার ওপর বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র, তথ্য চিত্র, উন্নয়নের ছোঁয়া লাভকারী সাধারণ জনগণের মতামতও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ নারী দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা আমন্ত্রিত ছিলেন।। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিরা ভিডিওবার্তা দেন। এ অর্জনে সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন তারা।

এ ছাড়াও অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি মাননীয় স্পীকার বলেন ২০২১ সালের রূপকল্পের আলোকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল দেশ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা, রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা, প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ নারী দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ মহিলা ফুটবল দল, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারাদেশে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও আপনার কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, দেশের হয়ে খেলতে পেরেছি এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার- আমরা আপনার জন্য চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিয়ে আসছি।’ মারিয়ার বক্তব্য বেশ উপভোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। হাসিমুখে দুইবার হাততালিও দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও কতিপয় সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের উচ্চবিত্ত শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগী উচ্চমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর হাতে অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে যার ফলে আয়বৈষম্য কমানোর জন্য অধিক কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে নিয়মিত মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা থাকা জরুরি। উপরে বর্ণিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ও নাগরিকদের দেশপ্রেম নিয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা হলেই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ


Comment As:

Comment (0)