undefined

জন্মদিনের শুভেচ্ছাঃ শেখ হাসিনার সংগ্রামী জীবন ও কর্ম 

ড: মিহির কুমার রায়: বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাঙালীর তীর্থভূমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের গ্রাম  তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্থান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর ফরিদপুর জেলার গোপালগন্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায় এই ছায়া সুনিবিড় গ্রামে বনেদি শেখদের বাড়িতে। এই বছর তার ৭৫ তম জন্ম দিন।

তার শৈশবের পারিবারিক নাম ছিল হাসু। শেখ হাসিনার শৈশবের  মধুর স্মৃতিচারণে টুঙ্গিপাড়ার সেদিনের পল্লী প্রকৃতির চিত্রালেখ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হবে। শেখ হাসিনার শৈশব কেটেছে শান্ত গ্রামীণ পরিবেশে  গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দীঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলাতে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনের শিশু ‘হাচু’ ১৯৫২ সালে মাত্র পাচ বছর বয়সে কচিকণ্ঠে ভাষা আন্দোলনের স্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে টুঙ্গিপাড়ায় গেলে শিশুকন্যা শেখ হাসিনা পিতাকে জড়িয়ে ধরে কচিকণ্ঠে ভাষা আন্দোলনের স্লোগান দেন। পাঁচ ভাই বোনদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছিলেন জ্যৈষ্ঠ এবং বাল্যকাল থেকে একটি রাজনৈতিক পরিবারে এক বড় হওয়ায় পরবর্তি জীবনে তাকে রাজনীতিতে আসার পথ প্রশস্ত করে দেয়। শেখ হাসিনার শিক্ষা জীবন শুরু হয় টুঙ্গীপাড়ার এক পাঠশালায় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ সাহেব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন পুরানো ঢাকার রজনীকান্ত বোস লেনের ভাড়া করা বাসায়। পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হলে বাসা স্থানান্তরিত হয় ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে।

১৯৫৬ সালে শেখ  হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে, তারপর তার সময় কেটেছে আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬৫), সরকারী ইন্টারমেডিয়েট কলেজ, বকশী বাজার, ঢাকা (১৯৬৭) ও স্মাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৩)। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৬১ সালে ১লা অক্টোবর থেকে শেখ মুজিবর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহন করায় কিশোর বয়স থেকেই শেখ হাসিনার রাজনীতিতে পদচারন, যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তৎকালীন  ছাত্রলীগের নেত্রী হিসাবে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন ও ৬-দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন ইত্যাদি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬-দফা দাবিতে তদানীন্তন পাকিস্থানে এক গনজাগরনের সৃষ্টি হয়। এবং এই ঝরো দিনগুলোতেই কারাবন্দি পিতার আগ্রহে ১৯৬৭ সালের ১৭ই নভেম্বর পরমাণু বিঙ্গানী রংপুরের পীরগন্জের কৃতি সন্তান ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে শেখ হাসিনা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় জাতির ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ – এর গন অভ্যুথ্যান যেখানে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতৃ হিসাবে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহন করেন। ১৯৭১ সালরে ২৫ মার্চের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে যখন পাক হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়, তখন বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় জন্মগ্রহণ করেন। এমন বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার মধ্যে মমতাময়ী মা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, স্নেহের ছোটো বোন শেখ রেহানা, আদরের ভাই শেখ রাসেল, চার মাসের শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কিভাবে অসহনীয় মৃত্যুভীতি ও যাতনার মধ্যে কেটেছে মুজিব পরিবারের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শেখ হাসিনা তার জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, যেমন ”আমরা যে বাড়িটাতে বন্দী ছিলাম তার ছাদের ওপর দুদিকে দুটো বাঙ্কার করে মেশিনগান বসানো হয়েছে। এছাড়া আরও একটা বাঙ্কার গ্যারেজের ছাদে করা হয়েছে। বাগানের মাটি কেটে ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে। দিনরাত গুলির আওয়াজ। যখন বিমান আক্রমণ হয় তখন সব সৈন্য ট্রেঞ্চে ঢুকে যায় এবং বাঙ্কারে গিয়ে দাঁড়ায়। কেবল আমরা যারা বন্দি আমাদের মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে হয়। চার মাসের জয়কে নিয়ে হয়েছে অসুবিধা। বিছানায় শোয়ানো যায় না, গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে। রাসেল পকেটে তুলো রাখে। ওর কানে তুলা গুঁজে দেয়, যাতে গুলির আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে না যায়”।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি মুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর তার কন্যা সন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জন্ম লাভ করেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এ সময় বিদেশে থাকায় পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, এখানে উল্লেখ্য যে শেখ হাসিনা তার স্বামীর সাথে জার্মানীতে অবস্থান কালে এই ঘটনাটি ঘটে যায় এবং পরবর্তি ছয়টি বছর তিনি তার পরিবার সহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন, বিশেষত: তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্দী ও অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব কুমার মুখার্জীর সান্নিধ্যে থেকে। ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগের ১১তম জাতীয় কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন আহ্বায়ক এবং ১৯৭৮ সালে ১২তম কাউন্সিলে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব দিলে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পান আসাদুজ্জামান খান। জাতির ওই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রূয়ারি ঢাকার ইডেনে হোটেল অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৩তম কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিত তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দশে-মাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ৬ বছর নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা এবং দেশে ফিরে আসার ঘটনাটি বাঙালির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৭ মে দিনটি বাঙালীর কাছে ‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ হিসেবে পরিচিত। জাতির পিতার হত্যার পর বাংলাদেশ যখন তার আদর্শচ্যুত হয়ে উল্টো পথে চলছিল, সেদিনের সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেল থেকে শুরু হয়েছিল আদর্শহীন শাসনের বিরুদ্ধে এক নিরন্তর সংগ্রামের অভিযাত্রা। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ তাকে সম্বর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিল। লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে আরো স্লোগান তুলেছিল—‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা-স্বাগতম’; ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেবো’; ‘ঝড় বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’; ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই’। বিমানবন্দর থেকে প্রিয় নেত্রীকে নিয়ে যখন মানিক মিয়া এভিনিউতে যায় রাস্তার দুপাশে লাখ লাখ লোক। এমন দৃশ্য যা বর্ণনাতীত।

সভামঞ্চে উঠে ক্রন্দনরত অবস্থায় সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সর্বহারা। আমার কেউ নেই। আপনাদের মাঝেই আমার হারানো পিতামাতা, আমার ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাইকে আমি খুঁজে পেতে চাই। আপনাদেরকে কথা দিলাম এই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব।’ মানিক মিয়া এভিনিউর জনসমুদ্রে সর্বস্তরের জনতার উদ্দেশে বক্তৃতায় জাতির কাছে যে অঙ্গীকার তিনি ব্যক্ত করেছিলেন পরবর্তীকালে সেসব প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে আজও তা অব্যাহত রেখেছেন।

এরপর সামরিক জান্তা, স্বৈরশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলে একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনকিছুই তাকে এক বিন্দু টলাতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একুশ বছর পর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সরকারের আমলেই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি।  বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসর্ম্পূণতা, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নেমে আসে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। দারিদ্র্য হ্রাস পায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি,  ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ, যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) তখনই উদ্ভোধন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের (১৯৯৬-২০০১) শাসনকাল চিহ্নিত হয় ‘৭৫ পরর্বতী সময়ের স্বর্ণযুগ হিসেবে। ২০০১ সালের ষড়যন্ত্র ও কারচুপির নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ সময় দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে জোট সরকার সারাদেশে কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তদানীন্তন বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারি মদদে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে চালানো হয় পরিকল্পিত নারকীয় গ্রেনেড হামলা, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। গুরুতর আহত হলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অসংখ্য নেতাকর্মী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন - চতুর্থাংশের বেশি আসন।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা মহাজোট সরকারের। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতর্পূব উন্নয়ন ও অমিত সম্ভাবনার শক্তিশালী ভীত রচিত হওয়ায় জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌছে যান শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আজ সফলতার সঙ্গে টানা তৃতীয় মেয়াদে চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনা করছেন। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেশবাসী আজ সুফল পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে।  বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সব প্রতিবন্ধকতা সমস্যা-সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে বিগত এক দশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় যুক্ত হয়েছে আজ সাফল্য-স্মারক।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশে উন্নীত করা, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাওয়া, শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনা, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, স্বাক্ষরতার হার ৭৩.৯ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌছে দেয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল  বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকার/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালউত্তির্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ (ইউএন), বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রশংসিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং করোনা মহামারীর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার  পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন কার্যকরী পদক্ষেপ। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখতে কৃষি ও শিল্পসহ অর্থনৈতিক খাতগুলোতে সময়োপযোগী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি রোল মডেল হিসাবে পরিগণিত হয়। যার কারণে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।  

এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। সাফল্য গাঁথা এই কর্মময় জীবন কুসমার্স্তীণ ছিল না, ছিল কণ্টকার্পূণ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারানির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে।  বার বার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে।  অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল। সহজ সারল্যে ভরা তার ব্যক্তিগত জীবন। মেধা-মনন, সততা, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য্যে, দেশপ্রেমে ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। পোশাক-আশাক, জীবন-যাত্রায় কোথাও কোন প্রকার বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার কোন প্রকার ছাপ নেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে তার দিনের সূচনা ঘটে। পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন কয়েকবার।

একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে শেখ হাসিনার  অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ইতোমধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে। নিখাঁদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ় মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলী তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। তিনিই বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং বাঙালি জাতির সব আশা-ভরসার নিরাপদ  আশ্রয়স্থল। ‘৭৫ পরবর্তী বাঙালি জাতির যা কিছু মহৎ অর্জন তা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। এই যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং নিরন্তর সাহিত্য পাঠের অনুপ্রেরণায় তাঁর নিজের লেখালেখি, পাশাপাশি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর তিনখানা মহাকাব্যিক আত্মজীবনী এবং চৌদ্দ খন্ড গোয়েন্দা দলিলপত্র সম্পাদনায় ব্রতী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রথম বই ‘ওরা টোকাই কেন’ (১৯৮৮); দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’-এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার মধ্যে একজন গভীর সংবেদনশীল লেখকের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। শেখ হাসিনার ‘রচনাসমগ্র’- ১ ও ২- উল্লেখ্য, বাংলাদেশে শ্বৈরতন্ত্রের জন্ম (১৯৯৩), সামরিক তন্ত্র বনাম গনতন্ত্র (১৯৯৪), জনতা ও গনতন্ত্র (১৯৯৭), আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম (১৯৯৭); বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু (১৯৯৮); বিপন্ন গনতন্ত্র লানছিত মানবতা (২০০২) ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু কন্যা সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি, বয়স্কভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিসেবাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর ‘দুঃখী মানুষে’র মুখে হাসি ফোটানোর ব্রত নিয়ে দেশের শাসক নয়- সেবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। 

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।


Comment As:

Comment (0)