Mihir Roy

মতামত/বিশ্লেষণ

অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করতে হবে

ড. মিহির কুমার রায়ঃ দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। জিডিপিতে এই খাতের অবদান ২০ শতাংশ। যদিও তুলনামূলক বিচারে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় কম রয়েছে। যেমন- ভারতের জিডিপির ৮৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, পাকিস্তান ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ১১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, নেপালের ৭০ দশমিক ০১ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ার ১৪২ দশমিক ২৪শতাংশ। যদিও আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে এটিকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের পুঁজিবাজার যত বেশি গভীরতম, সে দেশের অর্থনীতি তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন পুঁজিবাজারের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেকটাই গতিশীল ও স্থিতিশীল। এর কারণ বাজার মূলধন অনেক বেড়েছে, এখানে নতুন নতুন প্রোডাক্ট যুক্ত হয়েছে, স্বল্প মূলধনী কোম্পানির জন্য আলাদা প্লাটফর্ম করা হয়েছে, পৃথক বন্ড মার্কেট চালু করা হচ্ছে, গ্রীন বন্ড চালু করা হয়েছে, বাজারের পরিধি বাড়াতে দেশ-বিদেশে মার্কেটিং করা হচ্ছে, পুঁজিবাজারকে বিস্তৃত করতে তৃণমূলে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ডিজিটাল বুথ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক আইন-কানুন করা হয়েছে, বাজারে এখন বিপুল পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করছেন। বাজারকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যেতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

 

এখন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিনিয়োগ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ আসে পুঁজিবাজার থেকে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের তুলনায় বাংলাদেশের এ বাজার অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হলেও গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের ফলে পুঁজিবাজার ও বাজার মূলধন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সকল সূচক ইতিবাচক হওয়ায় পুঁজিবাজার বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে যদিও মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন অথবা জিডিপি অনুপাত তুলনামূলক বিচারে অনেক কম রয়েছে যেমন বাংলাদেশ ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ, পাকিস্তান ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৫২ দশমিক ২ শতাংশ, জার্মানী ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ , ভারত ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যুত্তরাজ্য ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ, কানাডা ১৪৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং আমেরিকা ২৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। পুঁজিবাজারে পণ্যসমূহকে একত্রে সিকিউরিটিজ নামে অভিহিত করা হয় যার মধ্যে কোম্পানী কর্তৃক ইস্যুকৃত শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ড সমন্বিত বিনিয়োগ স্কীমে ইউনিট, সম্পদ ভিত্তিক সিকিউরিটিজ, শরীয়তভিত্তিক সিকিউরিটিজ (সুকুক) ইত্যাদি রয়েছে। এসব সিকিউরিটিজ এর মাধ্যমে যে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনে বাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারে যার ব্যাপকতা আর্থিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। আবার প্রাইমারী/সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে একই ধরনের সিকিউরিটিজ ইস্যু করে অর্থ উত্তোলন করা যায়। উৎপাদনমুখী শিল্পে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে নয়, পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন করতে হবে, বড় বড় অবকাঠামোগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে এসব প্রকল্পের উন্নয়নে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য একমাত্র পুঁজিবাজারকেই মূল অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে জানান দিতে হবে, তাদের ভয়ভীতিমুক্ত পুঁজিবাজার উপহার দিতে হবে, তাদের পুঁজির নিশ্চয়তা দিয়ে বাজারমুখী করতে হবে। এ কারণে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা যেমনভাবে হ্রাস পাবে- তেমনি পুঁজিবাজারের বিস্তৃতিও বাড়বে, সহায়ক নীতি সহায়তা ও কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজারের যে অমিত সম্ভাবনা তাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।

 

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে পুঁজি বাজারের তারল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে গতিশীল করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আইনের অনুশাসন পরিপালনে নজরদারির সঙ্গে এ বাজারের কার্যক্রমে মুদ্রানীতি প্রোগ্রামের সঙ্গতিপূর্ণ মাত্রায় তারল্য যোগান বজায় রাখা হয়েছে। পুঁজিবাজারের সমর্থনে বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক অব্যাহত রেখেছে। আগামী দিনগুলোতেও বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মনীতির মধ্যে থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। পুঁজিবাজার ও বীমা খাত নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নীতি সমন্বয় সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে। পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যু না হওয়া কোম্পানীগুলোতে বিদেশী প্রাইভেট ই-কুইটি দেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রির জন্য মূল্যায়নে নিট এ্যাসেট ভ্যালুর পরিবর্তে বাস্তবসম্মত বাজারভিত্তিক মূল্যায়ন গ্রহণীয় হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে নির্দেশনা জারি করেছে।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, করোনাভাইরাস অতিমারীর প্রভাব মোকাবেলায় শিল্প খাতে দেওয়া সরকারের প্রণোদনা টাকার সিংহভাগ পুঁজিবাজারে চলে গেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য মানতে রাজি নয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। তাদের দাবি প্রণোদনার কোন টাকা পুঁজিবাজারে আসেনি। এই সংন্থার বক্তব্য অনেকদিন পর সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশের পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে, পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার গভীরভাবে সম্পৃক্ত। পুঁজিবাজারের বর্তমান গতিশীলতা প্রণোদনার টাকার কারণে হয়নি, এর পেছনে অনেক কারণ আছে যেমন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসির) বর্তমান কমিশনের নানামুখী উদ্যোগের ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে, ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমতে কমতে ৫ শতাংশের এর নিচে নেমে এসেছে। তাই ব্যাংকে আমানত রাখা আর লাভজনক নয় ফলে অসংখ্য মানুষ ব্যাংকে মেয়াদী আমানত না রেখে সেই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। অন্যদিকে নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে এখন চাইলেও নির্দিষ্ট সীমার বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। সেখানে বিনিয়োগের সুযোগ সংকোচিত হয়ে আসায় উদ্বৃত্ত সঞ্চয় পুঁজিবাজারমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদনে প্রণোদনার টাকা পুঁজিবাজারে এসেছে বলে উল্লেখ করেছে, সেখানে কতগুলো প্রতিষ্ঠানের টাকা এসেছে, কত টাকা এসেছে তার কোন নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই, বাজারে ১০ কোটি, ২০ কোটি বা ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের কেউ প্রণোদনার টাকা পাননি। কারণ এদের কারোরই কোন শিল্প-কারখানা নেই। যদি কিছু প্রতিষ্ঠান সত্যিই প্রণোদনার টাকার অংশবিশেষ পুঁজিবাজারে নিয়ে এসে থাকে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, যাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। হার্ড ল্যান্ডিংয়ের পরিবর্তে যেন সফট ল্যান্ডিং হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি আর উদাসীনতার সুযোগে অনেক ব্যাংক পুঁজিবাজারে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল। শুধু ২০১০ সালে নয়, এর পরেও বহুবার বাংলাদেশ ব্যাংককে পুঁজিবাজারের স্বার্থ বিরোধী নানা সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। বছরখানেক আগে তারা ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণা করা টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে বোনাস দিতে উৎসাহ যুগিয়ে গেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ব্যাংকের মালিক এর শেয়ারহোল্ডাররা। তাই ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ দেবে না বোনাস দেবে, মূলধনের আকার কী হবে তা শেয়ারহোল্ডারাই নির্ধারণ করবে। শিল্প-উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে নয়, শিল্পকারখানার জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করবে। আর এটি করার জন্য একটি স্থিতিশীল ও গতিময় পুঁজিবাজার দরকার।

(এসএএম/১২ সেপ্টেম্বর ২০২১)


Comment As:

Comment (0)