মিহির রায়

মতামত/বিশ্লেষণ

এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি উন্নয়নের অন্তরায়

ড: মিহির কুমার রায়ঃ চলমান অর্থবছরের (২০২১-২২) জন্য ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ লাখ টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিগত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০ প্রকল্পে ৫৪ হাজার ৪৫১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূল এডিপির পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রায় ১১ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত ৮৯টি প্রকল্পসহ মোট ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপির মোট আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। বিগত অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বরাদ্দ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা, যার সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা  নিজস্ব অর্থায়নে ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে এডিপি বাস্তবায়ন করবে। সংশোধিত এডিপির মোট আকার ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যান্য বছরের মতো এবারো দেশজ সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস তথা জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা কৌশল এবং লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃজন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন-সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, আইসিটি শিক্ষার উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসন-সংক্রান্ত প্রকল্প, সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক প্রকল্প ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (পিপিপি) বাস্তবায়িত নতুন প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

অনুমোদিত এডিপির ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ ও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন ৮৮ হাজার ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ১১ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন ৬ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৮ লাখ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন ৪ হাজার ৭৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১ হাজার ৪২৬টি প্রকল্পের মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ৩০৮টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৮টি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে ৮৯টি প্রকল্পসহ মোট প্রকল্প ১ হাজার ৫১৫টি।

খাতভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ: ১০টি খাতে ২ লাখ ১০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট এডিপির প্রায় ৯৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে প্রায় ৬১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বা বরাদ্দের প্রায় ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৪৫ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা (২০.৩৬%), গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে প্রায় ২৩ হাজার ৭৪৭ কোটি (১০.৫৪%), শিক্ষা খাতে প্রায় ২৩ হাজার ১৭৮ কোটি (১০.২৯%), স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ১৭ হাজার ৩০৭ কোটি (৭.৬৮%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে প্রায় ১৪ হাজার ২৭৪ কোটি (৬.৩৪%), পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি খাতে প্রায় ৮ হাজার ৫২৬ কোটি (৩.৭৮%), কৃষি খাতে প্রায় ৭ হাজার ৬৬৫ কোটি (৩.৪০%), শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে প্রায় ৪ হাজার ৬৩৮ কোটি (২.০৬%) এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রায় ৩ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা (১.৫৯%)।

মন্ত্রণালয় বা বিভাগভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ: স্থানীয় সরকার বিভাগে ৩৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২৮ হাজার ৪২ কোটি, বিদ্যুৎ বিভাগে ২৫ হাজার ৩৪৯ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ২০ হাজার ৬৩৪ কোটি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ১৩ হাজার কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ১১ হাজার ৯১৯ কোটি, সেতু বিভাগে ৯ হাজার ৮১৩ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৮ হাজার ২২ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ প্রকল্প: সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১০ প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া প্রকল্পের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্পটিতে প্রায় ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্টে প্রায় ৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজার ৫৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ (১ম সংশোধিত) প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার ৮২৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার ২২৭ কোটি ২০ লাখ, এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি এরিয়া প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার ৫১ কোটি ১১ লাখ ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (১ম পর্যায়) (১ম সংশোধিত) প্রায় ২ হাজার ৮২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। নতুন প্রকল্পে থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ও প্রকল্প ঋণ ১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে বরাদ্দবিহীনভাবে অননুমোদিত নতুন ৫৯৬টি প্রকল্প ও বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন ১৪১টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পিপিপি প্রকল্প ৮৮টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৩০ জুন ২০২২-এর মধ্যে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্প ৩৫৬টি। ২০২০-২১ অর্থবছরের আরএডিপিতে জুন ২০২১-এ সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত আরো ৭৩টি প্রকল্প ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

পরিস্থিতি পর্যলোচনায় দেখা যায় যে, চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) দুই মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৩.৫২ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে এ হার ছিল ৩.৮৯ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে ৮ হাজার ৩৫১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন করছে সরকার।

 

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, চলতি অর্থবছরের শুধু আগস্টে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ২.৩৮ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে ৫ হাজার ৬৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরের আগস্টে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২.৩৮ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে ৫ হাজার ৯৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অর্থ্যাৎ গত অর্থবছরের আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছর টাকার অঙ্কে এডিপি বাস্তবায়ন বেড়েছে।

 

পর্যালেচনায় আরও জানা যায়, ‘বছরের শুরুতে উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের টেন্ডার দেয়া হয়। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পেতে কিছু দিন সময় লাগে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে বিল উঠানো শুরু করলেই এডিপি বাস্তবায়ন বাড়তে থাকে। এ জন্য বছরের শুরুতে বাস্তবায়ন হার কম থাকলেও মাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়ন বাড়তে থাকে।

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপির) প্রায় ৮৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে মোট ১১ লাখ ৯৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকার এডিপির বিপরীতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, যা শতাংশ হিসাবে বাস্তায়নের হার ৮৪ দশমিক ৭১ ভাগ। ১০ বছরে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থবছর হিসাবে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপি বাস্তায়ন সবচেয়ে কম ছিল অর্থ্যাৎ এডিপি ৮০.৩৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫৮.৩৬ শতাংশ।

 

সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কারণে চলতি ও বিগত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার কম। তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অন্য অর্থবছরগুলোর বাস্তবায়ন হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। কিন্তু গত অর্থবছরে সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হয়েছে ৭৪ শতাংশের মতো।

২০২০-২১ অর্থ বছরের করোনা কালীন বাজেট বাস্তবায়নের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জর মধ্যে লক্ষ্য কেন্দ্রীক রাজস্ব আহরন, অবকাঠামোগত ঘাটতি, অগ্রধিকারভিত্তিক সরকারি ব্যয় নির্ধারন, ঘাটতি বাজেটের আর্থিক ব্যবস্থাপনায়, বৈদেশিক ঋন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, ব্যাক্তি ঋনের প্রতিবন্ধকতা, রফতানী আমদানী বানিজ্যে সমতা আনয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সঞ্চয় বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, যা একেবারেই দৃশ্যমান। এখন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা রোড ম্যাপ তৈরি, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রকল্পের গুনগত বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করলে অনেক চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

 

এখন প্রশ্নটি হলো- তা কিভাবে সম্ভব?

 

প্রধানমন্ত্রী তার বাজেট সমপনী বক্তৃতায় মহান জাতীয সংসদে বলেছেন, কবোনা মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থের কোনরকম অভাব হবে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা মানেই এর সাথে সংযুক্ত জনশক্তি তথা প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা যা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, যা সরকার অবগত আছে। কিন্তু এর উন্নয়নের গতিধারায় কবে নাগাদ এই সক্ষমতা একটি গ্রহনযোগ্য পর্যায়ে পৌছাবে- তা বলা দুস্কর। কিন্তু দেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে যে গতিতে, তার চেয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির গতি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য প্রশিক্ষণ ও তদারকির কোনো বিকল্প নেই সত্যি। কিন্তু একটি রোড ম্যাপ ধরে আগাতে হবে। প্রায়শই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সক্ষমতা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী ভূক্ত প্রকল্পগুলোর ব্যয় দক্ষতা/ব্যয়ের মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন শোনা যায় বিশেষত; অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে যার ভিত্তিগুলো সরকারকে আমলে নেয়া উচিত। কারণ, রাজস্ব আয়ের আহরণের একটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো এনবিআর যার সাথে সরকারের স্থায়ীত্বশিলতার প্রশ্নটি জড়িত। সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নৈতিক ভিত্তি তথা প্রশাসনিক কাঠামো আরো জোরদার করতে হবে, নতুন নতুন করদাতা সংগ্রহ, উপজেলায় আরও অফিস স্থানান্তর করতে হবে এবং বেশী বেশী কর মেলার আয়োজন নতুন অঞ্চলগুলোতে করতে হবে। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যয়ের মান উন্নয়ন ও অব্যাতত দুর্নীতি প্রতিরোধে উদ্যেগী মন্ত্রনালয়, বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থমন্ত্রনালয়ের অর্থ অনুবিভাগকে উন্নয়নের সহযাত্রী হিসাবে কাজ করতে হবে।

 

বর্তমান বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্ধ পেয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত- যা ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা যা বাজেটে মোট বরাদ্ধেও ১৭ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা হয়েছে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্ধের ৭.২ শতাংশ, কৃষি-মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ,  খাদ্য নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্ধের ৩.৬ শতাংশ এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখন করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে  দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন চিকিৎসক/কর্মী নিয়োগ, করোনা মোকাবেলার জন্য কিট, পিপিই, মাস্ক, অক্রিজেন ও মেডিসিন সরবরাহের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরও বেশী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। দেশে প্রাথমিক/মধ্যম পর্যায়ে সেবার অগ্রগতি ভাল কিন্তু উচ্চ সেবায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমন- আইসিইউ, ভেন্টিলেশন ইত্যাদিতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। দেশের এই পরিস্থিতিতে কভিড-১৯ মোকাবেলায় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন; দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হলো- বৈশ্বিক অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের আমদানী-রফতানীতে পুর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে সময় লাগবে তার সাথে যুক্ত হতে পারে বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীন বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মহীনতা, ভোগ চাহিদা ও সরবরাহ চেইনে বাধাগ্রস্থতা, রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা ইত্যাদি। বর্তমান সরকার যে গতিতে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংশিত হয়েছে এবং অর্থনীতি আবার ঘুরে দাড়াতে পাড়বে কারন প্রবৃদ্ধির চেয়ে এখন টিকে  থাকাটাই বিবেচ্য বিষয় ;

তৃতীয়ত: আয়কর আইনের পরিবর্তনের ফলে প্রত্যক্ষ কর কমে যেতে পারে এবং কালো টাকার সাদা করার বিষয়টি উন্মোক্ত করায় এই সুযোগটি ও সদ্বব্যবহার করা উচিত। বিভিন্ন সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ষোল বার এই সুযোগটি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে ভাল ফল পাওয়া যায় নি। রফতানি শুল্কহারে যেসকল পরিবর্তন এসেছে, তা বিনিয়োগ তথা ব্যবসাবান্ধব। বিশেষত: করোনার সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবসায়ীদের চাহিদার বিবেচনায়। কিন্তু ইন্টারনেট ও সিম ব্যবহারে যে মুসক বৃদ্ধি করা হয়েছে- তাতে হয়ত রাজস্ব বাড়বে, কিন্তু সমালেচনা বাড়বে অনেক বেশী। আমানতকারীদের ব্যাংক হিসাব থেকে ক্রাইজ কর কেটে নেয়া অ-জনপ্রিয়, এটি আর একটি পদক্ষেপ যা আমানতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বড় বাজেট কোন সমস্যা নয়, বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অপচয় কমাতে হবে, সরকার ষোষিত ১৯টি ক্ষেত্রে যে প্রনোদনা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে- তা সঠিক সময়ে যোগ্য লোকদের হাতে যাতে যায়- এ দিকে নজর দিতে হবে।

চতুর্থত: করোনার প্রভাবে দেশের দারিদ্রের হার উর্ধ্বগতি যা সম্প্রতি কয়েকটি গবেষনায় উঠে এসেছে। মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ীতে যাচ্ছে, যা জীবন ও জীবিকার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলছে। দেশের প্রায় ৪ কোটি দরিদ্র মানুষের সাথে আরও দেড় কোটি লোক যুক্ত হয়েছে এবং  সরকার যে প্রনোদনা  ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রনোদনা ঘোষণা দিয়েছে, তা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ- যা ব্যাংকের মাধ্যমে কম সুদে দেয়া হবে। এই প্রনোদনা যেন গ্রামে যাওয়া মানুষকে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়ে যেতে পারে- সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মে নিয়োজিত লোকদের হাতে টাকার উপস্থিতি তাদের খরচ প্রবনতা বাড়াবে, পণ্যের চাহিদার সৃষ্টি হবে এবং কৃষি শিল্প উৎপাদন সহায়ক হবে- যা অর্থনীতির জন্য ভাল খবর।

 

সার্বিকভাবে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সন্তুষজনক এবং জমি রেজিস্ট্রি সহজকরণ, ইলেকট্রিসিটির প্রাপ্যতা, গ্যাস সরবরাহ ইত্যাদি পাওয়া গেলে ব্যবসার সুচকে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

 

সর্বশেষে বলা যায়, সামাজিকভাবে করোনার সংক্রামন মোকাবেলায় জনসচেতনতার পাশাপাশি  আরও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। আমাদের করোনাকালের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং এরইমধ্যে আমরা জীবন-জীবিকায় বাস্তবতা লক্ষ্য করেছি- যা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। মানবিক লকডাউন মডেল, যা সরকার অনুসরন করছে- তা দেশের জন্য একটি সফল মডেল। যার মাধ্যমে দেশের কষ্টসহিষ্ণু মানুষ আপন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হবে। তা হলেই উন্নয়ন বরাদ্দের টার্গেট শতভাগ মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং উন্নয়নের মহাসড়কের সকল যানজট নিরসন হবে।

 

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও সাবেক  জেষ্ঠ্য সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।

 

(এসএএম/১২ সেপ্টেম্বর ২০২১)


Comment As:

Comment (0)