মিহির

স্বাস্থ্য বাজেট বনাম সুস্থ জাতি

ড: মিহির কুমার রায়: বিগত জুন ২০২২ - এর ৯ জুন তারিখে মহান জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপিত হয়েছে যা মোট জিডিপির ১৫.৩ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। সে অর্থে বাজেটের আকার বাড়ছে বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ১২.৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর বাজেটের আকার নির্ধারিত রয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যা জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিডিপির অংশ হিসেবে বাজেটের আকার ২ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে আনছে সরকার। এখানে উল্লেখ্য এক দিকে রয়েছে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন খাতে বরাদ্দসহ এবং প্রণোদনা-ভতুর্কি বাবদ ব্যয় বাড়ানোর চাহিদা,   অন্যদিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারে সংযত হওয়ার চাপ।

আমরা যদি স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্ধ বিশ্লেষন করি তাহলে দেখা যায় যে বর্তমানের প্রস্তাবিত  বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৩৬,৮৬৩ কোটি টাকা যা সার্বিক বাজেটের (৫.৪%),  বিগত বছরে যা ছিল ৩২,৭৩১ কোটি টাকা যা জাতীয় বাজেটের ৫.২%। জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে এ বরাদ্দ ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। আবার প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ যা জিডিপি ০.৯৫% অর্থ্যাৎ এ হার সবসময় জিডিপির ১% এর নিচেই থাকছে অব্যাহতভাবে যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে,  চিকিৎসায় জনগণের নিজস্ব/ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় দক্ষিণ এশিয়া এবং সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে আফগানিস্থানের পরেই বাংলাদেশে বেশি। এ বাজেট দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা উন্নয়নে কিরূপ ভূমিকা রাখবে সেটাই পর্যালোচনার বিষয়। সচরাচর মোট জাতীয় বাজেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বাস্থ্যখাতের জন্য। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়ানো প্রয়োজন।   তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে,  সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে  বৃদ্ধি পেয়েছে, স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বেড়েছে  তার চেয়ে বেশি হারে। এটিকে স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি বরাদ্দের চাহিদার প্রতি নীতিনির্ধারকদের সংবেদনশীলতা হিসেবেই দেখা যায়। এরপরও বলতে হবে যে,  পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় বেশ কম,  জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশের কারেন্ট হেলথ এক্সপেন্ডিচার  (সিএইচই) মাত্র ২.৩ শতাংশ,  মাথাপিছু সিএইচইর হিসাবেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী নেপাল, ভারত,  ভুটান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশের মাথাপিছু সিএইচই যেখানে ৪৫ ডলার,  সেখানে এই প্রতিবেশী দেশগুলোর যথাক্রমে ৫৮, ৭৩,  ১০৩ এবং ১০৭ ডলার।

এর চেয়েও বড় কথা হলো এই অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যয়েরও দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসছে দেশের জনগনের কষ্ঠর্জিত আয় থেকে অথচ বাংলাদেশের সংবিধান স্বাস্থ্যকে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ১৮(১) উপানুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন রোগ বা পঙ্গুত্ব না থাকলেই ভাল স্বাস্থ্য বলা যাবে না নাগরিকরা নিজেরা স্বাস্থ্য সেবার জন্য যে ব্যয় করেন তার আবার বড় অংশটি যাচ্ছে ওষুধ ও সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ তথা আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সামগ্রী বাবদ  (৬৭ শতাংশ)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের প্রস্তুত করা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কাজেই স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি যেমন  প্রতিবেশী দেশের ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সূচকের ভিত্তিতে করা যাচ্ছে,  তেমনি নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপের এই পরিসংখ্যান থেকে স্বাস্হ্যের বাড়তি বরাদ্দ কোথায় দিতে হবে,  সে সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে,  এই বরাদ্দের অনুপাত দ্বিগুণ করা গেলে স্বাস্থ্য ব্যয়ে নাগরিকদের অংশ ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। তবে এর বিতরণ হতে হবে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অনেক অর্জন সাধিত হয়েছে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত  যেমন জনসংখ্যা স্বাধীনতার পর দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেলেও জন্মহার ও মৃত্যুহার কমেছে, শিশু বয়সি জনসংখ্যা কমেছে,  পরিবারের জনসংখ্যা কমেছে,  শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে এবং সংক্রামক রোগ কমেছে এক্ষেত্রে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী সবচেয়ে ভাল অবদান রেখেছে। ১৯৭২ এর পরে যেখানে শিশু বয়সি জনসংখ্যার  (০-১৪ বছর) হার ছিল ৪৫.২%, এখন তা ২৬% নেমে এসেছে, বেড়েছে কর্মক্ষম জনসংখ্যা,  ধীরে ধীরে বেড়েছে বয়স্ক লোকের সংখ্যা যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন প্রয়োজন যা এই স্বল্প বাজেট দিয়ে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ হেলথ এ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভে (বিডিএইচএস), ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ৩৫ বছর ও তদোর্ধ নারীদের ৪৫% উচ্চ রক্তচাপে এবং ১৪%  ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০১১ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ৩২%  ও ১২%। এ বয়সি পুরুষের ৩৪% উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত,  যা ২০১১ সালে ছিল ১১%। যেহেতু এ হার প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বর্তমানের চিত্র আরও অনেক বেশি। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ৬৬%  পুরুষ এবং ৫০%  নারী জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। গবেষনার ফলাফলে আরও উঠে এসেছে স্ট্রোক,  হৃদরোগ, কিডনি রোগ,   স্থায়ুতন্ত্র ও চোখের রোগ বাড়ছে যার কারণে বাড়ছে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা। অসংক্রামক রোগের এ লাগামহীন বৃদ্ধি আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত করবে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে,  স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপে চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে দেশের ৪.৫১ শতাংশ জনগণ। আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে এ রকম ২ লাখ ৫০ হাজার রোগী বছরে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেছেন,  স্বাস্থ্য খাতে এখনই দু ধরনের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যথা এক,  বর্তমান স্বাস্থ্য খাতে চলতি বিনিয়োগ ব্যয় এবং কাঠামোগত সংস্কার জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ব্যয়। কারণ স্বাস্থ্য খাতের মাধ্যমে দেশের অবস্থার উন্নতি হলে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য,  পর্যটন ও রেমিটেন্সের সুযোগগুলো দ্রত কার্যকর করার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে,  চলতি বাজেটে দেশের জিডিপি ০.৯৫ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে এবং পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় তা জিডিপির ১.৬ শতাংশে উন্নতি করার প্রস্তাব ছিল। এখানে উল্লেখ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবা ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ তুলনামূলক পরিমন্ডলে সর্বনিম্ন এবং সামনে এগুতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ অবশ্যই বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যে সকল প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন তা প্রায় জিডিপির ৩.২ শতাংশ। সরকার চাইলে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নতি করতে পারে,  যার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ অঙ্গীকার প্রয়োজন।

তা ছাড়াও গ্রাম-শহরের মধ্যে চিকিৎসা সেবার বৈষম্য কমিয়ে সমানুপাতিক সুযোগ বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যা বর্তমান উন্নয়ন বাজেট দিয়ে ব্যয় সম্পন্ন সম্ভব নয় বিধায় এডিপিতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত,  স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দের ২২ শতাংশ ব্যয় হয় মেডিক্যাল শিক্ষায় অথচ আধুনিক শিক্ষা উপকরণ, গবেষণা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে তেমন কোন বরাদ্দ নেই, যা অবশ্যই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে; তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র মতে জানা গেছে, দেশের বর্তমানে কর্মরত ১০৫টি মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেসিক সায়েন্স বিভাগে মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষক নেই। বেসরকারী মেডিকেল কলেজ শিক্ষার মান নিয়ে খোদ প্রশাসনিক দফতরই অসন্তুষ্ট রয়েছে। যেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কিংবা গবেষণার কোন ব্যবস্থা বা বরাদ্দ নেই বিশেষত প্রাইভেট প্রাকটিস মনোভাবের কারণে যা থেকে মুক্তি পাওয়া সময়ের দাবি; চতুর্থত:  মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি থাকলেও তার কার্যত কোন বহি:প্রকাশ  চিকিৎসকদের আচরণের প্রতিফলন হচ্ছে না যার প্রভাব পড়ছে মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবার ওপরে। অথচ মেডিকেল ভর্র্তির পরপরই নাকি শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য পাঠ করানো হয় যে,  আর্ত মানবতার সেবায় তারা আত্মনিয়োগ করবে। একজন রোগীকে মানবিকতার আঁচলে বেঁধে তার রোগ মুক্তি ঘটাতে হবে, ব্যবসার পণ্য হিসেবে নয়। পঞ্চমত: আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে,  একটি পরিবারে বা গোষ্ঠীতে যদি একজন প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তা,  একজন চিকিৎসক কর্মকর্তা ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা থাকে তাহলে তাদের কোন কিছুতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার অর্থ দাঁড়ায় যে,  সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণে এই তিন কর্মকর্তার সহয়োগিতা কিংবা প্রতিপত্তি সেই পরিবার কিংবা গোষ্ঠীকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আবার এই তিনজনের মধ্যে চিকিৎসকের ওপর দাবিটা অনেক বেশি হওয়ায় সে এখন কোনদিকে যাবে?  নিজের পরিবারের আর্থিক দৈন্য গোছাতে নাকি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে!  এই ধরনের একটি সংঘাত বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছে,  যার একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে;  ষষ্ঠত: জনস্বাস্থ্য এখন সঙ্কটে।  কিন্তু বরাদ্দ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে মাত্র ১৩.৬৩ শতাংশ এবং পরিকল্পনা কমিশন বলছে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ খরচ হয় না। এর কারণ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতার অভাব। যেখানে স্বাস্থ্য প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ/চিকিৎসকগণ সময় দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থা না ঘোচাতে পারলে বাজেট বাড়িয়ে কোন সুফল পাওয়া যাবে না। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে সরকারকে সহযোগিতা করি স্কাস্থ্য সেবার উন্নয়নে। 

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)