undefined

করোনা-উত্তর শারদীয় দূর্গাপূজার সামষ্টিক অর্থনীতি

ড: মিহির কুমার রায়: পৃথিবীতে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি হিন্দু ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সপ্তাহব্যাপী আনন্দ উৎসবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সব বয়সের মানুষ একাত্মতায় মিলিত হয়, যা ৬ই অক্টোবর বুধবার মহালয়া, দেবীপক্ষের শুরু এবং দুর্গা পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। দুর্গার আগমন ও প্রস্থানের বাহন ও তার ফলাফল নিয়ে বাঙালি সমাজে বহু কথা প্রচলিত রয়েছে। দুর্গা ও তাঁর ছেলে-মেয়ের নিজস্ব বাহন থাকলেও আগমন ও প্রস্থানের বাহনের কথা আলাদা করে পঞ্জিকায় উল্লেখ করা থাকে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, দুর্গার আগমন ও প্রস্থানের বাহন নির্ধারিত করে মর্তলোকে সারা বছর কেমন যাবে। এবার দেবীর আগমন ঘোটকে অর্থ্যাৎ ঘোড়ায় চড়ে যার অর্থ অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ লেগেইে থাকবে এবং গমন পালকীতে যা হলো মহামারি রোগ বালাই লেগেই থাকবে যা আমরা  বিগত  দেড় বছর যাবত দেখতেই পাচ্ছি  সমাজ জীবনে।

পূজা মন্ডপ ঘিরে শুরু হয় নানা যজ্ঞ। নানা বর্ণে নানা আয়োজনে উৎসবে ভরে থাকে সমস্ত এলাকা। কাসর ঘণ্টা আর ঢাকের তালে আন্দোলিত হয়ে ওঠে পূজার সকল আয়োজন। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচ দিন দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আর সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে খ্যাত। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয় যা দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি হয় পঞ্চদশ দিনে অর্থাৎ পূর্ণিমায়। এই পঞ্চদশ দিনটিতে বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সার্বজনীন এই দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও বাস্তবে মহালয়া থেকে উৎসবের সূচনা এবং লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। কুমারী পূজা দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শাস্ত্র মতে ১ বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প অবিবাহিত সুলক্ষণা ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যাকে পূজা করা হয়। নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড়ে দেবীর মতো সাজিয়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়। ১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুড় মঠে এই কুমারী পূজার প্রচলন করেন। হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, চিরবিধবাসহ নানা অবিচারে তখন নারীরা ছিল নিপীড়িত। নারীকে দেবীর আসনে সম্মানীত করার জন্যেই হয়ত স্বামী বিবেকানন্দ এই পূজার প্রচলন করেন। প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণ সাধন এই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। সন্ধিপূজা, দুর্গাপূজার আরও একটি বিশেষ অংশ। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিট সময়ে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে এই পূজা হয় বলেই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা।

ইতিহাসে দেখা যায়, দুর্গাপূজাটা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে। লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মতো এর ব্যাপকতা ছিল না অর্থনৈতিক কারণে। দুর্গাপূজা করতে অনেক আয়োজন করতে হয়। চলেও চার-পাঁচ দিন ধরে। আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে এ পূজা করা সম্ভব নয়। যাদের ঘরে চাল বাড়ন্ত, চার-পাঁচ দিনের পূজা, তাদের চলবে কেন? অনেক দেব-দেবীর একত্র অধিষ্ঠান বলে এখানে পূজার সংখ্যাও বেশি। মহাদেব-লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের পাশে পূজা পায় কলা-বউও। এমনকি মহিষাসুরকেও পূজা দিতে হয়। ফলে এই মহা-আয়োজন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। ব্রিটিশ আমলে প্রতি গ্রামের দু-তিন ঘর সম্পন্ন পরিবার এই পূজা করত। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষও আনন্দ পেয়েছে বটে, তবে সেটা প্রসাদ পাওয়ার আনন্দ, বাদ্য-বাজনা শোনার আনন্দ, দূর থেকে দেখার আনন্দ! কামার-কুমাররা এটা-ওটা বানিয়েছে বিক্রি করার জন্য। সম্পন্ন পরিবারের সন্তানরা অর্থনৈতিক কারণে নতুন যুগের হাতছানিতে এগিয়ে যায়। তারা ব্যবসা বা লেখাপড়াতে নিবিষ্ট হয়। সেই সূত্রে বাড়ির বাইরে, অন্যত্র অবস্থান বা প্রতিষ্ঠা ঘটে তাদের। দেখা গেছে, পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা হওয়ায় পূজার সময় সেসব পরিবারের সন্তানরা বাড়িতে একত্র হয়। এ থেকেই ঐক্য ধরে রাখে পরিবারটি। অবশ্য একই বড় পরিবারে একাধিক পূজাও হয়েছে; ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়।

এবারকার অবস্থা হলো করোনা-উত্তর শারদীয় দূর্গা পূজা যা সকল স্বাস্থ্য বিধি মেনেই উৎসব পালিত হবে বলে জানিয়েছেন পূজা উজ্জাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং গত ২০১৯ সালে সারা দেশে প্রায় চার হাজার এর বেশী পূজা সারা বাংলাদেশে  অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার ব্যতিক্রম গত বছরে হয়েছে ও বর্তমান বছরেও হবে বলে প্রতিয়মান হয় যেহেতু করোনার মহামারী দেশের অর্থনীতিকে অনেকাংশে ক্ষতবিক্ষত করেছে, প্রায় ২৭ হাজারেরও বেশী  মানুষকে মৃত্যর মুখে ঠেলে দিয়েছে, আড়াই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য বানিয়েছে এবং জীবিকার উপর  যার প্রভাব এবারকার শারদীয় উৎসবে প্রতিফলিত হবে নিশ্চয়, যদিও সরকার পূজা উজ্জাপনের জন্য  বাজেটের বরাদ্ধ দিয়েছে সারা দেশে তার প্রশাসনিক কমিটির মাধ্যমে। তার পরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে পূর্বেকার মত এবার সে রকম জাকজমক নাও হতে পারে। করোনার প্রভাব এখনও কাটেনি, যদিও সংক্রামনের হার এখন পর্যন্ত ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। তারপরও সরকারের প্রচেষ্টায় অর্থনীতি  ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তার আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে যা কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন আসা যাক শারদীয় দূর্গা পূজার সাথে সংশ্লিষ্ট  ব্যবসা বানিজ্য তথা অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে এবং ফূল একটি পূজোর উল্লেখযোগ্য উপকরন যা ভিন্ন রংয়ের ভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এবার এই দুস্প্রাপ্য ফুলের জোগান কে দেবে? কারন দেশের স্থানীয় পর্যায়ে যে ফুল হয় তা দিয়ে হয়ত গ্রামের পূজারীর কোন ভাবে সামলাতে পারবে কিন্তু ঢাকা সহ বিভাগীয/জেলা শহরে পূজার ফুল সরবরাহ হতো যশোরের গদখালী থেকে যা করোনার কারনে বিপদগ্রস্থ হয়ে গেছে এবং চাষীরা এখন ফুলের জমিতে শব্জী কিংবা ধানের চাষ করছে কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে। শারদীয় উৎসবকে ঘিরে ব্যবসা বানিজ্যের যে প্রসার তা এই খাতটিকে প্রসারিত করে থাকে যেমন ফুল-ফল, ডাকি, বাদ্য বাজনা, কাপড় বিতরন, প্রতিমাশয্যা, অলংকরন, মুদ্রণ শিল্প, ভোগ্য পণ্য যেমন চাল, ডাল, শব্জী ক্রয় বিক্রয়, কুমার, মৃতশিল্পি, ডেকোরেটর, খেলনা-মিষ্টি ইত্যাদি। আবার সামাজিক/সংস্কৃতির বলয়ে এই পূজার গুরুত্ব অপরিসীম, যেমন শিল্পীদের ভক্তি মুলক গান, ডগ যাত্রা, লক্ষীবিলাস, নৌকা বিলাশ, নিমাই সন্নাস যার সাথে তাদের আয় উপার্জনের অর্থনৈতিক কাজকর্ম জড়িত খাকে। প্রতি বছরই এই দিনটির জন্য ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় খাকে, যা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক উন্নয়নের এক অপূর্ব নিদর্শন বটে। পূজা উপলক্ষে গ্রামীন মেলা বিশেষ পূজা মন্ডব কে ঘিরে যা করোনার কারণে গত বছরের মত এবারও বিঘ্নিত হতে পারে, যা মেলার সাথে জড়িত ব্যবসায়িদের ক্ষতির কারন হতে পারে। এর মাধ্যমে মিডিয়ার বদৌলতে জানা যায় প্রতীমা সামগ্রীর দাম, মৃত শিল্পীদের বায়না, পতিতালয়ের মাটির দাম (যা মূর্তি তৈরীতে ব্যবহৃত) চরমে উঠেছে। ফলে পূজার ব্যয়ও বাড়বে, পূজারিদের আয়োজনও কমাতে হবে এবং স্বাস্থ্য বিধি মানাও বাধ্যতামূলক থাকবে যা এরি মধ্যে সার্বজণীন পূজা উজ্জাপন কমিটি ও ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ ঘোষনা দিয়েছেন। তাই পূজার সামষ্টিক অর্থনীতি দেশের সার্বিক  অর্থনীতির কাঠামোতে অবশ্যি বিবেচনায় আনতে হবে এবং নিরুপন করতে হবে বিশেষত: করোনাকালের পরিস্থিতির বিবেচনায়। এখানে উল্লেখ্য যে শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলের হাওয়ার নাচন আর আগমণী ঢাক শাখের আওয়াজ যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় গ্রাম-নগর, ধনী-গরীব, ছোট-বড় এই শরতের মিলনোৎসবে।

লেখক: গবেষক ও ডীন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)