মিহির স্যার

বাজেট ভাবনা

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে দারিদ্রের হার বাড়বে

ড. মিহির কুমার রায়: আগামী বাজেটে প্রাথমিকভাবে ১২ ধরনের পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বসানো হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভাষায় যা স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট রেট। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভ্যাটের হার হবে ১৫ শতাংশ (যেসব পণ্যের জন্য নির্ধারণ হবে)। যে কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে ভ্যাটের অভিন্ন হারের মতো কয়েকটি খাতে ভ্যাট অব্যাহতিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আয়কর, শুল্ক খাতসহ রাজস্ব অব্যাহতি সুবিধা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে। রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে এনবিআর। এর ফলে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাকে।

এদিকে কর ছাড় সীমিত করতে এনবিআরের ওপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ আছে। অভ্যন্তরীণ আয়ের খাতকে শক্তিশালী  করতে সরকারেরও চেষ্টা আছে। এ দুই কারণে বিভিন্ন উৎস থেকে বাড়তি কর আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে আসছে বাজেটে। গাড়ি আমদানিতে খরচ বাড়বে সংসদ সদস্যদের (এমপি)। তবে করপোরেট কর ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত উৎপাদনশীল খাতের প্রতিষ্ঠানের কর কমানো হতে পারে। আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, এনবিআরের আগামী বছর ভ্যাট আদায় করার লক্ষ্য রয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় যা ২৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা বেশি। এই টাকা কী উপায়ে আদায় করা হবে, তার একটি আউটলাইনও এনবিআর সংস্থাটির কাছে পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভ্যাট অফিসের নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে রাজস্ব আয় ১১.৬ শতাংশ বাড়তে পারে, যার পরিমাণ হবে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকিটা, অর্থাৎ ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যবস্থা গ্রহণ করে আদায় করা হবে। ভ্যাট বিভাগ আশা করছে, বাড়তি ভ্যাট হিসেবে তারা ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে পারবে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা সিগারেট কর ব্যবস্থা পুনর্গঠনের মাধ্যমে আদায় করা হবে। ট্রেডিং পর্যায়ে ইলেক্ট্র্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস সিস্টেমের যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে এ খাত থেকে বাড়তি ৯৫০ কোটি টাকা আয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভেদে ৩, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। আগামী অর্থবছরে অনেক পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কর অব্যাহতি অথবা হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কিছু ইলেক্ট্রনিকস পণ্য। আগামী বাজেটে এগুলোর ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআর। এর মধ্যে রেফ্রিজারেটর, এসি, মোবাইল ফোন ও এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া চিনিযুক্ত কিছু জুসের ওপর ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। জুস প্রস্তুতকারকদের বার্ষিক বিক্রি বা টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম করের হারও বাড়তে পারে। এ ছাড়া ভ্যাটের চাপ আসছে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুলের ওপরও। নিম্ন থেকে উচ্চমানের প্রতিটি সিগারেটের মূল্যস্তর বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। বর্তমানে রেফ্রিজারেটর উৎপাদক পর্যায়ে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ, মূল্য সংযোজনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে তা ২ থেকে ৭.৫ শতাংশ এবং বিক্রয় পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ। রেফ্রিজারেটর ও মোবাইল হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে দুই শতাংশের বেশি ভ্যাট বাড়ানো হতে পারে। এলপিজি সিলিন্ডারেও ভ্যাট সামান্য বাড়ানো হতে পারে। অন্যদিকে তামাকজাত পণ্যে মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক আরও বাড়ানো হতে পারে। এদিকে ২০২২ সালে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলে প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। আইএমএফের অন্যতম শর্ত ছিল রাজস্ব আহরণ বাড়াতে অব্যাহতি তুলে দিতে হবে। তাই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে যাচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নতুন করে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা না দেওয়ার নির্দেশনা আছে সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘আমরা চাই একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট। আশা করি, সরকার সেইরকম একটি বাজেটই করবে। আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট ঘোষণার আগে এর চেয়ে বেশি কিছু এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ, বাজেটের অনেক কিছু শেষ সময়েও বাদ বা যুক্ত হতে পারে।’ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি আয়কর বাড়ানোর জন্য। ভ্যাটের ভার যেহেতু সবার ওপরে যায়, এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে- এ জন্য ভ্যাট না বাড়ানোর জন্য বলে আসছিলাম। কিন্তু এনবিআর আমাদের কথা শুনছে না। তিনি আরও বলেন, মানুষ এমনিতেই গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছে, যার ফলে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এর মধ্যেও অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে সরকার ভ্যাট হিসেবে বাড়তি টাকা আদায় করেছে। নতুন করে আবার ভ্যাটের চাপ দেওয়া হলে তা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য অসহনীয় হবে। রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে এনবিআর। এর ফলে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাকে। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তা ৬৯.৩৫ টাকার কথা বলতে পারবেন। ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপরে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রথমে পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলেও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে তা কমিয়ে তিন শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর দুই বছর পর সম্পূরক শুল্ক তিন থেকে বাড়িয়ে আগের পাঁচ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে এটি ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আগামী অর্থবছর থেকে এমপিরা গাড়ি আমদানি করলে ২৫ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। এর পাশাপাশি এমপিদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এতদিন হাইটেক পার্কের জন্য আমদানি করা গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে এসেছে। এবার সেখানেও শুল্ক আরোপ করা হবে। হাইটেক পার্কের শুল্ক হার নির্ধারণ করা না হলেও তা এমপিদের ওপর আরোপিত শুল্ক হারের চেয়ে বেশি হবে।

এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগামী অর্থবছর থেকে নতুন করে আর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হবে না। এ ছাড়া বর্তমানে যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে, তা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে। এবারও শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, আগের মতো উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারে তালিকা বহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে। এ জাতীয় কোম্পানির কর ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। বাকি সব খাতের কর অপরিবর্তিত থাকছে। তবে, খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শর্তের বেড়াজালে বন্দি থাকায় করপোরেট কর কমানোর সুবিধা শিল্প খাত ভোগ করতে পারবে না। শিল্পের জন্য প্রয়োজন শর্তহীন কর হ্রাসের সুবিধা। এনবিআরের সুত্র মতে, বিভিন্ন ধরনের ২৭টি খাতে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা বর্তমানে কর অবকাশ সুবিধা পায়। এই কর অবকাশ সুবিধা আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আইএমএফের শর্ত হলো, এসব খাতের কর অবকাশের মেয়াদ আর না বাড়ানো। এনবিআর অন্তত ১২টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা তুলে দিতে পারে। এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য বলেন, ‘নতুন সরকারের এটি প্রথম বছর। যে কোনো ধরনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হলে প্রথম বছরেই নিতে হয়। বিভিন্ন পদক্ষেপ বা সংস্কারগুলো এ সময়ে করতে পারলে ভালো। পরের বছরগুলোতে নানা বিষয় সামনে আসে। তখন রাজস্ব সংক্রান্ত সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া একটু কঠিন। সুতরাং রাজস্ব বাড়াতে হলে কঠিন সিদ্ধান্তগুলো এ বছরই নেওয়া উচিত।’

উল্লেখ্য, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। তার  পরও আশা করা যায় আগামী বাজেট মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমানে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। 

* লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)