undefined

শিক্ষার হার ও মান বাড়তে বিনিয়োগ অপরিহার্য

ডঃ মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- রূপকল্প ২০২১ কে সামনে রেখে দেশের শিক্ষার হার শতভাগে উন্নিত করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল সুস্থ, সবল, চেতনা সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন মানব সম্পদ সৃষ্টি, যা কেবল একটি পরিসুদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাই দিতে পারে। দেশের সরকার প্রধানের উক্তি সারা জাতীকে শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে অনেক সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। যারা বামপন্থী রাজনীতির সংগে সংযুক্ত তারা প্রায়শই বলে থাকেন, অন্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মত শিক্ষাও মানুষের মৌলিক অধিকার, যা মনোবিকাশের পথ উন্মুক্ত করে এবং জীবনের সর্বস্তরের বিষয়াবলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যেমন - নৈতিকতা বোধ সৃষ্টিতে, জীবন জগৎকে জাগ্রত করতে, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে ইত্যাদি।

একজন পন্ডিত বলেছেন কোন ব্যক্তি যদি সম্পদের মালিক হয় তবে তা রক্ষা করতে কেয়ারটেকার রাখার প্রয়োজন হয়, যা ব্যয়বহুল। আর যদি জ্ঞানের অধিকারী হয় তবে সেই জ্ঞানই তাকে সদা সর্বদা পাহাড়া দিয়ে রাখবে, যা অর্জিত হয় সু-শিক্ষার মাধ্যমে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির অধ্যাপক টি. ডব্লিউ. সুজ বলেছিলেন- অর্থনীতিতে যত ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত।

এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করেই দু’হাজার দশ সালে শিক্ষা নীতি প্রণীত হয়েছিল, যা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে সুধী মহলে আলোচিত। বর্তমানে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কারের ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাবোর্ডগুলো যে চার স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছে তা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি প্রতিযোগীতামুলক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে, যা আমাদের শিক্ষার হার শতকরা ৭২ ভাগ বৃদ্ধির একটি প্রধান নিয়ামক। তাছাড়াও শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারী সংস্থার (এন.জি.ও.) অবদান বিশেষ করে সুবিধা বঞ্চিত তৃণমূল পর্যায়ের জনবসতির জন্য গণশিক্ষা কিংবা কর্মমুখী কার্যক্রম আমাদের সার্বিক শিক্ষার হারে বিশষ অবদান রয়েছে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার বিশেষতঃ মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনের সূযোগ সৃষ্টি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সরকারী সহায়তার প্যাকেজ সৃষ্টি এবং উচ্চ শিক্ষায় বিশেষতঃ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ব্যাপক বিস্তৃতি আমাদের শিক্ষার হারের বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত।

শিক্ষামন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন যে, শিক্ষার হার আগের চেয়ে তুলনামূলক বিচারে অনেক বেড়েছে, এখন শিক্ষার মানের ব্যাপারে জোড় দেবার সময় এসেছে বিশেষতঃ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ এর কথা বিবেচনায় রেখে। এরি মধ্যে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন "Higher Education Quality Improvement Project (HEQEP) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে ২০১৪ বছর থেকে যেখানে বাংলাদেশের ১৫০টি সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অংশ গ্রহণ করছে পর্যায়ক্রমে। তাছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ রুটিন মাফিক পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার মান নিয়ে সকল মহলে যে আলোচনা/সমালোচনা রয়েছে তা কোনভাবেই গোছানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। অনেকেই বলেন বিভিন্ন পর্যায়ে ত্যাগি ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকের স্বল্পতা চোখে পড়ার মত এবং যারা আছে তাদের পক্ষে বিশাল এই প্রক্রিয়াকে সামাল দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না এবং একটি প্রজন্ম ফাঁক (Generation Gap) সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ যারা অবসর গ্রহণ করে চলে গেছেন তারা ভাল, আবার যারা আসছেন তারা পূর্বেকারদের মত ত্যাগী কিংবা জ্ঞানী নন। আবার শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে শিক্ষার্থীবৃন্দ লাইব্রেরী কিংবা বই মুখী না হয়ে ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে যাওয়ায় জ্ঞান চর্চার কাজে এক নূতন মাত্রা যোগ হয়েছে যার বেশীর ভাগই নেতিবাচক বলে বিবেচিত। অথচ বিশ্বায়নের যুগে এইটির প্রয়োজন অস্বীকার করা যায়না যাতে সরকার তৃণমুল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বাজেট কাঠামোর আওতায় সহায়তা দিয়ে চলছে। তারপরও শিক্ষার মান বেড়েছে তা বাস্তবে প্রতিফলন পরিলক্ষিত নয়।

ধরা যাক সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা চলছে তাতে ফলাফলে কোনভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কোঠা পূরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠান বিপাকে অন্যদিক শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক বিপাকে, যদিও উচ্চ মাধ্যমিক জি.পি.এ-৫ পাওয়া ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোঠার চেয়ে অনেক বেশী। এই তো গেলো ভর্তি যুদ্ধের বিরত্ব গাথা কাহিনী।

এখন আসা যায় যারা উচ্চ শিক্ষায় অধ্যায়নরত তাদের ভাবনাটা হলো ক্লাসে জ্ঞান দানের ঘাটতি প্রকট অর্থাৎ শিক্ষক যা পড়াচ্ছেন তা শিক্ষার্থীর চাহিদার কাছাকাছি যেতে পারছে না বিধায় এই বিশাল ঘাটতি নিয়ে যখন তারা শিক্ষা জীবনের শেষ প্রান্তে উন্নীত হয় তখন একটি অনুশোচনা (Realization) প্রায়শই পেয়ে বসছে যা হলো কি লিখলাম? কতটুকু শিখলাম? এই পরিমান শিক্ষার জ্ঞান নিয়ে এখন কোথায় যাব? তারপর অভিভাবক পর্যায়ে যখন শিক্ষার্থী সন্তানকে প্রশ্ন করা হয় এখন কি করবি- আর উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা, চাকুরী না স্বাধীন উদ্যোক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ? তখন মনে হয় পৃথিবীর সব ভাষা ম্লান হয়ে যায়। এটি সম-সাময়িককালে অভিভাবকদের অনুভূতি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতি। এই অবস্থা একদিনে তৈরী হয়নি এবং এর সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। কালের আবর্তে বিষয়টি ঘটেছে এবং সামনের দিকে আরও ঘটবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের নামিদামী স্কুল ও কলেজগুলো যে গুলোতে ঐতিহ্যগতভাবে অবস্থান মফস্বলে, বোর্ড পরিচালিত পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল মেধার ক্রমানুসারে তারা দেশের নির্দিষ্ট স্থানটি অনেক আগেই হাড়িয়ে বসেছে এবং এই স্থানটি দখল করে নিয়েছে নব উদীয়মান শহরকেন্দ্রীক কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এইটি সামাজিক বৈষম্যের আরও একটি কুৎসিত রুপ, যদিও পত্র পত্রিকায় দেখা যায় আজো পাড়া গায়ের স্কুল কলেজ থেকে দিনমজুরের সন্তানটি জিপিএ-৫ পেয়েও আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাবে মেডিক্যাল কিংবা প্রকৌশলে কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও পড়তে অক্ষম হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের উপায় কিভাবে হতে পারে তা নিয়ে তেমন লেখালেখি চোখে পড়ে না। তবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও গবেষণা সংস্থা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। শিক্ষা প্রশাসকরাও জানেন এই প্রতিযোগিতা মূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে শিক্ষিতের হার উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানের দিকেও নজর দিতে হবে কিন্তু কিভাবে?

সরকারি কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে প্রতিটি স্কুল কলেজে সৃষ্ট পদের তুলনায় শিক্ষকের পদ অনেক শূন্য রয়েছে এবং যারা কর্মরত তাদের অনেকেই কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে তাদের শিক্ষকতার চাকুরীটি পরিচালনা করেন না আর কি মানের শিক্ষা উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীকে দিচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর্যাপ্ত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা সে কথা নাই বললাম। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেক সরকারী স্কুল কলেজ রয়েছে যেখানে এই ঘটনাগুলো বেশী ঘটছে, যার দিক ভাল করার কেউ আছে বলে মনে হয় না আপাত: দৃষ্টিতে। আসা যাক সরকারী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত জেলা পর্যায়ের কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, যেখানে প্রায়ই দেখা যায় একি সাথে তারা সমান্তরাল ভাবে চাকুরী পরিচালনা করে কখনও বা ডেপোর্টেশনে বা প্রশাসনের দৃষ্টির অন্তরালে। জনৈক কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক ঢাকায় পরিবারের সংগে থাকে এবং সপ্তাহের তিনদিন যখন ক্লাস থাকে তখনই উপস্থিত হয়, যা প্রশাসনিকভাবে পরিবীক্ষণ (Monitoring) করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কেহ নেই।

এই ধরনের একটি পরিবেশে সরকার প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটি হলো সরকার শিক্ষক কোথায় পাবে এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মসূচি পরিচালনার জন্য, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা অর্থের বিনিময়ে সেখানে মেধার মানদন্ডে নয়। অতিমাত্রায় রাজনীতির উপস্থিতি মেধার লালন ও পালনকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত, যা সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনী কাজের পথে অন্তরায়। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি কাজ শিক্ষা (teaching), গবেষণা (Research) ও সম্প্রসারণ (Extension)। কোন আমলে পাঠ্যসূচী (Syllabus) তৈরী হয়েছে যার কোন আধুনিকায়ন (Modernization) নাই বললেই চলে অথচ বিশাল জমি, দালান, হোস্টেল ও অন্যান্য অবকাঠামো নিয়ে এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। আসা যায় দেশের বর্তমানে ১০৭টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার দিকে যাদের বেশীর ভাগেরই কোন নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, নীচ তালায় হোটেল উপরের তালায় বিশ্ববিদ্যালয়। এক অপূর্ব মিশ্রনের সমাহার নিয়ে শিক্ষা বাণিজ্য বর্তমানে জমজমাট। আর মান সম্মত শিক্ষা মোবাইল ফোন ও লেপটপের বেড়াজালে আবদ্ধ। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ভার্সিটির একজন শিক্ষক আমাকে জানালেন শিক্ষকরা ছাত্রদের বেড়াজালে আবদ্ধ কিংবা জিম্মি হয়ে গেছে। বিশেষতঃ গ্রেড প্রদানের ক্ষেত্রে, যা শিক্ষা পদ্ধতির এক অস্বস্তিকর রূপ। এখন একজন শিক্ষক কেনই বা ছাত্রের কাছে জিম্মি হবে? নিশ্চয়ই শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব কিংবা নৈতিকতায় ঘাটতি রয়েছে, যে সুযোগটি ছাত্ররা নিয়ে তার ফলাফলের ভান্ডার পূরণ করবে যা নিয়ে সে কোথায় যাবে এই চিন্তা কি ছাত্ররা একবার করেছে? এই বিষয়টি ছাত্রদের উপর ছেড়ে না দিয়ে শিক্ষক কেন তার নৈতিক দায়িত্বটুকু পালন করছে না?

এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দেখা যাবে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই কোন গলদ রয়েছে, যা কেবল মুখ চেনা কিংবা সুপারিশ কিংবা আত্মীয়কেই বাছাই করা হয়, যাদের মেধা, ব্যক্তিত্ব কিংবা কোনটিই বিবেচনায় আনা হয় না। এই অবস্থার জন্য দায়ী কেবল মাত্র কোন সুনির্দিষ্ট সার্ভিস রুল না থাকা যদিও ইউ.জি.সি. বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এ বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে কিন্তু তদারকি না থাকায় এই আইন আর কার্য্যকর হয়ে উঠছে না। মালিকগণ মনে করছে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার একটা সফল আদায় তথা মুনাফা অপরিহার্য্য কিন্তু সেই মুনাফার যে একটা বড় অংশ বিশ্বদ্যিালয়ের একাডেমিক উন্নয়নে ব্যয়িত হবে তার কোন সামাজিক উদ্যোগ এখানে পরিলক্ষিত হয় না অথচ সুযোগ রয়েছে।

তাই আগামী দিনের শিক্ষার মান নিশ্চিত করণ নিয়ে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা  করার জন্য প্রয়োজন প্রথমতঃ সুশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষার উপযোগী করে তাকে তৈরী করণ সেটা যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হউক না কেন? একজন ভাল শিক্ষক ছাড়া ভাল ছাত্র তৈরি হয় না যা চিরন্তন সত্য কথা এবং এটি তৈরী করার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অবারিত সুযোগ থাকলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তেমন কিছুই নাই, যা মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায়। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকল সুযোগ গ্রহণ করে তাদের career তৈরী করে সত্যি কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজে লাগায় না। আর গবেষণার ক্ষেত্রটি (এম.ফিল, পি.এইচ.ডি ছাত্র গাইড) একেবারেই ক্ষীন হয়ে গেছে অথচ এর জন্য অবকাঠামোগত সুবিধার যেমন সু-বিশাল লাইব্রেরী, কম্পিউটার ল্যাব, হোস্টেল, ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদির কোন ঘাটতি নেই।

এই জায়গাগুলোতে শিক্ষক নিজে থেকে যদি দায়িত্ব পালনে অপারগ হয় তাতে কিছু করার থাকে না। কিন্তু প্রশাসনিক কিছু compulsion থাকলে শিক্ষকরা তা করতে বাধ্য যেমন পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণা ছাত্র তত্ত্বাবধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া,  যা বর্তমানে অনুপস্থিত অথচ পাশ্ববর্তি দেশ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এগুলো শতভাগ পালন করা হয়। আবার শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্কুল/কলেজ পর্যায়ের নিয়মের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নতা থাকলেও একটি Performance Appraisal এর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়না; দ্বিতীয়ত: জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপখাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে ২০২২ সালের মধ্যে ২ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটে শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ৮ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট ব্যয়ের ১১.৬৯ শতাংশ।

উল্লেখ্য, গত কয়েকটি বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির তুলনায় তাতে খুব বেশি হেরফের হয়নি। বর্তমান ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে একই চিত্র প্রতিফলিত হয়। এ কথা অনস্বীকার্য, শিক্ষা খাতের বরাদ্দ হলো উন্নত জাতি গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ। অথচ এ খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাতে শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা তো দূরের কথা, দেশীয় মানটাও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন; তৃতীয়ত: কোভিড-১৯ মহামারীর সম্ভাব্য ক্ষতি ঠেকাতে সরকার গত ১৭ই মার্চ, ২০২০ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করে, যা দির্ঘ ১৮ মাস পর  ১২ই অক্টোবর, ২০২১ খুলে দেয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অর্থনীতির সকল কর্মকান্ডে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছিল। শিক্ষা যেহেতু একটি সেবা খাত, এর ক্ষতি নিরুপন করা এত সহজ হবে না অন্যান্ন খাতের মত।

কিন্তু ‘ইউনেস্কো বলেছে নোভেল করোনার কারনে বাংলাদেশের প্রায় ৪কোটি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে তারা আশা করছে এবং এ ছাড়াও ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়তে পারে বলে ঈঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিবাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগক্তাগনও এই ক্ষতির  হুমকিতে রয়েছে। করোনার সময়টিতে বিশেষত: গত বছরটিতে অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সবচাইতে বিপাকে পড়েছে, বিশেষত: যে গুলো সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল এবং স্কুল বন্ধ থাকায়  টিউশন ফি দেয়া থেকে তারা বিরত রয়েছে যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রেখেছে। এই দৈন্যতার কারনে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে চাকুরী থেকেও তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছে কোন প্রকার উপায় না পেয়ে।

শিক্ষায় অর্থ যোগানের জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের উপর সংগত কারনে নির্ভরশীল এবং করোনার কারনে দেশের ৩৫ শতাংশ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের চাকুরী চলে গেছে, ব্যবসায়ীদের আয় কমেছে, অনেক বেসরকারী শিক্ষক চাকুরী, টিউশনি, কোচিং সকলই হারিয়ে এখন রাস্তায় বসেছে।

স্কুল কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তারা বলছেন, শিক্ষার্থীর টিউশন ফি হলো তাদের একমাত্র আয়ের উৎস তা সময মত উঠে না আসলে স্কুল কিভাবে চালাবে? এখন দেখা যাক স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে হয়ত কিছুটা সময় লেগে যাবে।

সবশেষে বলা যায় কভিড-১৯ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হবে তা এই মূহূর্তে বলা যায় না। অর্থনীতিসহ জীবন জীবিকার ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে সরকারের উদ্যোগের কোন ঘাটতি নেই। এই পর্যায়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক, নীতিনির্ধারকবৃন্দ সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষন করে শিক্ষা কার্য্যক্রম চালিয়ে নিবেন এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যে আর্থিক দুর্বলতা করোনার কারনে সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

লেখক: সিন্ডিকেট সদস্য, ডীন ও অধ্যাপক, সিটি ইউনিভাসিটি।


Comment As:

Comment (0)