বাংলাদেশের বাজেটের ক্রমানোগতিক ধারায় চলতি বাজেট
ড: মিহির কুমার রায়:-
ভুমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৩টি বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ৫৩টি বাজেট ১২ জন ব্যক্তি উপস্থাপন করেছেন। এদের মধ্যে একজন রাষ্ট্রপতি, ৯ জন অর্থমন্ত্রী ও দুইজন অর্থ উপদেষ্টা। গত বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য ‘সুখী সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’। এটি হবে দেশের ৫৪তম বাজেট এবং তিনি হবেন বাজেট উপস্থাপনকারী ১৩তম ব্যক্তি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০ জুন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। আর সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২০২৩ সালের ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন। এটি ছিল দেশের ৫৩তম বাজেট। এবার ৫৪তম বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ৫৩ বছরের ব্যবধানে দেশের বাজেটের আকার বাড়ছে ১০১৩.৮৬ গুন (উৎস্য অর্থ মন্ত্রণালয়)।
কে কতটি বাজেট দিয়েছেন:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ৫৩টি বাজেট ১২ জন ব্যক্তি উপস্থাপন করেছেন। একজন রাষ্ট্রপতি, ৯ জন অর্থমন্ত্রী ও ২ জন অর্থ উপদেষ্টা এসব বাজেট পেশ করেন। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২টি করে বাজেট দিয়ে যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছেন বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান, আওয়ামী লীগ ও এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত। মুহিত এরশাদ সরকারের আমলে দুটি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১০টি বাজেট দিয়েছেন। এছাড়া অর্থমন্ত্রী এ এম এস কিবরিয়া ছয়টি, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচটি বাজেট উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান চারটি, বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ তিনটি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তিনটি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও এম এ মুনিম দুটি করে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে ড. মীর্জা নুরুল হুদা, ড. এ আর মল্লিক, ড. ওয়াহিদুল হক, ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ প্রত্যেকে একটি করে বাজেট দিয়েছেন। সর্বশেষ দেশের ৫৪তম বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট।
নির্বাচনি ইশতেহার ও আগামী বাজেট:
এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে আমাদের মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের সময় এ বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো: দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংক সহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা; এবং সব স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। এবারের বাজেটের বৈশিষ্টগুলো হলো: প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভাতা বাড়ছে সিগারেটসহ তামাক পণ্যের দাম বাড়ছে; মা ও শিশু সহায়তা কার্যক্রমের আওতা বাড়ছে; কৃষিতে বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা; স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের দাম স্থির থাকবে; ডেঙ্গু নমুনা পরীক্ষার কিট আমদানিতে লাগবেনা কর, মোবাইলে ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেটে খরচ বাড়ছে; রিটার্ন দাখিলের সময় এক মাস বাড়াতে পারবে এনবিআর; স্থানীয় ও পল্লী উন্নয়নে বরাদ্দ কমছে দেড় হাজার কোটি টাকা, দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেট পেশ করতে সংসদে অর্থমন্ত্রী।
বাজেট ২০২৪-২৫: একটি সংখ্যাতাত্বিক বিশ্লেষন:
এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম করা হয়েছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। এটি হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলো, সেই লক্ষ্য পূরণকে সর্বাগ্রে জোর দেয়া হয়েছে আগামী বছরের বাজেটে। এবারকার বাজেট পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটে অগ্রাধিকারে দেয়া হয়েছে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে, নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে এবারে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হলো ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ফলে আগামী বাজেটের আকার চলতি বাজেট থেকে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা বা চার দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ১৭৪ টাকা। একইভাবে আয় বেড়েছে ২ হাজার ৬৭৪ টাকা। তবে মাথাপিছু ঘাটতি কমেছে ৫৯৯ টাকা। আর প্রতি জনে বরাদ্দ ৪৬ হাজার ৯৩৭ টাকা। তবে বাজেটে মোট যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এবার জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে মোট আয় ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩২ হাজার ১২০ টাকা। চলতি বছরে যা ছিল ২৯ হাজার ৪৪৬ টাকা। এ হিসাবে আয় বেড়েছে ২ হাজার ৬৭৪ টাকা। আগে যা ছিল ২ হাজার ৬৬৯ টাকা। এছাড়াও ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু ঘাটতি ১৪ হাজার ৮১৭ টাকা। অন্যদিকে এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর মাথাপিছু বরাদ্দ ১৫ হাজার ৬১৬ টাকা। আগের বছর যা ছিল ১৫ হাজার ৪৮৮ টাকা। তার আগের বছর যা ছিল ১৫ হাজার ২১৭ টাকা। আলোচ্য সময়ে মাথাপিছু এডিপি বেড়েছে ১১৮ টাকা। চলতি বছরে বেড়েছিল ২৭১ টাকা। এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বৈদেশিক উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সংস্থান করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ধরা হয়েছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। টাকার অংকে যা ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। বাস্তবতা বিবেচনা করে আগামী অর্থবছরে বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
খাতওয়ারি বরাদ্ধ (এডিপি):
সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে। এর বাইরেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন আছে ১৩ হাজার ২৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ধরলে নতুন এডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্প থাকছে এক হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ১৩৩টি, কারিগরি সহায়তার ৮৭টি এবং সমীক্ষা প্রকল্প রয়েছে ২১টি। মোট প্রকল্পের মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি থেকে স্থানান্তর হবে ১ হাজার ২৭৭টি প্রকল্প। বাকিগুলোর মধ্যে নতুন অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে ৬০টি। এছাড়া আগামী অর্থবছরের এডিপিতে নতুন কিন্তু অনুমোদনহীন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৮৯৪টি, বৈদেশিক অর্থায়নের সুবিধার্থে অনুমোদনহীন নতুন ২৫৭টি প্রকল্প এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) প্রকল্প থাকবে ৮০টি। এডিপিতে নতুন এডিপির আকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ২ হাজার কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। এছাড়া সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৮ হাজার ৮০৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এদিকে সবচেয়ে কম বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত হলো প্রতিরক্ষা। এখানে ধরা হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। এডিপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৮৬ লাখ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষা খাত ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অন্যান্য খাতের বরাদ্দ হচ্ছে-গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি ২৪ হাজার ৮৬৮ কোটি ৩ লাখ, স্বাস্থ্যে ২০ হাজার ৬৮২ কোটি ৮৮ লাখ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি ২১ লাখ এবং কৃষি খাতে ১৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। আরও আছে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৬ হাজার ৪৯২ কোটি ১৮ লাখ, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ৪ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯২ লাখ, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে ৩ হাজার ৪৯২ কোটি, সামাজিক সুরক্ষায় ৩ হাজার ৩০৪ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় ৩ হাজার ৩০৮ কোটি এবং সাধারণ সরকারি সেবা খাতে দেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ: আগামী অর্থবছরের এডিপিতে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে ৩২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ বিভাগ ২৯ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ হাজার ১৩৫ কোটি, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৩ হাজার ৭২৫ কোটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। আরও আছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১১ হাজার ৩৮৭ কোটি, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা।
বাজেট ও শেয়ারবাজার:
প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে-এমন কোম্পানিগুলোর আয়করের হার ২৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। তবে শর্ত পরিপালন করলে তা সাড়ে ২২ শতাংশ। এক্ষেত্রে ভাষাগত পরিবর্তন ছাড়া সবকিছুই আগের মতো। উলটো অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর কমানো হয়েছে। এছাড়াও শেয়ার তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর বর্তমান কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে তা ৩০ শতাংশ। প্রস্তবিত বাজেটে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। কিন্তু পালন করলে তা ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর মানে হলো, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার প্রায় সমান। এতে নতুন কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত হবে না। কোম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। আগে কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা কাউকে শেয়ার দিতে চাইলে ৫ শতাংশ কর দিতে হতো। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে কেউ ছেলে মেয়ে সহ পরিবারের সদস্যদের শেয়ার দিতে চাইলে কর দিতে হবে না। এদিকে শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্টরাও প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে নারাজ। অন্যদিকে সমবায় সমিতির কর ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
উপসংহার:
মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি জিডিপি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবনা সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির নানা সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় এই বাজেটটি রাখা হয়েছে সংকোচনশীল ধরনের। এই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট প্রণয়নে মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি, পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ— এই ছয় চ্যালেঞ্জ প্রত্যক্ষ বিবেচনায় নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপযোগী বাজেটই প্রণয়ন করেছেন তিনি। কেবল ২০২৪-২৫ অর্থবছর নয়, ২০২৬-২৭ অর্থবছর পর্যন্ত তিন অর্থবছরের জন্য মধ্যমেয়াদে সরকারের সামনের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা থাকতে পারে, সেটিও বিবেচনায় নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মধ্যমেয়াদি এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়েই নির্ধারণ করেছেন মধ্যমেয়াদি নীতিকৌশল। সে অনুযায়ীই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে মধ্যমেয়াদি সাতটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতির কথা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন বাজারে বিরাজমান উচ্চ সুদের হারকে। কারণ এই উচ্চ সুদহার বিনিয়োগের গতি শ্লথ করে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যমেয়াদি তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি কর-জিডিপি অনুপাত, যেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম। ব্যাংকিং খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনাকে পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতকে মধ্যমেয়াদের ষষ্ঠ ও সপ্তম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মধ্যমেয়াদি নীতি বিবৃতিতে। মন্ত্রীর আশাবাদ, এসব নীতি কৌশলের সুফল হিসেবে আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা মধ্যমেয়াদে (২০২৬-২৭ অর্থবছর) এটি বেড়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে বলেছেন, উন্নত বিশ্বের উচ্চ সুদের হার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। এসব দেশে উচ্চ সুদহার সামনেও অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো কঠিন হতে পারে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে সাময়িকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসী ভোগ্য পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, নন-পারফর্মিং ঋণ ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু ব্যাংক একত্রীকরণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়াটির সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বাজারের অস্থিতিশীলতা বড় একটি কারণ। এর বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ হিসেবে ক্রলিং পেজ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে রফতানি উৎসাহ পাবে, অফিশিয়াল চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়বে। আর্থিক হিসাবে এখনো ঘাটতি থাকলেও তা মধ্যমেয়াদে কমে আসবে। আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়তে শুরু করবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কিছু সুবিধা কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে রফতানি বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের ওপর গুরুত্বারোপ করার কৌশল নেবে সরকার। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে পারে উল্লেখ করে এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সঠিক বিশ্লেষণে গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা ও কর ফাঁকির ক্ষেত্র দূর করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি করজাল সম্প্রসারণের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। মধ্যমেয়াদে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ জিডিপির ১০ শতাংশে উন্নীত করতেও কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সংকোচনমূলক পদক্ষেপের উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণের পাশাপাশি সহায়ক রাজস্ব নীতি, অর্থাৎ ব্যায় কমানো ও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিরুৎসাহিত করাসহ বিভিন্ন কৃচ্ছ্বসাধন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী বাজেটে বাজেট ঘাটতি কমানো ও সীমিত কলেবরে হলেও কৃচ্ছ্রসাধন অব্যাহত রাখবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ কৌশলে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে বলে আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি ব্যয় ধীরে ধীরে বাড়ানোর লক্ষ্য থাকবে। মধ্যমেয়াদে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্ভাবনাও দেখছেন অর্থমন্ত্রী। নীতি বিবৃতিতে সুনির্দিষ্টভাবে ৯টি সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদ দেখছেন তিনি। এগুলো হলো কৃষি ও শিল্প উৎপাদন শক্তিশালী থাকবে এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে; উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি মধ্যমেয়াদে স্থিতিশীল থাকবে, যা বাংলাদেশের রফতানি বাড়াতে সহায়তা করবে; সম্প্রতি গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে; বিশ্বব্যাপী পণ্যের মূল্যহ্রাস ও দেশীয় বাজারে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার কারণে মধ্যমেয়াদে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমবে; মূল্যস্ফীতি কমার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগব্যয় বাড়বে এবং এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে; মূল্যস্ফীতি ও বিনিময়হার স্থিতিশীল হওয়ার কারণে আমদানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে; বিশ্বজুড়ে নীতি সুদের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং মধ্যমেয়াদে তা কমে আসবে। এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের কারণে কর রাজস্বের প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চার হবে; এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা সত্বেও রফতানি ও প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা মধ্যমেয়াদে চলমান থাকবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নত, টেকসই ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নই এই বাজেটের খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও মধ্যমেয়াদি নীতি কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু। এ কৌশলের অধীনেই প্রস্তাবিত বাজেটের আকার করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে মাত্র ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ ও সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//