undefined

মতামত/বিশ্লেষণ

কৃষি অর্থনীতিতে বিনিয়োগঃ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও চাল আমদানি কেন 

ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় হলেও গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্য আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে এবং এক দশক আগেও বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতার হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে। কিন্তু ছয় বছর ধরে তা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই নির্ভরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে বিশেষত হাওর অঞ্চলে বোরো ধান বন্যায় নষ্ট হওয়ার কারণে। সরকারি মজুত হ্রাস ও বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠার কারণে গত অর্থবছরের কয়েক মাসের মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে শুল্কছাড় সুবিধা দেয়ার সুবাদে দেশে শুধু চালেরই আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ টনে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬ লাখ ৫৬ হাজার টনে। ইউএসডিএর প্রক্ষেপণ অনুযায়ী এ সময় দেশে খাদ্য শস্য উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার টন। চাল আমদানির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে - কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হারে নিম্নমুখিতা।

সরকারি তথ্য মোতাবেক, গত ১০ বছরে কৃষি খাতে ৩.৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাথমিক হিসাবে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৪৫ শতাংশ, যা ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের অর্ধেক। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শস্য উপখাত।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা মতে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৬-১৭ চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার নেতিবাচক থেকে ১.৩৩ শতাংশ ইতিবাচকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে যা ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশর চেয়ে কম। বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ঋণাত্মক। ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য মতে, তা গত অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা ধনাত্মক বলে মনে হলেও দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ১.৩০ শতাংশ এর চেয়ে বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ (২০২০) মতে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮২ লাখ। গত এক দশকে প্রতি বছর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৬ লাখ করে যদিও বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। গবেষনা বলছে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষক পর্যায় ও নিম্ন জাতের কারণে প্রতি বছর ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয় এবং পরবর্তিতে চালের ঘাটতি মেটাতে বছরে ৩৫-৪০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর উৎপাদন পর্যায়ে এই রকম ধান অপচয় রোধ করা গেলে চালের আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে বলে প্রতিয়মান হয়।

এখানে লক্ষণীয় যে, বর্তমান বছরে দেশে বোর ধানের ও আউশ ধানের বাম্পার ফলন সহ মজুত ভালো থাকা সত্বেও কমছে না চালের দাম, যেখানে মোটা চালের কেজি প্রতি দাম প্রায় ৫০ টাকা এবং মিনিকেট চিকন চালের দাম প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। প্রসঙ্গত, অনেকদিন ধরেই দেশে চালের বাজার অস্থিতিশীল রয়েছে এবং বোরো মৌসুমেও চালের বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এমতাবস্থায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও চাল আমদানির সুযোগ দিল সরকার। চাল আমদানি শুল্ক শতকরা ২৫ থেকে ১৫ তে এ হ্রাস করা হয়েছে তবে এই সুবিধা তিন মাস অর্থাৎ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কী পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেবে তার উপর  কারন - আমন ধান আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কাটা হবে যার প্রভাবে দেশের প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৫ টাকায় এবং প্রতি মণ ধানের দাম ১২০০ টাকা থেকে ১১২০ টাকায় হ্রাস পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে কিছুটা অসন্তুষ্টি বিরাজ করছে। গত ১২ আগস্টের সিদ্ধান্তের ফলে এখন ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানি করা যাবে। তবে এই সুবিধা তিন মাস অর্থাৎ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সরকার কী পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেবে তার ওপর। বেশি চাল আমদানির অনুমতি দিলে আমন চাষিরা ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। বর্তমানে সারা দেশে চলছে আমন ধানের চারা রোপণ ও পরিচর্যার কাজ। এ ধান আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কাটা হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আমদানি করবে ৮ লাখ ৯ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল এবং দুই দফায় আমদানির জন্য ১৬৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। উভয় ক্ষেত্রেই শর্ত - চালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙা দানা থাকতে পারবে, আমদানির শর্তে আরও বলা হয়েছে, বরাদ্দ আদেশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে এলসি খুলতে হবে, এ সংক্রান্ত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ই-মেইলে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করতে হবে, বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করতে হবে, বরাদ্দের অতিরিক্ত ইমপোর্ট পারমিট ইস্যু করা যাবে না, আমদানি করা চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে ফের প্যাকেটজাত করা যাবে না, প্লাস্টিকের বস্তায় আমদানি করা চাল বিক্রি করতে হবে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে ইত্যাদি।

কৃষি অর্থনীতিবিদগন মনে করেন, চাল আমদানি  মজুতের স্থিতি বারানোর জন্য করা যেতে পারে যা কোন ভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি নয়। এর কারন হলো বেশি আমদানি হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা বাড়লেও  দেশ এখন ধান চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও বাস্তবতার নিরিখে ধান চাল প্রবৃদ্ধির হার কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারন এক: ধানের জাতের উন্নয়ন ও মানসম্মত বীজ সরবরাহ বাড়াতে হবে তার সাথে সাথে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা একটা চ্যেলেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে যার সাথে ধানের উৎপাদন সম্পৃক্ত রয়েছে। বাংলাদেশে জমির উৎপাদিকা শক্তি নানা কারণে কমে গিয়েছে কেবল মাত্র ভারসাম্যহীন উৎপাদন উপকরণের ব্যবহার করার কারনে; দুই: সাম্প্রতিক বছরগুলোয়  ধান উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় চাহিদা মেটাতে দেশ আমদানি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেও কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ গত কয়েক বছর যাবত ৯ হাজার কোটি টাকা ঘুরপাক খাচ্ছে। বর্তমান বছরের বাজেটে কৃষি খাতের অংশ মোট বাজেটের মাত্র ৬.১ শতাংশ যার একটি বৃহৎ অংশ কৃষি ভর্তুকিতে চলে যাবে। ফলে উন্নয়ন খাতে তেমন কিছু থাকে না। তাছাড়াও স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসাবে কৃষিজাত সামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা হারে ছাড় প্রদান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন সহায়তার হার হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের জন্য ৭ শতাংশ করা ইত্যাদি বলবৎ রয়েছে। এ বিষয়গুলো টেকসই কৃষি উন্নয়নের মানুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ও প্রাকৃতিক কারণগুলোর মোকাবেলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের উচিত হবে, ভাইরাসজনিত মহামারীকালীন কৃষি খাতের গুরুত্ব এবং করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসার বিবেচনায় নিয়ে সার্বিক কৃষি খাতে প্রণোদনার অর্থ বাড়িয়ে দেয়া; বিশেষ করে যেসব ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষী আমাদের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদন করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছেন এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাদের এ প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি; তিন: তথ্য বলছে বিগত বছর গুলোতে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ অবহেলিত হয়ে এসেছে এবং কৃষি খাতে ভুর্তুকি অন্যান্য বারের মত এবারেও একি অবস্থা রয়েছে। এখন আসা যাক বিনিয়োগের প্রসঙ্গে যা বর্তমান বছরের বাজেট উন্নয়ন খাতে কৃষি মন্ত্রনালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩,০৩০ কোটি টাকা যা ২০২০-২১ বছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ২,৩৯৭ কোটি টাকা (যা ঘোষিত ২৫৪৪ কোটি টাকার বিপরীতে)।

আবার যদি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পর্যালোচনা করা হয় তা হলে দেখা যায় যে জিডিপিতে এর হার মাত্র ২২% ভাগ যা গত কয়েক বছর যাবত স্থবির হয়ে আছে। আবার ব্যাংকিং খাতের হিসাবে দেখা যায় যে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাক্তি পর্যায়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা সামষ্টিক অথনীতির বিবেচনায় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং এতে কৃষি থাতের অংশ আরও কম অথচ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি বাণিজ্যকরনের উপর জোড় দেয়া হয়েছিল যেখানে পরিবার ভিত্তিক চাষাবাদকে পরিহার করে খামার ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদকে (গ্রিন হাউজ) উৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন রুপে আবির্ভূত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীগন অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেনা। বাজার ব্যবস্থাপনায় এই সকল কৃষকদের কোন প্রবেশাধীকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি যার প্রমান কৃষি পন্য বিশেষত: কৃষকের ধানের মূল্য না পাওয়া যার প্রভাব পড়েছে ক্রমাগতভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির হ্রাস পাওয়ায়। কৃষি বাজেটের আরও দিক হলো কৃষির প্রক্রিয়া যেহেতু গ্রামীন অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত তাই এর গতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৩৫ হাজার ২৯ কোটি টাকা (বাজেটের ৭.৪৮ শতাংশ), নদী ভাঙ্গন রোধ ও নদী ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সম্পদ খাতে ৬ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা (বাজেটের ২.৭৯ শতাংশ) বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাত মিলিয়ে বর্তমান অর্থ বছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৬ হাজার ৯ শত ৪৭ কোটি টাকা যা বিগত অর্থ বছরে ছিল ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি ৬৭৭ লাখ টাকা (হিসার মতে বেড়েছে ৭১৩ কোটি টাকা)। তথ্য থেকে জানা যায় এডিপিতে চলতি ও প্রস্তাবিত মিলে মোট ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্প রয়েছে যার মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ৩ শত ৮টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৮টি ও স্বায়ত্বশাসিত সংন্থা নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প ৮৯ টি। এই সকল প্রকল্পের মধ্যে কৃষি মন্ত্রনালয়ের প্রকল্প রয়েছে ১৫৬ টি (তার মধ্যে চলমান রয়েছে ৫০%, ২৮% সমাপ্ত প্রকল্প ও ১৯% কেরিড ওভার প্রকল্প) এবং সমাপ্ত প্রকল্পগুলো দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৫০০০ কোটি ও ৩০০০ কোটি টাকার পুন:অর্থায়ন স্কীমের আওতায় এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত ৭৮.৭% ও ৫৯% লোন বিতরণ সম্ভব হয়েছে ও ২ লাখ সুফলভুগী এর আওতায় এসেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধবও করে তুলতে হবে। জনগনের স্বাস্থ্য, পুষ্টির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে, পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র এবং পারিবারিক কৃষকদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই চাল তথা খাদ্য উৎপাদনে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং দেশ হবে স্বনির্ভর।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)