মিহির

আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত

ড: মিহির কুমার রায়: বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেটটি হতে পারে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট যা আগামী ৯ই জুন মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী কতৃক উপস্খাপিত হওয়ার কথা রয়েছে। চলতি অর্থ বছরের জন্য বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। আগামী অর্থ বছরের জন্য ‘সবকিছুর পরও এগোচ্ছি আমরা’ জাতীয় শিরোনাম থাকতে পারে বলে ধারণা দেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত আগামী বাজেটের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: এক: এটি হবে মোট জিডিপির ১৫.৩৮ শতাংশ এবং চলতি অর্থ বছরের বাজেটের চেয়ে ৭৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বেশি; দুই:  নতুন এই বাজেটে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হবে ৫.৫ শতাংশ; তৃতীয়: আগামী বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ চলতি অর্থ বছরে বাজেটের চেয়ে আগামী অর্থ বছরে ঘাটতি বাড়তে পারে ২৮ হাজার কোটি টাকা; চতুর্থ: আগামী অর্থ বছরে মোট আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৯.৯ শতাংশ যা চলতি অর্থ বছর তুলনায় আগামী বাজেটে মোট আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা; পঞ্চম: আগামী অর্থ বছরের মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে যা জিডিপির প্রায় ৮.৪ শতাংশ যা চলতি বছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি; ষষ্ঠ: আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা,  কর বহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা; সপ্তম:  আগামী অর্থ বছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি)  আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা; অষ্ঠম:  আগামী অর্থ বছরের জিডিপির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে যা চলতি অর্থ বছরে ছিল ৫.৩ শতাংশ; নবম: আগামী অর্থ বছরে যেসব খাতে বেশি করে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়া হতে পারে,  সেগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত ১৮ হাজার কোটি টাকা,  তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি)  আমদানি মূল্য পরিশোধ ও প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভর্তুকি ১৭ হাজার ৩০০ কোটি,  খাদ্য ভর্তুকি ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি এবং কৃষি প্রণোদনা বাবদ ১৫ হাজার কোটি টাকা। 

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন,  বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যে বড় ঘাটতিতে পড়েছে,  চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় মুদ্রা বিনিময় হারে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে,  এটা সামাল দিতে বাজেটে উদ্যোগ থাকতে হবে। অতি সম্প্রসারণমূলক বাজেট দিলে প্রকল্প খরচ বাড়বে,  আমদানি খরচও বাড়বে। তাই সব চিন্তা করে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো  উচ্চ মূল্যস্ফীতি,  আন্তর্জাতিক  বাজারে তেল-গ্যাস,  সারসহ বিভিন্ন নিত্য পণ্যের দাম বেশি বিধায় এতে সরকারের ভর্তুকি আরও বাড়বে আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য বড় সংস্কার দরকার। কিন্তু করদাতার সংখ্যা কিংবা মূসকের ভিত্তি একদিনে বাড়ানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাজেটের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় অনেক কম। ফলে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। অধিকন্তু,  ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করবে। সেকারণে দেশের আমদানি শুল্ক, কর, স্থানীয় ভ্যাট,  সম্পূরক শুল্ক ও আয়কর এবং করপোরেট করে আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে যেসব অসঙ্গতি আছে,  তা আগামী চার বছরের মধ্যে যথাসম্ভব যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ২০২৬ সালকে বিবেচনায় রেখে আয়কর ও করপোরেট করের ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রায় অচল ও অকার্যকর ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ বাতিলপূর্বক তদস্থলে করারোপের আদর্শিক নীতিমালা ভিত্তিক, সহজ-সরল বাংলা ভাষায় একটি আধুনিক আয়কর আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার। উল্লেখ্য,  সম্প্রতি বাংলা ভাষায় প্রণীত নতুন খসড়া আয়কর আইনটি ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশের অনুবাদ মাত্র বিধায় তা দিয়ে আদর্শ আয়কর আইনের প্রয়োজন পূরণ হবে না। বর্তমান বছরটি একদিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা,  অস্বাভাবিকতা যেমন প্রকট,  তেমনি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতিসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কাজেই এ অর্থ বছরের বাজেটে শুল্ক ও কর সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলি প্রণয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন বিষয় যেমন - আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি,  এ বৃদ্ধির সঙ্গে স্থানীয় বাজারের মুদ্রাস্ফীতির ফলস্বরূপ নিম্ন আয়ের মানুষসহ নিম্ন মধ্যবিত্ত,  মধ্যবিত্তের আয় সংকোচন এবং আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনার দাবি রাখে। 

আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট কেমন হওয়া দরকার এ ব্যাপারে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় । আসে যেমন: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির কত শতাংশ রয়েছে?  যেজন্য বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে যাতে এই সূচক কোনোভাবেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে না পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি কি হারে বাড়ছে সেটা খেয়াল করা। এবং এর পাশাপাশি রেমিট্যান্স এই দুটি অর্থনীতির চলতি হিসাবের ভারসাম্যটা রক্ষা করে। পরপর দুই বছর বাংলাদেশ চলতি হিসাবে ঘাটতিতে রয়েছে যা তার আগে ছিলনা। কিন্তু এক বছরের মধ্যে এই ঘাটতি প্রায় চার গুণ বেড়ে গেছে যা খুবই উদ্বেগজনক। ফলে এবারের বাজেট এমন হতে হবে যেন এ বছর চলতি হিসাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে আগামী বছর যেন এটাকে কমানো যায়। চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে তা মনে রাখতে হবে। বাজেটের ঘাটতি বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে চাপ পড়ে যা দেশে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নের পূর্ব শর্ত যা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই যা যে কোন মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মহামারিতে গরিব মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যার জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে হবে। গত দুই বছরে বিশেষ করে করোনাকালে এমনভাবে বাজেট প্রাক্কলন,  প্রস্তাব পাস করা হয়েছে যেমনে করা হয়েছে করোনায় এ অর্থনীতিতে যেন কিছুই হয়নি;  যেন এ অর্থনীতি খুব ভালো অবয়বে আছে। এ ধারণা প্রমাণ করার জন্য করোনা পূর্বকালের ব্যয়ে বাজেট প্রক্ষেপণ অব্যাহত রয়েছে। আয় অনুযায়ী কৃচ্ছ্র সাধন, অপব্যয়-অপচয় ও দুর্নীতি রোধের দৃষ্টিতে বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনায় না আনায় অসামঞ্জস্য, সমন্বয়হীনতা,  সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নানা ধরনের কথাবার্তা সৃষ্টি ও মানুষের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে যা টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায়।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)