দারিদ্র্য দূরীকরণে নোবেলজয়ী ত্রয়ী অর্থনীতবিদই এখন বিতর্কিত

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষা ও স্মার্ট বাংলাদেশের বাস্তবতা

ড: মিহির কুমার রায়: ভুমিকা: বাংলাদেশে নুতন সরকার তাদের নির্বাচনী ইসতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন যার একটা গুরুত্বপুর্ণ উপাদান হলো স্মার্ট অর্থনীতি, যেখানে কৃষি, বন, পরিবেশ, জলবায়ু একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মান সরকারের একটি সুদুরপ্রসারি স্বপ্ন রয়েছে যা ২০৪১ সালে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সুন্দরবনের বৃহদাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি। আমরা যদি বর্তমান সময় থেকে শুরু করি তাহলে দেখা যায় যে বেচে থাকার জন্য প্রকৃতির উপর আমরা নির্ভরশীল এবং সুন্দরবন অক্সিজেন ও কার্বনের এক সুবিশাল ভান্ডার। প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সুন্দরবন স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু আমরা তাকে কতটুকু রক্ষা করতে পেড়েছি তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সারাদেশে বনভূমি যেখানে ২৫% থাকার কথা তা এখন ১০% এর নিচে নেমেছে যা এক মহা বিপদসংকেত বলে বিবেচিত। সংরক্ষিত বনাঞ্চল মধুপুরের গড় ও ভাওয়ালের গড় সহ বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এখন হুমকির মধ্যে পরেছে যা রক্ষায় এখনই ভাবনার সময়।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র
বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ সুন্দরবন। এটি বিশ্বের অন্যতম  লবণাক্ত বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ বন)। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবনকে বৈচিত্র্যময় করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত  সামুদ্রিক স্রোতধারা ও কাদা চর। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ অবদান রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে। ‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ  বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। এছাড়া সরকার প্রতিবছর এ বন থেকে  মোট বনজ রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করে। সুন্দরবন গড়ে  উঠেছে বাংলাদেশের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বদ্বীপ অঞ্চলে। ফলে বদ্বীপ অঞ্চলের গঠন প্রক্রিয়া প্রভাব বিস্তার করে সুন্দরবনের ওপর। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয় এ বনের নদী-খাল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জোয়ারের  চেয়ে চলমান সময়ে ভাটার স্থায়িত্ব দীর্ঘ সময় থাকে। এছাড়া পলি জমে জায়গা ভরাট হওয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অবশ্য নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ নদীর আন্তঃসংযোগমূলক প্রকল্পগুলোর দায়কে অস্বীকার করা যায় না। এ নাব্য সংকট আগামীতে আগুনের ঘটনা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ বনের চারপাশে মানুষের বসতি। ফলে বন উজাড়ের নজিরও  কম নয়। নগরায়ণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, বনসম্পদের (কাঠ, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি) অতি আহরণ বিপন্নতার দিকে ঠেলে  দিয়েছে সুন্দরবনকে। এছাড়া নৌ পরিবহন ব্যবস্থার ত্রুটি এ সংকট আরো গভীর করেছে। সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদীতে জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেস ওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত করে এবং বনের জলজ প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে। এছাড়া পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হলে সেখানে মানুষ দখলদারত্বের মাধ্যমে বসতিসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছে।

সুন্দরবনে আগুন: একটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের চারটি  রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে না, লাগানো হয় তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র  প্রতিক্রিয়া। বনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবার করা হয় তদন্ত কমিটি। তবে বনের সুরক্ষায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো থেকে যায় ফাইলবন্দি। বন বিভাগের হিসাব মতে, কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ২৩ বার লাগা আগুনে পুড়েছে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি। সর্বশেষ এবারকার আগুন লাগার ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। এখনো সুন্দরবনে জ্বলছে আগুন। গত রোববার ৫মে রাত ১টা পর্যন্ত শুধু বন বিভাগের লোকজন আগুন নিয়ন্ত্রণে পাম্পের মাধ্যমে পানি দেয়। প্রধান বন সংরক্ষক রোববার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে দুটি টিম করে রাতেও আগুন লাগার স্থানগুলোতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। সোমবার ৬ই মে সকাল ৭টা থেকে বন বিভাগের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস অন্যান্য বাহিনীর লোকজন অতিরিক্ত সতর্কতার অংশ হিসেবে যেসব স্থানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে সেখানে পানি দিচ্ছে। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক জানান, রাতে ভালো আগুন দেখা যায়, তাই আগুন দেখে দেখে পানি দেওয়ায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে সুন্দরবনের আগুন। এখন পর্যবেক্ষণে রেখে আরও দু’একদিন পানি দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য যে সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় আগুনের সূত্রপাত হলে দুই কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো আকাশপথে হেলিকপ্টারে করে পানি ছিটানো হয়। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা জানান, আমরবুনিয়া এলাকার গহিন বনে অগ্নিকান্ডর কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ জানতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষককে প্রধান করে ধানসাগর ও জিউধরা স্টেশন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি সাত কর্ম দিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করবে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের পর এ কমিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। 

বনে আগুন লাগার বিষয়ে জানতে চাইলে শরণখোলা সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বলেন, সুন্দরবনের যে স্থানে আগুন  লেগেছে তা লোকালয় থেকে অনেক দূরে। ধারে কাছে কোনো বসতি নেই। বনের ওই স্থানে বিভিন্ন গাছে মৌচাক আছে এবং  মধু সংগ্রহের জন্য সেখানে মৌলদের যাতায়াত রয়েছে। তবে সঠিক কি কারণে আগুন লেগেছে তা বলা মুশকিল। তবে এর  আগে বনে মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য মশাল থেকেও বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।   সুন্দরবন নিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন সুন্দরবন সাংবাদিক ফোরামের সদস্য সচিব শেখ আহসানুল করিম। তিনিবলেন, বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের সুবিধার্থে আসাধু জেলেরা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে বনের বিভিন্ন  স্থান ফাঁকা করে ফেলে। পরবর্তী সময় তারা ওই স্থানে জাল পেতে মাছ ধরে। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট হলেও কার্যকরী  কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শুধু আগুনেই পুড়ছেনা সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে এক শ্রেণির চক্র। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অগ্নিকান্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা  হয়। এ তিনটি সুপারিশ হলো সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী খাল খনন, অগ্নিকান্ড প্রবণ এলাকার প্রতি  দুই কিলোমিটার পর পর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং  ভোলা নদীর পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশি দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে সেফ দ্যা ফাউন্ডেশনের  চেয়ারম্যান বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয় সংলগ্ন নদী খাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা  নিতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বলেন, এ আগুন লাগার দায়ভার কোনোভাবেই বন  বিভাগ এড়াতে পারেনা। আগুন লাগার জন্য দায়ী অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তারা। অদক্ষ মৌয়ালদের কারণে এ আগুন লেগেছে। এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও সরকারকে আরও উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়,  গত ২২ বছরে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় কোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেনি। সর্বশেষ সহ ২৬টি অগ্নিকান্ডের সবকটি   ঘটেছে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায়। এতে সরকারি হিসাবে প্রায় ৭৫ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। প্রথমে ২০০২ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের কটকা ও নাঙ্গলী এলাকায় আগুন লাগে। ২০০৫ সালে পচা কুরালিয়া ও গুটাবাড়িয়া সুতার খাল এলাকায়  দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমরবুনিয়া, খুরিয়াখালী, পচাকুড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচ বার, ২০০৭ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিন বার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১১ সালে নাঙ্গলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে, ২০১৬ সালে পচাকুড়ালিয়া, নাঙ্গলী ও তুলাতলায় তিন বার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসার সিলা এলাকায়, ২০২১  সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগার, ৩ মে শরণখোলা দাসের ভাড়ানি ও ৫ই মে একই এলাকায় আবারও আগুন লাগে। সর্বশেষ গত চাঁদপাই রেঞ্জের আমারবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে, যা এখনো জ্বলছে। এর আগে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনায় কারণ হিসেবে বনে মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালদের ফেলে যাওয়া আগুনের কুলী, জেলেদের ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেট, বন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতিশোধমূলক আচরণ, অনাবৃষ্টির খরা দাবদাহ এবং  দুষ্কৃতকারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরার বিষয় রয়েছে বলে বিগত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা যায়। 

গত রোববার ৫ই মে সুন্দরবনে পরিকল্পিত অগ্নিকান্ড বন্ধের দাবিতে আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির সামনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুন্দরবন রক্ষায় আমরা ও পশুর রিভার ওয়াটার কিপারের আয়োজনে মানব বন্ধনে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাদের মতে মানবসৃষ্ট সুন্দরবনের পরিকল্পিত অগ্নিকান্ড বন্ধে বন বিভাগসহ সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।  সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি অঞ্চলে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে।  পরিবেশ কর্মী, সংবাদ কর্মী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং অতীতে সংঘটিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণেই সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া এলাকায় চার বছর পরে আবারও অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলো বলে অভিযোগ করেন বক্তারা। সকাল  ১০টায় মানব বন্ধন চলাকালে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক। সমাবেশে বক্তব্য দেন পশুর রিভার ওয়াটার কিপার ভলান্টিয়ার শেখ রাসেল, স্থানীয় বাপা নেতা ওমর ফারুক, সুন্দরবন রক্ষায় আমরার লাকী বেগম, শহিদুল ফারাজী, মাসুদ প্রমুখ। বক্তারা বলেন, আমুরবুনিয়া এলাকায় দুইদিন আগে থেকে  আগুন জ্বললেও বন বিভাগের উদাসীনতায় আগুন নেভানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগুনে প্রায় তিন-চার একর বনভূমি পুড়ে গেছে। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ,  স্থানীয় জনগণ, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। সুন্দরবনের মধ্যে মুনাফালোভী ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। নীতি নির্ধারণী মহলের কাছে সুন্দরবন আজও গুরুত্বহীন। সভাপতির বক্তব্যে নূর আলম শেখ বন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সমালোচনা করে বলেন, কেবল বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করলে  সুন্দরবনের আমুরবুনিয়ার অগ্নিকান্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে না। তাই এশিয়ার ফুসফুস সুন্দরবনের মানবসৃষ্ট  অগ্নিকান্ডের রহস্য উন্মোচন এবং এ ধরনের জঘন্য কর্মকান্ড বন্ধে বন বিভাগ ও অন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য,  পরিবেশ কর্মী, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক সহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে  তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। 

এ আগুনের বিষয়ে গত রোববার ৫ই মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। তিনি জানিয়েছিলেন, দেশের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের আগুন পুরোপুরি নেভাতে লাগবে আরও দুই থেকে তিনদিন। সিসিএফ বলেন, ‘সাত সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির প্রধান থাকবেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। এ ছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড  ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃত সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা থাকবেন। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তারা ওই প্রতিবেদন সুপারিশসহ জমা দেবেন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে কার্যকরী ব্যবস্থা  নেয়া হবে, তবে প্রাথমিকভাবে অগ্নিকান্ডের কারণ জানতে চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’ তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে বনভূমির পাঁচ একর জায়গা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

সুন্দরবনকে রক্ষা করতে করনীয়
বনকে বাঁচাতে হলে তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি নদী-খালকে দূষণ ও দখলমুক্ত  করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বনের ভেতরে মানুষ কিংবা বনজীবীদের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে বনের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে হবে। বনজীবী ও মৌয়ালদের এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক করতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কেননা তদন্ত প্রতিবেদনে প্রায় উঠে এসেছে তাদের অসচেতনতার দরুন ঘটা অগ্নিকান্ডের ঘটনা। যদিও এ বক্তব্যে দ্বিমত রয়েছে বনজীবীদের। তাদের যুক্তি সুন্দরবনই তাদের জীবিকার সংকুলান করে থাকে। তাই অসতর্ক ও অবহেলায় তাদের ক্ষতি বৈকি লাভ নেই। তাদের যুক্তিও খুব একটা অগ্রাহ্য করা যায় না। বিশেজ্ঞরাও মনে করেন সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের মূলে এর বাইরে অন্য রহস্যও রয়েছে, যা হয়তো উদ্ঘাটন করা সম্ভব না। তদন্ত কমিটি করা হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে। ফলে তাদের তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে বন বিভাগের লোকজন, বিশেষ করে টহল ফাঁড়ি বা স্টেশন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় যুক্ত থাকেন। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের আঁতাত থাকে।

সুন্দরবনের নদী অববাহিকায় যেসব জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হতে পারে সুন্দরবন রক্ষায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সেসব জনগোষ্ঠীকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বনের  ভেতরে মানুষের আনাগোনা কমবে। বনজ সম্পদ আহরণের চাপ কমবে। এতে বন উজাড়ও রোধ করা সম্ভব হবে। অসৎ  ব্যবসায়ীদের রুখতে এ পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে। সারকথা, সুন্দরবনকে বাঁচাতে ও সমৃদ্ধ রাখতে বন  বিভাগকে যাবতীয় সুপারিশ বাস্তবায়নে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। ৬ই মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে  বলা হয়েছে, গত ২২ বছরে ৩২ বার সুন্দরবন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। আমরা দেখছি, সুন্দরবনে অগ্নিকান্ড যেন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৪মে সর্বশেষ সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে চাঁদপাই রেঞ্জে জিওধারা  স্টেশনে আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় আগুন লাগে। প্রায় ৫৫ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ফের যে ক্ষত সুন্দরবনে  সৃষ্টি হয়েছে এর দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এড়ানোর অবকাশ নেই। সর্বশেষ অগ্নিকান্ডে চার একরেরও  বেশি বনভূমি পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রাণ বৈচিত্র্যে যে অভিঘাত লেগেছে তা নিঃসন্দেহে বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। সিডর ও  আইলা-উত্তর গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন না থাকলে ওই দুই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত দেশের আরও বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে পড়ত। দুটি ঘূর্ণিঝড়ই সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল বটে, কিন্তু এই বনের কারণে জনপদে অনেক জীবন রক্ষা  পেয়েছিল। এভাবেই বার বার নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রকৃতি ও জীবনকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবন। সর্বশেষ অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সদস্যদের অক্লান্ত প্রয়াসের জন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বার বার সুন্দরবন অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে? পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তরফে যে বক্তব্য মিলেছে তা বরাবরের মতোই গৎবাঁধা। দূর অতীত বাদ দিলেও ২২ বছরে সুন্দরবনে ৩২ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা সংগতই প্রশ্ন দাঁড় করায়, এত দুর্যোগের পরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সংবিৎ ফিরছে না কেন? আর গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন ৪০ বার অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই জানা যায়, সুন্দরবনের অগ্নিঝুঁকি কিন্তু বিস্ময়কর হলো, কোনো সুপারিশই আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা জানি, জাতীয় জীবনে আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়া এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার অনেক নজির রয়েছে। কিন্তু শ্যামনগরের হাজার হাজার স্বতঃপ্রণোদিত মানুষের ‘বন বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করবো, সুন্দরবন নিরাপদ  রাখবো’ - এই উচ্চারণের প্রতিপালনে তারা যথেষ্টই ভূমিকা রেখেছেন। গবেষণায় এও উঠে এসেছে, প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষা শুধু কয়েক হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয় নয়, সুন্দরবন গোটা বাংলাদেশ, উপমহাদেশ তথা বিশ্বের পরিবেশের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য রক্ষাকবচ। আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, এর অগ্নিঝুঁকি নিরসনে অতীতে এতবার সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি কেন? অভিজ্ঞতা বলে, আবারও তদন্ত হবে, সুপারিশ উপস্থাপিত হবে এবং এক পর্যায়ে সবকিছুই চলে যাবে হিমঘরে! আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এই রূঢ় বাস্তবতায় সুন্দরবনের মতো অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রাণ প্রকৃতির ওপর অভিঘাত সৃষ্টি করে অদূরদর্শী কর্মকান্ড বন্ধে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে সুন্দরবন ঘিরে সরকারের গভীর মনোযোগ জরুরি। 

সুন্দরবনের ঝুঁকি নিরসনের সর্বাত্মক চেষ্টা কালবিলম্ব না করে জোরদার করা জরুরি। সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে,  আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে। এই বন যেহেতু বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষা দানে  ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)