undefined

মতামত/বিশ্লেষণ

ব্যাংকিং খাতঃ অলস টাকা, সচল অর্থনীতি

ডঃ মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে, যার মধ্যে দেশের বাহিরে বৈদেশিক ব্যাংকে রাখা হয়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ, যা থেকে সুদ বাবদ আয় হচ্ছে মাত্র এক শতাংশ হারে। অথচ, বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তার গড় সুদ হলো ৪ শতাংশ অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থেকেও দেশের বিনিয়োগে কি লাভ বা আর্থিকভাবে দেশ কি ভাবে উপকৃত হচ্ছে? প্রায়শই পত্র-পত্রিকায় মুখ রোচক খবর বেরুচ্ছে “ব্যাংকগুলো বর্তমানে অলস টাকার পাহাড়”,  ”দেশে বিনিয়োগের মন্দাভাব কাটছে না” ইত্যাদি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ব্যাংকগুলোর ভল্টে জমা থাকা অলস টাকার পরিমাণ ৬ হাজার ৭০০ কোটি, যা থেকে ব্যাংক কোন আয় করতে পারছে না, যা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থবিরতার লক্ষণ বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদগণ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় বিনিয়োগে গতিশীলতা আনয়ন করা। কিন্তু এই অতিরিক্ত তারল্যের বিনিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। এখানে সমস্যার ধারাবাহিকতা তিনটি ভাগে বিভক্ত। যথা: (১) ব্যাংক বিনিয়োগের অপেক্ষায় টাকা নিয়ে বসে আছে; (২) শিল্প উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না; (৩) বিনিয়োগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে দ্বিমত রয়েছে।

এই আলোকে সার্বিক পরিস্থিতি যদি বিশ্লেষিত হয় তাহলে দেখা যায় যে, দেশের ভিতরে নূতন বিনিয়োগের ভাটা বিগত কয়েক বছর যাবত বিদ্যমান, যা সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে জি.ডি.পি এর মাত্র ৩১ ভাগ। আবার অনেক উদ্যোক্তা দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হচ্ছে। আবার অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য হলো দেশে তারল্যের সরবরাহের চেয়ে উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন দেশের ভিতরে বিনিয়োগের ঘাটতি রয়েছে, বিশেষত: অবকাঠামোগত সমস্যা, যেমন - গ্যাস, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে স্বল্পতার কারণে। আবার ঋণের সুদের হার, যা সরকারকেই ভাবতে হবে এবং সহনীয় নিম্ন সুদে ঋণ দিলে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হয়ে দেশে-বিদেশে বিনিয়োগ করে অনেক লাভবান হতে পারবে। আবার ব্যাংকাররা বলছেন বিদেশী ঋণ উদারীকরণ নীতি আর স্থানীয় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় বাড়ছে অলস টাকার পরিমাণ, যদিও বিনিয়োগের পরিবেশ বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে, আমানতে গড়ে সুদ সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে এবং বিনিয়োগে সুদের হার গড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে নেমে এলেও বাস্তবে উদ্যোক্তারা উল্লেখিত শতাংশ সুদের নিচে ঋণ পাচ্ছে না, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রথমার্ধের পরিসংখ্যানও উল্লেখ রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে অর্থের বেশির ভাগ রয়েছে ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি ব্যাংকে, যার পরিমাণ ৪,৭৫৪ কোটি টাকা। আর বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৮৭৭ কোটি অলস টাকা এবং দেশীয় সরকারী বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে রয়েছে যথাক্রমে ৪২৭ ও ৪৯৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড বলছে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে, যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ব্যাংকারদের মতে বিদেশিী ঋণের সহজলভ্যতা হওয়ায় এর নেতীবাচক প্রভাব পড়েছে দেশীয় ব্যাংকের বিনিয়োগ কর্মসূচীর উপর। তাছাড়াও নির্দ্দিষ্ট টাকার সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে ব্যাংকগুলোর যার গড় সুদের হার আমানতের সুদের হারের চেয়ে অনেক কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, অতি ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রকৃত শিল্পখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলছে, যার মধ্যে রয়েছে শিল্পে জমি বরাদ্দ ও জ্বালানী সংযোগ, সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় সরকারী বে-সরকারী খাতে সাতটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বিপুল পরিমান টাকা, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তিকে দূর্বল করে দিয়েছে। তাছাড়াও এই সাতটি ব্যাংকের ঋণের মান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সঞ্চিত সংরক্ষণ করতে পারছে না। তথ্য মতে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাসেল-৩ অনুসারে ব্যাংককে ১০% নূন্যতম মূলধনের পাশাপাশি ৬২% হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়, যা গত বছর শেষে এই কাজে ব্যর্থ হয়েছে এই ব্যাংকগুলো। এছাড়াও ব্যাংকিং খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার দাড়িয়েছে ১০.৮০ শতাংশ। তাছাড়াও অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ ও যার কারণে ঋণ খেলাপী হওয়ায় এই ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দাড়িয়েছে ৬,৫৩৯ কোটি টাকা। যার মূল কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে যাচাই বাছাই না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করা, যার বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হচ্ছে মুনাফা ব্যাতি রেখে। ব্যাংকগুলোর এই ধরনের আচরণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক শংকিত নয় তবে এর উন্নয়নকল্পে কি পদক্ষেপ নেয়া জরুরী তা নিয়ে প্রয়োগধর্মী আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ আমরা একদিকে বলছি আর্থিক দৈন্যতার কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশের সার্বিক উন্নয়নে শরিক হতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ অর্থনীতিতে ঋণ প্রবাহ অনেকটা মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের মত কিন্তু অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে আর্থিক হাতিয়ার বাংলাদেশ সুবিধামত প্রয়োগ করে থাকে এবং সরবরাহ যদি উৎপাদন খাতে হয় তবে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকবে না এবং জাতীয় উন্নয়নে মূল্য সংযোজন ঘটাবে যা প্রবৃদ্ধি সহায়ক। কিন্তু মুল কথা হলো ঋণ সরবরাহে অভাব নেই, ঘাটতি হলো উদ্যোক্তার উদ্যোগের, যিনি মূলধন গ্রহণ ও সংগঠন করে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংখ্যা, আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। এই মানবিয় দিকটির সাথে উদ্যোক্তার নৈতিকতার প্রশ্নটি জড়িত এবং প্রায়শই বলা হয় দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে কম আর যারা আছেন তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার চেয়ে ট্রেডিং এ আগ্রহ বেশী অর্থাৎ এক বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করে অন্য বাজারে বিক্রি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উদ্যোগ এর চেয়ে নূতন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা তুলনামুলক ভাবে বেশী, যারা বিনিয়োগের পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে সতর্কতার সাথে সামনে আগাতে আগ্রহী। এই ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে ব্যাংক, সরকারী প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা -এ তিনটি স্টেকহোল্ডারের উপর নির্ভর করছে বিনিয়োগের গতিধারা অর্থাৎ অলস টাকায় সচল অর্থনীতি গড়া। এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রথমতঃ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োগধর্মী প্রশিক্ষণ, যেখানে গুণগত উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি প্রধান্য পাবে। ধরা যাক বর্তমানে সরকারী (৫০টি) ও বেসরকারী (১০৮টি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবসায় প্রশাসন কোর্সে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কোর্স পড়ানো হয় এই উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা কার্যক্রম সমাপনান্তে যারা উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী তারা যেন এই বিষয়ে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাড়িয়ে থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর বিবিত্র ও এমবিএ গ্রাজুয়েট অর্জনকারীগণের খুবি কম সংখ্যক স্বনিয়োজিত কর্ম সংস্থানের আওতায় স্বাধীন চেতনা উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখাচ্ছে এবং বাকিরা চাকুরীর জন্য লাইনে দাড়াচ্ছে, যেখানে সুযোগ ক্রমাগতই সীমিত হয়ে পড়ছে বিধায় বেকারত্বই তাদের মুল পরিচয়ের বাহক। আবার যে সংখ্যক উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী তাদেরকে যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরী করা যায় তবে বর্তমানে যে অপবাদটি আছে যে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগ্রহী নয় তা অনেকাংশে গোচাবে বলে প্রতীয়মান। তবে প্রশ্ন এই ধরনের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে আছে কী? সেই জায়গাটিতেও কিছু সমস্যা রয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিএমবিএ) এই ধরনের প্রশিক্ষণের পারদর্শী। কিন্তু এই সকল প্রশিক্ষণে উচিত মাঠপর্যায়ের কেইসগুলোকে বেশী করে উপস্থাপিত করা যাতে বাস্তবভিত্তিক ধারনাগুলো মটিভেশনের বা প্রেরনার উৎস হতে পারে; দ্বিতীয়ত: দীর্ঘদিন ধরে দেশের “ব্যাংকিং” খাতে অব্যবস্থাপনা চলছে কর্মকর্তাদের অবহেলার কারনে, ঋণদানে যথাযথ বিধান অনুসরণ না করে, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া, যা ঋণ খেলাপী হওয়ার অন্যতম কারন হিসাবে বিবেচিত।

আমরা মনে করি, এসব ঘাটতি পূরণের আগে যাতে অতীতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিৎ। এজন্য অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। কাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে, এসব নিয়ম মাফিক দেখতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করছে না, তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ঋণ নিয়ে মামলা রয়েছে, তা নিষ্পত্তির জন্য জোর পদক্ষেপ নিতে হবে; তৃতীয়ত: প্রশিক্ষণ ব্যাংকারদের মানবিক গুনাবলী পরিবর্তনের হাতিয়ার, যার সফল উদাহরন রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যার সফল বাস্তবায়ন এ দেশে হতে পারে কিন্তু তার সাথে নৈতিকতার বিষয়টিকে যদি ধরা হয় সেক্ষেএে প্রশিক্ষণ কতটুকু ভুমিকা রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয়। তবে ব্যাংকাররা যদি মানবিক হয় তবে বিনিয়োগকারি অনায়াসেই বিনিয়োগে আকৃষ্ঠ হতে পারে। এতে অলস টাকার পরিমাণ কমে আসবে এবং ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তবে ব্যাংক কখনও সাধারন মানুষের আয়ের উৎস হতে পারেনা। ব্যাংক শুধু আর্থিক খাতের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করে।

দু:খজনক হলেও সত্য, সাধারন মানূষের বাড়তি আয়ের জন্য দেশে আর্থিক পন্যের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকে টাকা রেখে কেন আমানতকারীরা প্রকৃত পক্ষে কোন লাভবান হচ্ছে না স্বল্প সুদের কারনে। তাই সাধারন মানুষের জমানো অর্থ কখনও এক জায়গায় রাখা ঠিক নয়, যা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেএে হতে পারে, যেমন - সঞ্চয় পএ, ব্যাংক, শেয়ারবাজার ইত্যাদি। বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষকে আমরা বীমার আওতায় আনতে পারিনি অথচ দেশে বিদেশে অনেক বীমা কম্পানি ব্যবসা করছে। তাই ব্যাংক-বীমা ব্যবসা চালু করা দরকার; চতুর্থত: বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭টি, যেগুলো চালানোর জন্য সম সংখ্যক সিইও, সিফও, এইচআরও কর্মকর্তা লাগবে। কিন্তু একই সাথে এত দক্ষ লোক পাওয়া দুষ্কর। তার সাথে ব্যয় উর্ধমুখি ও আয় নিম্নমুখী। প্রায় সব ব্যাংকে মূলধন প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে ব্যাংক একিভুত করনের বিষয়টি চলে আসতে পারে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও সাবেক জ্যৈষ্ঠ সহ সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)