মিহির

আসন্ন বাজেট, অর্থনীতির ভঙ্গুরতা ও স্বস্তির চ্যালেঞ্জ

ড: মিহির কুমার রায়: আগামী ৯ই জুন মহান জাতীয় সংসদে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট অর্থমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে যার শিরোনাম থাকতে পারে ‘সবকিছুর পরও এগোচ্ছি আমরা’ জাতীয় বলে ধারণা দেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট সামনে নিয়ে অনেকেই নানা বিষয়ে আলোচনা করছেন যা আমরা মিডিয়ার বদৌলতে অবলোকন করার সূযোগ পাচ্ছি, যার মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি,  ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাবনতি, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা ইত্যাদি। 

অর্থনীতিতে করোনার যে অভিঘাত, তা কাটিয়ে ওঠা এখনো সম্ভব হয়নি কিংবা অর্থনীতির করোনা-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যায়নি যার ফলে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। যার ফলে এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন যা বাজেটে সংশ্নিষ্টরা এই বাস্তবতা বিশ্নেষণ করেই দেশের দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্যের আলোকে (যেমন ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত) বাজেট প্রণয়ন করবেন যা প্রত্যাশিত যেমন এ বছরের বাজেটের তিনটি প্রেক্ষিত রয়েছে। প্রথমত, করোনার আগে সর্বশেষ অর্থ বছর ছিল ২০১৮- ১৯। বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। এই ঘাটতি নিয়েই আগামী ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে; দ্বিতীয়:- আন্তর্জাতিক বাজারে বড় ধরনের সংকট চলছে, জ্বালানি তেল এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ 
পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীল ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে; তৃতীয়ত: ২০০৮-০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে বড় সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, এরপর এবারই সবচেয়ে চাপে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বিগত বছরগুলোয় দেশের আর্থিক দায়-দেনা পরিস্থিতির কাঠামোটি সর্বদাই দুর্বল ছিল যা এখনো অব্যাহত রয়েছে যার আলামত হলো কর-জিডিপি অনুপাত ১০- এর ওপরে ওঠেনি যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। আবার সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৫৫ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল যা বছরের মার্চে ঘাটতি ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এই সংকট আরও বেশি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে। এর মূল কারণ সম্পদের অভাব এবং সম্পদ থাকলেও এর গুণগত মান সম্পূর্ণ ব্যয় করতে না পারা অর্থাৎ কর আদায় কম, ব্যয়ও কম এবং নিয়ন্ত্রিত বাজেট ঘাটতি যা কোনো অবস্থাতেই অর্থনীতির শক্তির লক্ষণ নয়। 

একটি দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার তিনটি সূচক খুবই গুরত্বপূর্ণ যেমন - মূল্যস্ফীতি হার,  মুদ্রার বিনিময় হার এবং ঋণের সুদের হার। এই তিনটি সূচকের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। এখানে উল্লেখ্য মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সুদের হার আটকে রাখা হচ্ছে এই বলে যে সুদের হার কম থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ করার পরও গত কয়েক বছরে বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি যা স্থবির হয়ে আছে। করোনার মধ্যেও ২০২০ সালে সঞ্চয়ের হার জিডিপির ৩১.৪২ শতাংশ, ২০২১ সালে তা কমে ৩০.৭৯ শতাংশে নেমে আসে যা চলতি বছর তা আরও কমে ২৫.৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে যার অর্থ মানুষ আর্থিক কষ্টের কারণে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে যা অর্থনৈতিক দুর্বলতার অন্যতম লক্ষণ। 

এই ধরনের পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত আগামী বাজেট নিয়ে যে সকল তথ্য পাওয়া গেছে/যাচ্ছে তা অনেকটা এরকম যে এটি হবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট যা মোট জিডিপির ১৫.৩৮ শতাংশ এবং চলতি অর্থ বছরের বাজেটের চেয়ে ৭৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বেশি; নতুন এই বাজেটে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হবে ৫.৫ শতাংশ; আগামী বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ৫.৫০ শতাংশ অর্থ্যাৎ চলতি অর্থ বছরে বাজেটের চেয়ে আগামী অর্থ বছরে ঘাটতি বাড়তে পারে ২৮ হাজার কোটি টাকা; আগামী অর্থ বছরে মোট আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৯.৯ শতাংশ যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটে মোট আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা; আগামী অর্থ বছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করা হয়েছে যা চলতি অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা; আগামী অর্থ বছরের জিডিপির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

এখন প্রশ্ন হলো আগত নূতন বছরের যে প্রাক্কলনগুলো করা হয়েছে তা গতানুগতিক কিনা বা বিশ্ব কিংবা স্থানীয় পরিস্থিতির আলোকে অর্থনীতির ভঙ্গুরতা গোছাতে কতটুকু সহায়ক হবে তা বিশ্লেষনের দাবি রাখে যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে নিরপেক্ষভাবে। আসন্ন জাতীয় বাজেটে সে পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এজন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা উচিত, করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা উচিত। রিজার্ভে চাপ কমানোর জন্য সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু আমদানি বৃদ্ধির পেছনে মূল অবদান হলো জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের। এসব পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নতুন অর্থ বছরের বাজেটকে ন্যূনতম বাস্তব ভিত্তিক করতে হলে ও রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হবে তা প্রকৃত মূল্য তথা জিডিপির সাথে তুলনা করা হলে নিম্নমুখী হবে। আর রাজস্ব আয় কমলে ব্যয়ের খাতগুলোরও রাশ টেনে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যয় হয়তো খুব একটা কমানো যাবে না; কিন্তু উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ কমাতে হবে। সার্বিকভাবে জিডিপির সাথে তুলনা করা হলে বাজেটের আয় ও ব্যয় সবকিছুই কমবে। আগামী বছরে বাজেটের জন্য দুটি কাজ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবৃদ্ধির ধারা সুসংহত ও ত্বরান্বিত করা। পাশাপাশি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে যারা পিছিয়ে আছে তাদের ন্যায্যভাবে এগিয়ে নেওয়া। আশা করা হচ্ছে কর্তৃপক্ষ বাজেট প্রণয়নে আলোচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবেন।

লেখক: গবেষক ও ডীন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)