বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৪

নাসিক নির্বাচন ২০২২: গণতন্ত্র ও শান্তির মহামিলন

ড: মিহির কুমার রায়: দেশে অনেক দিন পর ভালো একটি নির্বাচন হলো। সংঘাত-সহিংসতার পথ এড়িয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যে সম্ভব তার উজ্জ্বল উদাহরণ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন, কারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীই চেয়েছেন নির্বাচন ভালো হোক। আর এ কারণেই সেখানে সংঘাত-সংঘর্ষহীন সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হতে পেরেছে। নাসিক নির্বাচন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ইসি যদি ঠুঁটো জগন্নাথও হয় কিন্তু ক্ষমতাসীনরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। আর নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সেটা জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে। নির্বাচনটি স্থানীয় হলেও দেশের জনগণের দৃষ্টি নির্বাচনে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ছিল। প্রতিদ্বন্ধী দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন আলোচিত হচ্ছিল। জয়ের জন্য প্রতিনিয়ত নিজেদের মতো করে কৌশল নিয়ে চলছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার এর মধ্যে অনুশিলন। প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণাও যে সহিংসতামুক্ত থাকতে পারে, তার সত্যতা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি।  এবারের নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে এবং ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মোট ১৮৭টি ভোটকেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭ ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ জন, মহিলা ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৪ জন। এ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট দেবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিশ্লেষনে দেখা যায় শতকরা ৫০ ভাগের কিছু বেশী ভোট কাষ্ট হয় যেখানে নৌকা মার্কার প্রার্থী ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছে ১,৫৯,৩৯৭ ভোট এবং হাতী মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছে  ৯২,৫৬২ ভোট। ১৬ জানুয়ারির এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বারের মতো নাসিক মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী। ফলাফলে আরও দেখা যায় যে এই নির্বাচনে সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের ১৮ জন, বিএনপির ১৪ জন, জাতীয় পার্টির দুইজন, বাসদের একজন এবং নির্দলীয় একজন বিজয়ী হয়েছেন। বিজয়ীদের অধিকাংশই সাবেক কাউন্সিলর ছিলেন এবং নির্বাচিত ৩৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জন নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।  মেয়র পদে এবার ৬৯ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে জিতলেন আইভী। এর আগে গত দুই নির্বাচনে প্রথমবার লক্ষাধিক ভোট এবং দ্বিতীয়বার প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলেও লক্ষনীয় যে এবারের ভোটের ব্যবধান কমেছে। ডা. আইভী ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায়ও ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐ সময় থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এবারের এই নির্বাচনটি বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা দেশের পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষনীয় হতে পারে। নির্বাচন শেষে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে টানা তিন বার মেয়র পদে জয় পেলেন যা নারী নেত্রী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি উদাহরণ হয়ে রইল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো আইভী  নৌকার প্রার্থী যার সাথে স্থানীয় দলীয় সাংসদের সম্পর্ক ভালো নয় যা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে অবলোকন করেছি, তার পরও  সততা দিয়ে নিজের যোগ্যতায় বলিয়ান হয়ে তিনি বিজয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন সেটাই সত্য। নারায়ণগঞ্জে একটি নদী বন্দর কেন্দ্রীক  শিল্পবানিজ্য শহর যেখানে সেলিনা হায়াৎ আইভীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তার পিতার পরিচয়ে রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে। মেয়র হিসেবে আইভী নারায়ণগঞ্জ শহরটাকে জানতে চেয়েছেন নিজের মনে করে যেমন প্রতিটি ওয়ার্ডের অবস্থা, জনগনের সমস্যা এবং  তার সমাধানের উপায় সম্পর্কে যা সত্যিকারের নেতা হতে প্রয়োজন যেমন সততা, বুদ্ধি, প্রকাশের ক্ষমতা, বিচারক্ষমতা, প্রশ্ন করার মানসিকতা, মতামত গ্রহনের ইচ্ছা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা, তিক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা, সীমাহীন উৎ্সাহ, চিন্তাভাবনায় আধুনিক মননশিলতা ইত্যাদি।  তারপর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরদিন সেলিনা হায়াৎ আইভী  স্বতন্ত্র প্রার্থী এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের বাড়ীতে যান মিষ্টি নিয়ে এবং চাচা বলে সম্ভোধন করে তাকে মিষ্টি তোলে দেন মুখে যা চাচা - ভাতিজীর সম্পর্ক হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হলো যা সম্প্রিতীর একটি কৌশল বটে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার যে বার্তাটি দেওয়ার চেষ্টা করেছে তা  হলো সরকারের উপর জনগণের আস্থা বজায় রাখা যার মাধ্যমে কি ভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়। সাম্প্রতিক কালে সরকার  অনেক দিক থেকেই চাপে আছে,  বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর ক্ষিপ্ত যার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক সামিটে বাংলাদেশকে নিমন্ত্রণ জানায়নি। কারন নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে দেশে-বিদেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন- এগুলোর জন্য সরকার অভ্যন্তরীণভাবে বেকায়দায়। সবাই দাবি করছে, এ ব্যাপারে আইন হোক। কিন্তু সবার দাবি অগ্রাহ্য করে পুরোনো পথেই তারা হাঁটছে, যে পথের মাধ্যমে তারা অতীতে তাদেরই অনুগতদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়েছে এবং কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করেছে। এবার সরকার একটা আস্থা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

সরকার ভাবছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন যার মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হবে না এবং এ নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হলেন তারকা প্রার্থী। যার পাহাড় সম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারকা প্রার্থীই জিতেছেন কারন তার ব্যাপক জনসমর্থন আছে, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সজ্জন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ দুদকে নেই, তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক, তার একটি ভোটব্যাংক আছে এবং শেষে তাদের প্রার্থীই জয়ী হয়েছেন। কিন্তু যে বার্তাটি তারা মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে, সেটা তারা ২০১৩ সালেও দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখানে উল্লেখ্য যে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এরপরও পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সবকটিতে তাদের অনেক ভালো প্রার্থী থাকা সত্বেও তারা ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হেরেছিল। কারণ তারা সেখানে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেনি। তখনো তারা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়া সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এখন নাসিক নির্বাচনে সরকার যে বার্তাটি দিল, সেটা মানুষ কিভাবে নেবে তা দেখার বিষয়।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ


Comment As:

Comment (0)