মিহির

মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা বাজেট কতটুকু ভূমিকা রাখবে

ড: মিহির কুমার রায়: বর্তমান বছরের ১লা জুলাই থেকে বাজেট ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের  বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে যা ২০২৩ সালের ৩০শে জুন তারিখে শেষ হবে এবং এ বছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ১৫.৩ শতাংশ। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে চমক না থাকলেও বরাদ্দ বেড়েছে যার পরিমান ৮১ হাজার কোটি টাকা। মূল বাজেটের শিরোনাম করা হযেছে  'কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন'। এর আলোকে শিক্ষা বাজেট সেভাবে হতে পারতো। বাজেটের শিক্ষা অধ্যায়ে 'অতিমারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে বিশেষ উদ্যোগ' শিরোনামের ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদটি এ সংক্রান্ত হলেও ভেতরে বিশেষ উদ্যোগের কোনো কথা নেই।

'চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে,  যা গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা,'  আর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। এছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা,  যা গত অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে শিক্ষার এই তিন খাতের সঙ্গেই বর্তমান অর্থবছরের বরাদ্দের অঙ্ক তুলনা এটাই প্রমাণ করে যে এবার শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে। গত অর্থবছরে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য মঞ্জুরি হিসেবে এককালীন আট কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে, এবার সেখানে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হবে যা যথার্থই হয়েছে।

এবারের শিক্ষা বাজেটে শিক্ষার নতুন যে রূপরেখা অনুমোদন হয়েছে এবং নতুন শিক্ষাক্রম যে চলতি বছর থেকে আংশিক বাস্তবায়ন হচ্ছে তার তেমন কোন উল্লেখ নেই।  নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার খসড়া সরকার ২০২০ সালেই প্রণয়ন করে এর ওপর পরামর্শ আহ্বান করে যা ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ইতোমধ্যে এর পাইলটিংও শুরু হয়েছে এবং চলতি বছর থেকে প্রথম, দ্বিতীয়,  ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হওয়ারও কথা রয়েছে। এজন্য এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় আট লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে যার জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন হবে। বাজেট বিশ্লেষনে দেখা যায় যে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ মাত্র অথচ এই বরাদ্দ দিয়েই বলা হচ্ছে 'শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।' 

বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছর  শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ করে থাকে অথচ করোনার আঘাতে দু বছরের বেশি সময় বিদ্যালয় প্রায় বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি পূরণ করার জন্য এবং  ‘নতুন’ নামে  খ্যাত পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান বছরে অন্য বছরের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দরকার ছিল। কিন্তু এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ভাগ কমে হয়েছে জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ,  অথচ ভুটান এই খাতে জিডিপির ৭.২ শতাংশ,  ভারত ও পাকিস্তানের এ খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮ ও ২.৯ শতাংশ। জাতিসংঘের শিশু তহবিল দীর্ঘদিন শিক্ষাখাতে জিডিপির সাত শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছিল। তবে সংস্থাটি ২০১৫ সালের ইঞ্চিয়ন ঘোষণায় এই খাতে জিডিপির ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে। এর কম বরাদ্দে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪  (শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য) অর্জন করা যাবে বলে মনে হয় না। গত ৩০শে জুন বৃহস্পতিবার বাজেট পাসের দিন শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ছয় ভাগে যেতে হবে। আমরা তিন ভাগে আছি।'  

বাস্তবে জিডিপির ৩ শতাংশও বরাদ্দ হয় না অথচ বাজেটে মোট জিডিপির আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় 'শিক্ষা ও প্রযুক্তি বাজেট মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশ এবং প্রযুক্তি সহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক  বাদ দিয়ে চলমান সঙ্কেটে কেবল শিক্ষাখাতেই ১৫ শতাংশ বরাদ্ধ দেয়া উচিৎ বড় বাজেটে সীমিত বরাদ্দ মাত্র। 
সরকারের অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক মানের দিকে তাকালে এ বরাদ্দ অত্যন্ত নগণ্য। এখানে উল্লেখ্য যে বহু বছর যাবত শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১১-১২ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জাতিসংঘের সংঘ নইউনেস্কো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার জন্য যে সুপারিশ আছে তা প্রশংসনীয়। ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বারবারই বলে আসছে। একই দাবি আগামী দু-তিন বছর মেয়াদি একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি প্রণয়ন করা গেলে কভিড-১৯-এর ফলে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছে,  তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার,  শ্রীলঙ্কায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার;  শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটি মানসম্মত শিক্ষার কথা বিবেচনা করে একটি নিদৃষ্ঠ সীমার মধ্যে রাখা প্রয়োজন,  যা প্রাথমিক স্তরের জন্য ১:৩০, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য ১:৩৫ এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ১:২০ - এর বেশি নয় অথচ জন গুরত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতিফলন এ বাজেটে ঘটেনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সবক্ষেত্রেই মজুরি ও বেতন এবং প্রশাসনিক ব্যয় খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে  বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ প্রাথমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় বরাদ্দ মাথাপিছু অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি না করায় মূল্যস্ম্ফীতি বিবেচনায় তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এ খাতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি সহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নিঃশর্ত সুদবিহীন শিক্ষা ঋণ প্রবর্তন করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার বড় বেশি প্রয়োজন যা বাজেটে উল্লেখ নেই।

বেসরকারি গবেষণার ফলাফল বলছে, প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়েছে, শিক্ষায় অনেকের যে প্রায় দেড় বছরের শিখন শূণ্যতা তৈরি হলো, তা নির্ণয়ে কিংবা পোষাতেও কোনো উদ্যোগ বাজেটে উল্লেখ নেই। করোনায় শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে,  তা পুষিয়ে নিতে বাজেট বরাদ্দের অন্তত ২০ শতাংশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য রাখা দরকার ছিল। অথচ রাখা হয়েছে ১২ শতাংশ। যেখানে দেশীয় ল্যাপটপ একেবারে চাহিদা পূরণ করতে পারছে না,  সেখানে আমদানি করা ল্যাপটপে ১৫ শতাংশ,  মোবাইল ফোনে খুচরা বিক্রিতে ৫ শতাংশ এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ একদিকে ডিজিটাল বৈষম্য বাড়াবে এবং শিক্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। 

অর্ধ শতাব্দী আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্যাপিটাল স্কুল শিক্ষা খাতের খরচকে বিনিয়োগ বলে প্রমাণ করে রেখেছে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তঃসত্ত্বা প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব  ১৯৯০ অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে ভেতর থেকে;  এর অবদান বাহ্যিক মডেলের বিশ্লেষণে সরাসরি ধরা পড়েনা। দেশের অতীতের বাজেটগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায় শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে ভৌত অবকাঠামোগত অবস্থার উন্নয়ন ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জোগান দিয়ে শিক্ষা বিস্তারে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অতীতের এই শিক্ষাবান্ধব বাজেট বাস্তবায়ন করায় এবারের বাজেটেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মৌলিক চাহিদাগুলো বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। যদি শিক্ষার্থীর চাহিদার দিকে তাকানো যায় তবে দেখি তাদের মধ্যে একটি পরমতসহিষ্ণু উদার ও প্রগতিশীল মানসিকতা এবং দেশাত্মবোধ সৃজনের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন পাঠক্রম বহির্ভূত বই যেমন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কিত বই, বিভিন্ন মনীষীর আত্মজীবনী,  ধর্মীয় রীতিনীতি পালন ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হওয়ার লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুশাসনমূলক বই সংবলিত একটি সুপরিসর পাঠাগার প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা আবশ্যক হিসেবে মনে করি। এছাড়া শিক্ষার্থীর সুস্বাস্থ্য রক্ষায় খেলার মাঠ, স্যানিটেশন,  সুপেয় পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া দরকার ছিল যা অনুপস্থিত রয়েছে। 

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডীন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা


Comment As:

Comment (0)