Arif Bepza

কতিপয় দেশের অর্থনীতির ধ্বস এবং পুনরুত্থানের ইতিবৃত্ত 

আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: ব্যক্তির জীবনে যেমন উত্থান পতন রয়েছে, তেমনি একটি রাষ্টের জন্মলগ্ন থেকে পরবর্তীতে অর্থনৈতিকভাবে অনেক চড়াই-ঊতরাই পেরিয়ে আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। অর্থনীতির গতিপথ সম্পর্কে বিভ্রম থাকা, অপ্রয়োজনীয় উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটি দেশের অর্থনীতির ধ্বসের নিয়ামক। গত এক দশকে জিম্বাবুয়ে, গ্রীস এবং শ্রীলংকার অর্থনৈতিক ধস বিশ্বের তাবত পরিকল্পনাবিদদের চিন্তার দুনিয়ায় মারাত্বকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ধরুন আপনি কোন দেশে বেড়াতে গেলেন সাথে করে নিজের ব্যবহারের লাগেজ এর সাথে এক্সট্রা কয়েকটা বস্তা নিয়ে যাবেন ঐদেশের মুদ্রা বহনের জন্য। কেনইবা নিবেন না, যদি আপনাকে এক বোতল পানি ক্রয় করতে ১ মিলিয়ন ডলার খরচা করতে হয়! হ্যাঁ জিম্বাবুয়ের কথাই বলছি। ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার আগে দেশটির নাম ছিল সাউদার্ন রোডেশিয়া। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর রোডেশিয়ান ডলার বিলুপ্ত হয় এবং স্বাধীন দেশটি “জিম্বাবুয়েন ডলার” চালু করে। জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি তখন অনেক ভালো ছিল। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল বিপুল পরিমান উৎপাদিত গম এবং তামাকজাত পণ্য। আর জিম্বাবুয়ের মাটি ছিল উর্বর। শুনে অবাক হবেন ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর জিম্বাবুয়েন ডলারের মান মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা অর্জন থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশটির অগ্রগতি আশাব্যঞ্জ্যক। ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মাঝে বেশকিছু ইকোনমিক রিফর্ম বা সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। কৃষি খাতে মুগাবের চরম অব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক ধ্বসের এক অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯২ সালের ‘ভূমি অধিগ্রহণ আইন’-এর আওতায় শ্বেতাঙ্গদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে সরকারি আওতায় তা কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে এই আইনের বিরোধীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জিম্বাবুয়ের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উৎপাদন ৫০% হ্রাস পায়, একই সাথে শিল্প উৎপাদনও ৩০% কমে যায়। সমালোচকদের দাবি ছিল, জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার পর গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা বন্টন এর পরিবর্তে তিনি নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের ঐসবের দায়িত্ব দেন। দ্রুতই জিম্বাবুয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা দেশগুলোর একটি থেকে দ্রুত বিদেশি ঋণ নির্ভর দেশে পরিণত হয়। ব্যাংকসমূহে তারল্য না থাকায় একদিকে শিল্প খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছিল না অন্যদিকে কৃষকরাও ঋণ পাচ্ছিল না। তখন শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক লোক বেকার হয়ে পড়ে। তখন প্রায় ৮০% লোক বেকার হয়ে পড়ে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের জীবন যাত্রার মান কমে যায়। সব মিলিয়ে অর্থনীতির সবগুলো সূচক নিম্নমূখী হতে থাকে। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে যেতে থাকল। আগে যে পণ্য ১০০ জিম্বাবুয়ান ডলার দিয়ে ক্রয় করা যেত সেটি ক্রয় করতে ব্যয় হচ্ছিলো ১০,০০০ জিম্বাবুয়ান ডলার। জিম্বাবুয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অবস্থার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, IMF এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দায়ী ও দোষারোপ করে। কারণ সেসময় জিম্বাবুয়ের উপর এই দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ে কংগোতে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় মূলতঃ এই যুদ্ধ থেকে জিম্বাবুয়েকে বিরত রাখতেই দেশটির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় জোট। 

যেকোন দেশের অর্থনীতির মূলকাঠামো টেকসই করতে হলে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামালের স্থানীয় যোগান বৃদ্ধি করা, মূদ্রাস্ফীতির হার সহনীয় রাখা, জনগনের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস না পাওয়া, জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমান সাধারণ মানের উপরে না যাওয়া ইত্যাদি করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি সকল রেকর্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল। ফলে দেশটির আর্থিক কাঠামোতে অবিশ্বাস্য ধকল লাগে। তারা বারবার অর্থনীতিতে বিভিন্ন রিফর্ম করার চেষ্টা করতে থাকে, নতুন নতুন মূদ্রা ব্যবস্থা চালু করে, কারন তাদের দেশীয় মুদ্রার উপর জনগনের বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুগাবের পরবর্তী বর্তমানে জিম্বাবুয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাদের প্রবাসী লোকজন বিপুল পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা দেশে প্রেরণ করছে। এর ফলে তাদের বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভও এখন সমৃদ্ধ হচ্ছে। তারপরও বর্তমানে জিম্বাবুয়ের মোট জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের হার ৭৭ শতাংশ, বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি হার প্রায় ১৩২%, বেকারত্বের হার ৫.৭ এবং মাথাপিছু আয় ১২১৪.৫ ডলার, জিডিপি বৃদ্ধির হার -৬.২% মোট জিডিপি ১৮.০৫ মার্কিন ডলার (সূত্রঃ বিশ্ব ব্যাংক,২০২০)। 

গ্রিসঃ ঠিক কবে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গ্রিসের জন্ম হয়েছে তা নিয়ে বির্তক আছে। অনেক গ্রিক নাগরিক মনে করেন, ১৮২৭ সালের পহেলা মে ত্রোজানে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় অধিবেশনের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গ্রিস আত্মপ্রকাশ করে। তবে ১৮৩০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারির আগে ইউরোপের কোনো বড় শক্তি সার্বভৌম দেশ হিসেবে গ্রিসকে স্বীকৃতি দেয়নি। কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে ১৮২৩ সালের ৩০ নভেম্বর দেশটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করেছিল। কারণ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্যরা স্বীকৃতি না দিলেও গ্রিকরা এ দিনই বিরাট এক ঋণ গ্রহণ করেছিল। গ্রিকরা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ব্রিটিশ ব্যাঙ্কার সমিতি থেকে ঐ দিন গ্রিস ৮,০০,০০০ পাউন্ড ঋণ নেয়, যার একটি বড় অংশ অস্ত্র ক্রয় কাজে ব্যয় করা হয়। এর চার বছর পর অদৃশ্য গ্রিস রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, দেউলিয়াত্বের কারণে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ১৮৯৩ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চ্যারিলোস ট্রিকৌপিস গ্রিসকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক থ্যানোস ভার্মিস বলেন, প্রধানমন্ত্রী ট্রিকৌপিসের সময় যে কারণে গ্রিস দেউলিয়া হয়েছিল তার সাথে দ্বিতীয় দেউলিয়াত্বের কারণ একেবারেই ভিন্ন ছিল। তার মতে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের অর্থ ১৮২১ সালের বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে ব্যবহৃত হয়েছিলো। সে সময় কাগজে-কলমে গ্রিস দেশটির অস্তিত্বই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী চ্যারিলোস ট্রিকৌপিসের সময়ের দেউলিয়াত্ব অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের ফলে সৃষ্টি হলেও গ্রিসের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হয়েছিল। তার সময়ে তৈরি হওয়া রেলপথগুলো এখনও গ্রিসে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৩২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইলেফথেরিয়স ভেনিজেলস অর্থনৈতিক অবনতি এবং স্বর্ণ ও পাউন্ডের বিপরীতে গ্রিক ড্রকমার অবমূল্যায়নের পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই  প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ থ্যানোস ভার্মিস বলেন, ইলেফথেরিয়স ভেনিজেলোস ও প্যানাজিস স্যাল্ডারিসের সময়কালীন দেউলিয়াত্বের ফলে গ্রিস অভ্যন্তরীন অর্থনীতি ও গ্রামীণ উন্নয়নে নজর দিতে বাধ্য হয়। নিজস্ব স্বনির্ভরতার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষজন উভয় সময়ই সংকটজনক পরিস্থিতির বাইরে ছিল। শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাই ছিল সমস্যার প্রকৃত ভুক্তভোগী, যাদের সংখ্যা আজকের তুলনায় খুবই কম ছিল। গ্রিসের সেই সময়কার নাজুক আর্থিক পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল মূলত ভারী শিল্পের অনুপস্থিতি, অতি সামান্য রপ্তানি আয় ও পর্যটনের অনুপস্থিতি। কালের বিবর্তনে জাতীয় লাভের অনুপস্থিতি ও শহুরে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের ফলে গ্রামাঞ্চলের স্বনির্ভর মানুষের সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে গ্রিসের দেউলিয়াপনা গ্রিকদের অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। ১৯৮১ সালে গ্রিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। ১৯৯৬ সালে গ্রিস  অলিম্পিক গেমস আয়োজন ও ইউরো জোনে প্রবেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইউরো জোনে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ কাগজে-কলমে ভালো ফল দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। বর্তমানে ইউরোপের অনেক নেতা সে সময় মিথ্যা পরিসংখ্যান দেওয়ার জন্য গ্রিসকে দায়ী করেন। তবে সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপ অঞ্চলে অর্থনেতিক গতি বেগবান করার কাজে ব্যস্ত থাকায় গ্রিস ভুল তথ্য দিয়েও তখন পার পেয়ে যায়। ২০০৪ সালের আগ অবধি গ্রিস অর্থনীতি একটি কৃত্রিম সমৃদ্ধির বুদবুদের উপর ভেসেছিল। গ্রিসের রাজপথে ছিল নতুন গাড়ির ছড়াছড়ি, ক্রেডিট কার্ড আর সহজ শর্তের ঋণের কারণে গ্রিকরা হয়ে উঠেছিল অতিমাত্রায় বিলাসী। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে গ্রিসের ব্যাংকসমূহ লোকজনকে অবসর বিনোদনের জন্যও যে কাউকে ঋণ দিতে শুরু করলো। গ্রিসের আর্থিক সংকট গোটা দুনিয়ায় প্রভাব ফেলেছে, পরিণামস্বরূপ গ্রিস ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু এই সংকটটা ধীরে ধীরে অনেক সময় ধরে ঘটেছে। এই আর্থিক সংকটের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল গ্রিক সমাজ ব্যবস্থার ওপর। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ২০ হাজারের বেশি গ্রিক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এথেন্স নগরীর ২০% এর বেশি দোকান খালি ছিল। ২০% গ্রিকের নাগরিক দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। এই গৃহহীনতার সমস্যা তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সরকার কোনভাবেই তাদের আর্থিক সাহায্য দিতে সক্ষম হচ্ছিলনা। 

অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, তথ্য গোপন ইত্যাদি গ্রীক অর্থনীতি ধ্বসের অন্যতম কারন ছিল। শুধু যে আর্থিক/ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো কারচুপি করত তাই নয়, সরকারী মদদেও কারচুপি সংগঠিত হতো। ২০১০ এর শুরুতে দেখা গেছে যে গ্রিক সরকার গোল্ডমান সাক্স ও অন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষাধিক টাকার ফিস দিয়েছে শুধু তাদের প্রকৃত ঋণের তথ্য গোপন করতে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রস কারেন্সী স্বপ (cross currency swap) যেখানে কোটি কোটি টাকার গ্রিক ঋণ ডলার অথবা ইএনে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল একটি ভুল এক্সচেঞ্জ রেটের কারনে| ঋণ করে রাষ্ট্র যে দেউলিয়া হতে পারে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ গ্রিস ও শ্রীলংকা। গ্রিসের বৈদেশিক ঋণ দেশটির মোট জিডিপির ১৭৭% আর ৩২% লোক দ্রারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, গ্রিসের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ইউরোই দায়ী। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় এই মুদ্রা ব্যবস্থা। ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পূর্বে ঋণদাতা গোষ্ঠি গ্রিসকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করত। ফলে এখানে অতিরিক্ত অর্থলগ্নিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করত। কিন্তু ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে আর বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করেনি। ঋণদাতা গোষ্ঠি তখন দেশটিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিতে শুরু করে। সে সময় ঋণদাতারা দেশটিকে মধ্য আয়ের দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করেনি। ফলে তারা জার্মানিকে যে সুদে ঋণ দিয়েছে, সেই একই হারে গ্রিসকেও ঋণ প্রদান করে। ভুল তথ্য, কাল্পনিক চিন্তা অবিবেচনা প্রসুত উচ্চাভিলাসি প্রকল্প গ্রহন (যে সকল প্রকল্পে প্রচুর বৈদেশিক ঋণ গ্রহন করা হয়) দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। যে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে গ্রীসকে। বৈদেশিক ঋণের সাগরে ভাসতে থাকা গ্রিসের বর্তমান জিডিপি ১৮৯.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাথাপিছু আয় ১৭৪৩৬ মার্কিন ডলার। গ্রিস সরকারের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস আন্তর্জাতিক ঋণ দাতাদের চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ২০১৫ সালের ৫ জুলাই একটি গণভোটের আয়োজন করে এবং গণভোটে না পক্ষ বিজয়ী হয়। এ গণভোটের বা ন্যায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশটির জনগণ ঋণ দাতাদের দেওয়া কঠোর কৃচ্ছ্রতা সাধনের শর্ত সংবলিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব (বেইল আউট) প্রত্যাখ্যান করে। বেইল আউট হলো কোনো দেশকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির নাম। গ্রিসে বর্তমানে ধীরে ধীরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকার সমস্যা অনেকটা লাঘব করে বাহির থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার ঘোষনা দিয়েছে। অর্থনীতি রিফর্ম এবং কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে দেশটি বর্তমানে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।  

শ্রীলংকার চলমান সংকট এর বিষয়ে কমবেশী সকলেরই জানা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতোটা দুরাবস্থায় পড়েনি দেশটি। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীংলকা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তারা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয়ও ঠিকঠাকমত পরিশোধ করতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া (সূত্রঃ বিবিসি)। গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, বড় বড় রাস্তা নির্মান, নতুন শহর এবং আরো নানা ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বলেন, কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য 'শ্বেত হস্তীতে' রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। অধ্যাপক আবিরত্নে বলেন, গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের পাশাপাশি শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্য। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ঔষধ সংকট ছাড়াও বিদ্যুৎহীনতার মধ্যেই দিন কাটছে শ্রীলংকানদের। ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর প্রাণ ফিরে এসেছিলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, জমজমাট হয়ে উঠছিলো পর্যটনসহ সেবা খাত। সমালোচকরা বলছেন, শ্রীলংকা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সংকটের মূলে রয়েছে বিগত কয়েকটি সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। উচ্চাভিলাসি মেগা প্রকল্প, দুর্নীতি, সঠিক যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটি রাষ্ট্রকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিনিত করতে পারে তার বড় উদাহরণ এই দেশটি। 
দেশের বৈদেশিক ঋনের যথাযথ ব্যবহার না হলে রাষ্ট্রকে চরম মূ্ল্য দিতে হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির রিজার্ভ ছিল মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু, ২০২২ সালে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের মুখোমুখি হতে হয় শ্রীলংকাকে। যার মধ্যে গত জুলাইয়ে পূর্ণ হওয়া ১ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড (আইএসবি) আছে। শ্রীলংকা বৈদেশিক ঋণের বৃহত্তম অংশ আইএসবি। যার পরিমাণ ১২.৫৫ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণদাতাদের মধ্যে আছে - এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান এবং চীন (সূত্রঃ ডেইলী ষ্টার)। 
শ্রীলংকা দক্ষিণ এশিয়ার একটি শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ছিল, তাদের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল তৈরি পোশাক রফতানি দিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম পা রাখা শ্রীলংকা নির্ভরশীল ছিল পর্যটনেও। শিক্ষিতের হার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী ছিল এবং সামাজিক সূচকে শ্রীলংকা ছিল সবার চেয়ে সামনের কাতারে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার হয়, যা প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি দেশটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে শ্রীলংকা ক্রমশঃ পেছাতে শুরু করে। এমনকি আশির দশকে বাংলাদেশে যে তৈরি পোশাক শিল্প অগ্রযাত্রা সেটি সম্ভব হয়েছিল বিনিয়োগকারীদের শ্রীলংকা থেকে সরে আসার কারনে। ক্রেতারা মূলতঃ শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটিতে বিনিয়োগ করতে ভয় করার কারণেই, পরবর্তীতে চেষ্টা করেও শ্রীলংকা সেই অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য অনেক শ্রীলংকান বায়িং হাউস বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করে এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রীলংকানদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। 

শ্রীলংকা বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র। উপমহাদেশের কোনো একটি দেশে কোনো নেতিবাচক প্রভাব বা পরিবর্তনের হাওয়া লাগলে তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলিতে কমবেশী পড়ে থাকে। বাংলাদেশকে সতর্ক হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ তথা রাষ্টীয় পরিকল্পনাবিদগণ। মূলতঃ বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ, বৈদেশিক রেমিটেন্স, সস্তা শ্রম এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের ভালো রির্পোট আমাদের অর্থনীতিকে একটি সস্তির জায়গায় রেখেছে। ক্রমবর্ধমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব পদ্মা ও রুপপুরের মত বাস্তবিক মেগা প্রকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের আরো দূর বহুদূর নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। যেহেতু অনেকেই বর্তমানের এইদুটি রাষ্টের মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করে থাকেন বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা অর্থনীতির তুলনামূলক অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে শ্রীলংকার মোট ঋণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যেহেতু দেশটির মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ, সে হিসাবে শ্রীলংকা মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট ঋণ ৪৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার। যেহেতু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ, সে হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২.১১ ডলার। 
বাংলাদেশের চেয়ে শ্রীলংকার মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় ছয় গুণ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে শ্রীলংকা রেমিট্যান্স ছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। একই অর্থবছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ছিল ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা শ্রীলংকার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। শ্রীলংকা রপ্তানি আয় কমে যাওয়াকে বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে শ্রীলংকা রপ্তানি আয় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি আয় শ্রীলংকার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। মার্চ ২০২২ পর্যন্ত শ্রীলংকার রিজার্ভের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪.৪০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ শ্রীলংকার চেয়ে ২২ গুণ বেশি। ‘অর্গানিক কৃষি’ চালুর কারণে শ্রীলংকা কৃষিজ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, সে পথে না হেঁটে বরং বাংলাদেশ ক্রমেই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল, কিছু ঝুঁকির কথা অনেক অর্থনীতিবিদগণ উল্লেখ করছেন, যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার। যখন কোন দেশের অর্থনীতি ভালো করতে থাকে, তখন সেদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শ্রেণী বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদি এসবের রাশ টেনে ধরা না যায়, তা সমৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না। বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুসাহিত করে রাষ্টের অভ্যন্তরে এমন কিছু যেন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে এই বিষয়টি খেয়াল রাখা অত্যান্ত জরুরী। যদি বাংলাদেশ এই বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় বা বাধাগ্রস্ত হয়, সেটি বাংলাদেশকে আবার অনেক পিছনে নিয়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের সুষ্ঠ পরিবেশ অব্যাহত রেখে এবং ঋণ গ্রহনে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে যে কোন সংকট মোকাবেলা করে দেশ এগিয়ে যাবে।
 
লেখকঃ আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, উপ পরিচালক বেপজা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)