মুনতাসীর মামুন

মতামত/বিশ্লেষণ

দেশে পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আইন ও ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠন জরুরী

মুনতাসীর মামুন: পৃথিবীর সব উন্নত দেশে এমনকি অনেক উন্নয়শীল দেশেও Occupational Health and Safety (পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা) আইন এবং Compensation Commission (ক্ষতিপূরন কমিশন) রয়েছে।

উপরোক্ত আইনে পেশাগত বিপদ-আপদ নিয়ন্ত্রনে বিভিন্ন রকমের নিয়ন্ত্রনমূলক ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষনের বিষয়াদি যুক্ত রয়েছে। বিপদ দূরীকরনে সবরকম যথাপোযুক্ত নিয়ন্ত্রনমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের পরও যদি দূর্ঘটনা ঘটে এবং সে দূর্ঘটনায় কারও জীবন যায় বা পঙ্গু বা আহত হয়- তার চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরন ব্যবস্থা করার বিষয়টি দেখে ক্ষতিপূরন কমিশন।

প্রতিবছর বাংলাদেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন দেয়, পঙ্গু এবং আহত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরী ও কনস্টাকশন কর্মী। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক কোনো সরকারী পরিসংখ্যান আমাদের দেশে আছে বলে জানা নাই।

পেশাগত বিপদের ঝুকি নিয়ন্ত্রনের কতগুলো পর্যায় বা ষ্টেপ আছে, যেগুলো নিন্মলিখিত উপায়ে দূর করা যায়। সর্বোত্তম পন্থা হতে সর্বনিম্ন পন্থা হলো;

১। বিপদের ঝুঁকি দূরীকরন: যে সব কারনে বিপদ হতে তা অপসারন করা (slips, trips, falls, electricity, noise, vibrations, radiation, heat cold and fire, working at height above the ground level, underground machinery, water reservoir and overhead tank)।

২। ঝুকি প্রতিস্থাপন: ঝুকিযুক্ত  জিনিস অপসারন করা সম্ভব না হলে কম ঝুকিপূর্ন জিনিস দ্বারা তা প্রতিস্থাপন করা।

৩। প্রযুক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রন: প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করে ঝুকি নিয়ন্ত্রন করা।

৪। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন: ঝুকি নিয়ন্ত্রনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করা।

৫। ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি: কাজের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষার জিনিসপত্র পরিধান করা। যেমন: শক্ত ক্যাপ, ষ্টীল টু বোট এবং সুরক্ষা বেল্ট, গগল্স, (hard head, steel toe boat, fall arrest equipment, safety vests, safety glass, safety gloves etc)

উপরে বর্নিত ধাপগুলোর বিস্তারিত নীচে বর্ননা করা হলো:

১। বিপদের ঝুঁকি দূরীকরন(Elimination of Hazard): যেসব কারনে কর্মক্ষেত্রে বিপদ হতে পারে সেগুলো দূরীকরনের ব্যবস্থা করা। যেমন মাটি থেকে উপরে গিয়ে কোনো কাজ করা যেখানে নীচে পড়ে যাওয়ার ঝুকি রয়েছে- তা সম্ভব হলে মাটিতে নামিয়ে এনে করা, কন্সষ্ট্রাকশন যন্ত্রপাতি ও মালামাল এমনভাবে পরিচালনা করা বা রাখা, যাতে কর্মরত বা বাইরে কেউ এতে আহত না হয়, ক্ষতিকর বা দাহ্য কেমিক্যাল এমনভাবে ও স্থানে সংরক্ষন করা, যাতে কারও ক্ষতি না হয় বা আগুন ধরে না যায়, পানির ট্যাংক বা সেপটিক ট্যাংকে কাজ করার জন্য প্রবেশ করার পূর্বে কোনো মারাত্তক গ্যাস তৈরী হয়েছে কিনা- তা পরীক্ষা করে গ্যাস দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত ট্যাংকে প্রবেশ না করা, কর্মক্ষেত্রে কোথাও পানি জমে শেওলা হয়ে পিচ্ছিল হয়ে গেলে বা কোথাও শার্প জিনিসপত্র পড়ে থাকলে তা সরিয়ে ফলা, গার্মন্টেসে যে সব জায়গায় আগুন লাগার সম্ভবনা আছে- তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজের জায়গা থেকে পৃথক করা ফেলা। এরকম শত শত উদাহরণ দেয়া যাবে- যা দূরীকরনের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে বিপদের ঝুকি কমানো যায়।

২। বেশী ঝুকিপূর্ন কাজের বিকল্প ব্যবস্থা করা: জটিল প্রসেস, যন্ত্রপাতি, মারাত্নক কেমিক্যালের পরিবর্তে কম জটিল পদ্ধতির যন্ত্রপাতি বা কম ক্ষতিকর ক্যামিকেল ব্যবহার করে কাজ করা, মাটি থেকে অনেক উপরে কাজ করতে হলে পতন ঠেকানোর সরঞ্জাম(fall arreste Equipment) ব্যবহার করা।

৩। প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রন: সবকিছু এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে বিপদের ঝুকি কমে যায় যেমন গার্মেন্টসে বা ফ্যাক্টরীতে  স্মোক ডিটেকশনের ও সতর্কীকরণ ব্যবস্হা করা, পর্যাপ্ত দরজা, জানালা, সিঁড়ির ব্যবস্হা রাখা, যাতে আগুন লাগলে সাইরেন্ট বেজে ওঠে এবং কর্মরতরা সহজে বের হয়ে আসতে পারে, ব্রীজ বা বিংল্ডিং ছাদ ঢালায়ের পূর্বে ছাদের ওঠার সিডিএবং ছাদের চারদিকে রেলিং এর ব্যবস্থা কারা যাতে কেউ পড়ে না যায়, ঢালাইয়ের সময় সিডি বা ছাদ যাতে ভেংগে না পড়ে ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা সাপোর্টিং খুটিগুলো ডিজাইন করা।

 

৪।প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন: Occupational Health and Safety Act বিল তৈরী ও সংসদে পাশ করা এবং Compensation Commission গঠন করা। 

এই এক্টের আওতায় প্রত্যেকটি সরকারী ও বেসরকারী সংস্থায় যেখানে ২৫ জনের বেশী লোক কাজ করে এবং দূর্ঘটনা ও আগুন সম্ভবনা আছে সেখানে ৪.১ occupational health and safety committee থাকবে এবং ২৫ বছরের নীচের লোক কাজ করলে ৪.২ Health and Safety Representative থাকবে, তাদের ডিউটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।

তাদের কাজ হবে hazard recognition, evaluation and control, inspection program, incident and accident investigation program and Emergency preparedness।

ক। প্রতিটি সংস্থা উক্ত এক্টের সাথ সামঞ্জস্য রেখে আভ্যন্তরীন দায় দায়িত্ব বন্টন করবে, যারা ঝুকিপূর্ন কাজ করবে তাদের কিছু ট্রেনিং বাধ্যতামূলেক থাকবে। যেমন: First Aid, power line hazard, confine space entry, respiratory use, fall arrest, operation of mobile equipment, safe work practices and procedures।

 

খ। প্রত্যেকেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন, অবহেলার ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে।

গ।  কন্ট্রাকটর এবং কারখানা মালিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট পলিসি থাকবে, তারা এই পলিসি অনুযায়ী স্ব স্ব ক্ষেত্রে কর্মচারীদের Occupational health and safety নিশ্চিত করবে, তারা সঠিকভাবে পলিসি অনুসরন করছে কিনা সময়ে সময়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তা মনিটর করবে। কোথাও নিরপত্তার সামান্য ঘাটতি দেখার সাথে সাথে নির্মান কাজ বা কারখানা বন্ধ করে দিবে। নির্মাণকাজে বা কারখানায় নিয়োজিত সকল লোকদের ব্লান্কেট বীমা পলিসি থাকবে, কেউ আহত বা নিহত হলে এই পলিসি থেকে সে ক্ষতিপূরন পাবে।

 

৫।ব্যক্তিগত সুরক্ষা ট্রেনিং ও সরঞ্জাম:

ঝুকিপূর্ন কাজের সাথে যারা জড়িত থাকবে উপরে বর্নিত প্রশিক্ষন গুলো গ্রহনের পাশাপাশি মাথা, পা, হাত, শরীর, চামরা, শ্রবন প্রতিরক্ষা জন্য আইনে উল্লেখিত সরন্জাম পরিধান করবে এবং সঠিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য শ্বাস প্রশ্বাস প্রতিরক্ষা যন্ত্র ব্যবহার করবে।

এসব নিয়ম মেনে চললে দেশে দূর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমে আসবে বলে আমার কাছে মনে হয়।

লেখক: কানাডা প্রবাসী প্রকৌশলী ও বিশ্লেষক।

বিনিয়োগবার্তা/এমএম/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)