20210515_143146

কালা পাহাড়ের প্রান্তরে 

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম: বহু বছর যাবৎ কালা পাহাড়ে যাই যাই করেও এতকাল যাওয়া হয়নি। তাই এবার সুযোগ আসায় আর মিছ না করে রাতেই ছুটলাম কুলাউড়া। সঙ্গী দেশের ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণ সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ। নিরিবিলী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাইক্রো চলছে মধ্যম গতিতে। নানান খোশগল্প চলতে চলতে গাড়ি ভুল পথে চলছে চুনারুঘাটের পথে। অতঃপর আবারো সঠিক পথে। যেতে যেতে শৃমঙ্গল পেরিয়ে গ্রান্ড সুলতানের পাশ কেটে নয়নাভিরাম চা বাগানের মাঝ দিয়ে শমসের নগর হয়ে কুলাউড়ার আজগরাবাদ। 

আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষমান ছিলো আমাদের গাইড দিলু মিয়া। ভোর তখন সাড়ে পাঁচটা। দিলুর বসত ঘরে আমাদের ব্যাগ রেখে তার বাড়ির আঙ্গীনায় দে-ছুট এর স্বেচ্ছ্বাসেবক রফিক, রতন ও নাজমুলের শুরু হয় খিচুড়ী রান্নার কর্মযজ্ঞ। কেউ ইট দিয়ে চুলা বানায়। কেউ লাকড়ি যোগায়। কেউবা আবার পেঁয়াজ মরিচ কাটে। এর মধ্যেই হঠাৎ শুরু হয় যায় আমার ডায়রিয়া। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। রান্নার পাতিল নিয়ে যখন সবার দৌড়ঝাপ তখন আমি বদনা হাতে বারংবার যাই! গাইড আমাকে নিয়ে চিন্তিত আর আমি চিন্তিত এতকালের স্বপ্ন কালা পাহাড়ের চূড়ায় আহরণ মনে হয় তীরে এসেই ভেস্তে যাবে। দুটো ইমোটিল ট্যাবলেট একসাথে খেয়ে ক্ষাণিকটা সময় চোখ বুজে রই। বেলা ৯টা। শরীর কিছুটা চাঙ্গা। খিচুড়ী খেয়ে বৃষ্টি উপক্ষো করেই হাইকিং স্টার্ট। সবজি ক্ষেত, চা বাগান, ছোট বড় ঝিরি পেরিয়ে ছুটছি। যতোই এগিয়ে যাই ততোই যেনো দেহমন সাপোর্ট দিচ্ছে। যেতে যেতে আধঘন্টার মধ্যেই কালা পাহাড়ের বেল্টে ট্র্র্যাকিং শুরু। দিগন্ত ছোঁয়া উঁচু উঁচু গাছ, নাম না জানা পাখির কলতান, ঝিঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে খাসিয়া পাড়া পেরিয়ে চলছে ট্র্যাকিং। মাঝে মাঝে গাছতলায় জিরিয়ে নিই। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিপাত আমাদের পদযাত্রা যেন থমকে দিতে চায়। কিন্তু দে-ছুট এর দামালরাতো আর থামবার পাত্র নয়। যতোই এগিয়ে যাই ততোই পাহাড়ের বুনো পরিবেশের মুগ্ধতা চোখে-মনে ভর করতে থাকে। বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ায়, পা দুটোর জোর একটু বেশিই লাগতেছে। তবে শক্তি যুগিয়েছে সঙ্গে থাকা খেঁজুর আর বুনো ফল। গাছ থেকে পাড়া বিচি কলাগুলো ছিলো সেই টেস্ট। যেতে যেতে ঘন্টা তিনেক পর গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়ি। তখন আমরা ছাড়া আর কোন জনমানবের দেখা নেই। সঙ্গী শুধু চারদিকের আছড়ে পড়া সবুজ লতাপাতা। যেনো সবুজের গালিচায় মোড়ানো চারপাশ। কিছু কিছু গাছের মগডাল দেখি চোখ দুটো উপরে তুলে। চূড়ায় আহরণের জন্য কালা পাহাড়টা অনেকটা সময় প্রায় একই জায়গা দিয়ে ঘুরেঘুরে উঠতে হয়। উঠতে উঠতে বেলা প্রায় দুইটা। দ্রুত এগিয়ে নুনছড়া ক্যাম্পে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই। কর্মরতদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে পাহাড়ের সুখ-দুঃখের গল্প শুনি।

 

কালা পাহাড়ে খাসিয়াদের বসবাস। তাই তাদের আধিপত্যও বেশি। ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের ভিউ খুব সুন্দর লাগে। চারদিক সবুজ আর সবুজ। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে দোলে বৃক্ষরাজি। নয়নাভিরাম সব দৃশ্যপট। কিন্তু পাহাড়ের নাম কালা কেনো সেটাই মাথায় ধরল না। এর রহস্য জানার মত নির্ভরযোগ্য কাউকে পেলামও না। উপস্থিত লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ক্যাম্প হতে চূড়ায় যেতে লাগবে বড়জোর ২০ মিনিট। তবে জোঁকের তান্ডব পেরুতে হবে। সেটা কোন ব্যাপার না। সঙ্গে থাকা জোঁক প্রতিরোধক তৈল মর্দন করে নব উদ্যমে ছুটলাম। ক্যাম্পের লোকজন হাতির কথাটাও মনে করিয়ে দিলো। হ্যাঁ যে কথা সেই কাজ। হাতির মলের অভাব নেই। তবে তেলের কারণে পাহাড়ের সাইলেন্ট কিলার জোঁক সুবিধা করতে পারতেছিলো না। ঘন বাশঁঝাড় পেরিয়ে চূড়ার দেখা মিলে। বীর দর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচিন এক পাকুর বৃক্ষ। উঠতে উঠতে একেবারে কালা পাহাড়ের চূড়ায়। ঝিরঝির বাতাস যেনো জানান দেয় তোমরা সফল। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে কালা পাহাড়ের চূড়ার উচ্চতা প্রায় ১১০০ ফিট। পাহাড়ের অপর প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। বাংলাদেশে এর ৬০ ভাগ ও অবশিষ্ট পাহাড় অংশ ভারতের উত্তর ত্রিপুরায়। আমাদের কালা পাহাড় ভারতে রঘুনন্দন নামে পরিচিত। পুরো সিলেট বিভাগের মধ্যে কালা পহাড় হল সব চাইতে উঁচুতম চূড়ার পাহাড়। স্থানীয়রা এই পাহাড়কে লংলা নামেও ডাকে। চূড়া থেকে চারপাশের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সরেজমিনে দেখা ছাড়া লিখে বুঝানো দায়। ইচ্ছে থাকতেও টাইগার জোঁকের যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ অবস্থান করা গেলো না। তাই ছুটলাম এবার ভিন্ন পথে। ফেরার পথেই দেখে নিব কালা পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা দীর্ঘতম ঝিরিপথ।

 

এবারের পথটা যেনো আরো বেশি রোমাঞ্চকর। কিছুদূর যেতেই দেখি অল্প সময় আগেই রেখে যাওয়া হাতির তান্ডব। কচি বাশঁ ঝাড়গুলো পুরাই লন্ডভন্ড। গাইড আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে, সে এগিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি আচঁ করে। সেই ১২ বছর বয়স হতেই কালা পাহাড়ে গাইডের বিচরণ। অপেশাদার হবার দরুণ অফিসিয়াল তথ্য তেমন দিতে না পারলেও, কালা পাহাড়ে থাকা জন্তু জানোয়ারের চরিত্র চেনায় বেশ পটু। গাইডের গ্রিন সিগনাল পেয়ে আগাতে থাকি। জঙ্গলি পথ। ভুল হলেই সোজা ভিনদেশে। পাহাড়িদেরও মনে হয় এপাশটায় যাতায়াত তেমন নেই। যেতে যেতে ঝিরির দেখা মিলে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ক্লান্তি দূর করি। পাহাড়ি ঝিরির পানিতে অবিশ্বাস্য রকমের এক শক্তি রয়েছে। ক্লান্তি যতোই ভর করুক না কেন, পানি দিয়ে চেহারাটা ধুয়ে দিলে নিমিষেই সব শেষ। হাঁটতে হাঁটতে ছোটখাটো একটি ঝর্ণার দেখা মিলে। পানি খুব বেশি ছিলো না। কিন্তু গা ভিজাতে আলস্য করিনি। এরপর টানা প্রায় দুই ঘন্টা হাইকিং/ট্র্যাকিং করে ঝিরি ও বুনো পথে আজগারাবাদ পৌঁছি। যারা কালা পাহাড় আরো বেশি ট্র্যাকিং করতে চান তারা আজগরাবাদ হয়ে, পার্শ্ববর্তী উপজেলা জুড়ীর ফুলতলা দিয়ে প্রস্থান করতে পারেন। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একই অঙ্গে বহুরূপের নয়নাভিরাম প্রকৃতির ঝাঁপি, সৌন্দর্যের আধার কালা পাহাড় তার আপন রূপের ডালি মেলে ধরে রেখেছে।

যাবেন কিভাবেঃ ঢাকা হতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া চলাচল করে। সেখান হতে সিএনজি’তে রবির বাজার হয়ে আজগরাবাদ। অথবা পাশেই বেগুনছড়া পুঞ্জি হয়েও যাওয়া যাবে। 

থাকা-খাওয়াঃ রাতে রওনা হয়ে দিনে দিনে ঘুরে চলে আসা যাবে। আর রাতে থাকতে চাইলে রবির বাজার সাধারণ মানের বোর্ডিংএ থাকা যাবে। খাবারের জন্য গাইডের হেল্প নিতে পারলে হোমমেড মিলে যেতে পারে। এছাড়া আজগরাবাদ তেমন ভালমানের রেষ্টুরেন্ট নেই। 

টিপস
# জোঁক প্রতিরোধের জন্য গুল নিতে পারেন। 
# শুকনো খাবার সঙ্গে নিবেন 
# পাহাড়ে দলবদ্ধভাবে থাকতে হবে
# ভালোমানের ট্র্যাকিং সেন্ডেল নিতে হবে।
# অবশ্যই প্রয়োজনীয় মেডিসিন নিতে ভুল করবেন না যেনো।

ছবির ছৈয়ালঃ দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
 
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)