মিহির স্যার

কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা: একটি আর্থ সামাজিক বিশ্লেষন

ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমতে শুরু করেছে। গত এক দশকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষিতে জিডিপির অবদান ছিল ১৮.১ শতাংশ, যা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে এসে দাঁড়ায় ১৩.৪৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০২১-২২)  অর্থবছরে আরও কমে এসে দাঁড়ায় প্রায় ১২ শতাংশে। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০.৬২  শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, মানে কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’- এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, দেশে ইতোমধ্যে দানাদার ফসলের উৎপাদন সাড়ে ৪ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ টন প্রায়। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ধান,  গম ও ভুট্টাসহ দানাদার ফসলের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৫৫ লাখ টন। এছাড়া কন্দাল ফসলের (আলু, শাকসবজি,  পাট ইত্যাদি) উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৯৭ লাখ টনের বেশি। কৃষি তথ্যসূত্রে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে চালের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন,  গম ১২ লাখ এবং ভুট্টা ৫৭ লাখ টন। অপরদিকে শাকসবজি, মসলা,  তেল জাতীয় পণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে। গত অর্থবছরে আলুর উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৬ লাখ টন,  শাক সবজি ১ কোটি ৯৭ লাখ টন, তেলজাতীয় ফসল ১২ লাখ টন ও ডাল ৯ লাখ টন। এছাড়া ডাল ১১ লাখ ২০ হাজার, তেলবীজ সাড়ে ১০ লাখ টন, পেঁয়াজ ২৩ লাখ, রসুন ৬ লাখ, ধনিয়া ৭ হাজার,  আড়া ২ লাখ ৫০ হাজার ও হলুদ ১ লাখ ৫০ হাজার টন উৎপাদন হয়। মোট মসলাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন ছিল ৩৫ লাখ টন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে জানা যায়, মাথাপিছু বার্ষিক চালের (দানাদার) চাহিদা ১৫২ কেজি। এতে করে ১৬ কোটি ৬৪ লাখ জনসংখ্যার জন্য বার্ষিক চাহিদা ২ কোটি ৫৩ লাখ টন। যদি জনসংখ্যা ১৭ কোটি হয়,  তাহলে বার্ষিক চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি টন অর্থাৎ বর্তমানে চাহিদার চেয়ে খাদ্যের উৎপাদন বেশি। 
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ খাতে  স্থিরমূল্যে জিডিপির অবদান গত অর্থবছরে ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে খানা পরিবারের সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি। কৃষি পরিবার ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩টি। মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। সেচের আওতায় ৭৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর, পতিত ২ লাখ ২৩ হাজার, একফসলি জমি ২২ লাখ ৫৩ হাজার,  ২ ফসলি জমি ৩৯ লাখ ১৪ হাজার ও ৩ফসলি জমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর।

কৃষির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত এবং খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞা অনুযায়ী তখনই খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান যখন সবার কর্মক্ষম,  স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনমুখী জীবন যাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন  খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। ১৯৯৬ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে যোগদানকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানরা নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য প্রাপ্তিকে প্রত্যেক মানুষের অধিকার হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেন। আমাদের জাতীয় খাদ্য নীতিতে (২০০৬) খাদ্য নিরাপত্তায় চিহ্নিত তিনটি নিয়ামক হলো খাদ্যের লভ্যতা,  খাদ্য প্রাপ্তির সক্ষমতা ও খাদ্যের জৈবিক ব্যবহার। সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে সব কয়টি নিয়ামক গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট পারস্পরিক নির্ভরতা বিদ্যমান থাকায় খাদ্য নিরাপত্তা-সম্পর্কিত সব বিষয়ে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে শর্করা (চাল, গম,  আলু), আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম, ডাল), স্নেহ পদার্থ (ভোজ্যতেল, দুগ্ধজাতীয় খাবার), মিনারেলস (শাক সবজি), মসলা (পেঁয়াজ, রসুন, আদা) ও পানীয় (চা, কফি)। যেহেতু এ দেশের কম বেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত,  সেহেতু খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় প্রথমে আসে চালের বিষয়টি। স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কম বেশি ১ কোটি টন, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টনে  (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১)। অর্থাৎ স্বাধীনতাকালীন দেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা দ্বিগুণের কিছুটা বেশি বৃদ্ধি পেলেও চাল উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি। তবে চাল উৎপাদনে দেশ এখন পর্যন্ত স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও চাহিদা মেটাতে প্রায় প্রতি বছর চাল আমদানি করতে হচ্ছে। খাদ্যশস্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গম উৎপাদন মোটেই সন্তোষজনক নয়। সরকারি তথ্য মোতাবেক ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গম উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টনে, যা এখন ১১-১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে শর্করাজাতীয় খাদ্য আলু উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে তা রফতানি করছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। সবজি উৎপাদনেও দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। এফএওর তথ্য মতে,  সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। বেশ কিছু খাদ্য পণ্য উৎপাদনে দেশ পিছিয়ে আছে যেমন ডাল,  ভোজ্যতেল, চিনি, ফল, পেঁয়াজ, রসুন,  আদাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা যা আমদানির মাধ্যমে এসব খাদ্য পণ্যের চাহিদা মেটাতে হয়। আমিষের প্রধান উৎস মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় আর চাষকৃত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে রয়েছে,  সামুদ্রিক মৎস্য  আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১১তম। দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং ডিম উৎপাদনে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে দুধ উৎপাদনে দেশ পিছিয়ে আছে যার চাহিদা মেটাতে আমদানির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। খাদ্যের লভ্যতা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়,  দরকার খাদ্য কেনার সামর্থ্য। গত দুই বছর (২০২০ ও ২০২১)  ধরে করোনা মহামারীর কারণে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়,  দেশে কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি,  বেতন বা মজুরি হ্রাস এবং অন্যান্য কারণে মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্ক প্লেস ২০২১’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,  করোনার সময় বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। তাছাড়া করোনার কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শ্লথগতি দেখা দেয়ায় শ্রমশক্তিতে প্রবেশের উপযোগী মানুষ, বিশেষ করে শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুবকরা বেকারদের দলে ভিড়েছেন। এতে বেড়েছে বেকারত্বের হার,  যা দারিদ্র্য হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে একাধিক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা,  যেমন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি), ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়,  করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্য হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। দারিদ্র্যের এ হার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)  হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস)-২০১৬-এর ২৪.৩ শতাংশ এবং ২০১৯-২০-এ উল্লিখিত ২১.৮ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি। খাদ্য নিরাপত্তার ঋভপাল নিয়ামক খাদ্যের জৈবিক  ব্যবহারে অসংগতির কারণে পুষ্টিমানসম্পন্ন ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদন্ডের নিচে অবস্থান করছে। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি হলেও দেশ পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে।  ‘তার উপর আবার টিসিবির ২০২০ সালের ১ মার্চ ও সাম্প্রতিক বাজার দরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়,  সে সময়ের তুলনায় এখন মোটা চালের গড় দাম সাড়ে ৩১ শতাংশ, খোলা আটার ২০ শতাংশ,  খোলা ময়দার ৩৩ শতাংশ, এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ৫০ শতাংশ, চিনি ১৯ শতাংশ,  মোটা দানার মসুর ডাল ৩০ শতাংশ ও গুঁড়া দুধ ১৩ শতাংশ বেশি। মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা পেরিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করলেও এ সময় দানাদার খাদ্যশস্য,  বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ থেকে শুরু হয়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খাদ্য পণ্যের বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতি দেশের স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। 

২০২১-এর শেষের দিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও) খাদ্য মূল্যসূচক এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে যে সংখ্যাটি ২০১১ সালের জুন সূচকের প্রায় কাছাকাছি। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্য মূল্য তুলনামূলক কম এবং স্থির ছিল কিন্তু ২০২১ সালে গড়ে বৃদ্ধি পায় ২৮ শতাংশ যার কারণ ভুট্টা ও গমজাতীয় খাদ্যসহ সিরিয়ালের দাম ৪৪ থেকে ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি। কভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন শ্রমিকদের মজুরি আয়ের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের কারণে এটি আরো উদ্বেগজনক,  বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো মানুষের যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। খাবারের দাম বাড়ার সম্ভাব্য কারণ অনেকটা পদ্ধতিগত যেমন সরবরাহ শৃঙ্খলার সমস্যা,  বিশেষ করে পরিবহন সংক্রান্ত যা মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। তবে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন টন রেকর্ড পরিমাণ বৈশ্বিক উৎপাদন সত্ত্বেও ২০২১ সালে শস্যের দাম অনেক বেশি দ্রুত হারে বেড়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শস্য উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। গত নভেম্বরে এফএও তাদের এক হিসাবে দেখিয়েছে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য আমদানির ব্যয় ছিল সবচেয়ে বেশি যা প্রায় ১.৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার;  যা ২০২০ সালের চেয়ে ১৪ শতাংশ যা এফএওর অনুমানের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি যা নিম্ন আয়ের অর্থনীতির জন্য বিপদজনক। 

সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশের চরম দারিদ্র্য (২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ) নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান, পাট,  কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু,  সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী,  স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫১ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের এ ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর কৃষি নীতির পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ খাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে কৃষি খাতের উন্নয়ন ও কৃষকদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১, চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮,  টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০,  বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সরকার কৃষির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আধুনিক ও বিরূপতা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, ফসলের নতুন ধরনের উদ্ভাবন, পানিসাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার,  ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, সমন্বিত পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ,  কৃষির যান্ত্রিকীকরণ,  ট্রান্সজেনিক শস্য উৎপাদন ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার ও জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ত সহনশীল ও স্বল্প ব্যাপ্তির শস্যজাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি বিশাল উপকূলীয় এলাকায় ধান চাষাবাদের পরিধি প্রসারিত করেছে। সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, সেচ যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা বৃদ্ধি, কৃষি সম্প্রসারণ,  ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণের ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ,  খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধাদি নিশ্চিত করা,  সব কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় এক বা দুই ফসলি জমি চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফসলের নিবিড়তা ২১৬ শতাংশ,  যা ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১৬০ শতাংশ।

সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণের কারণে জীবিকা কৃষি ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবে ক্রমহ্রাসমান চাষযোগ্য জমি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা,  লবণাক্ততার বিপরীতে খাদ্য শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খাদ্য শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। বাংলাদেশ সেই কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে উৎপাদিত শস্যজাতীয় খাদ্য,  হিমায়িত সবজি, ফল, আলুজাতীয় খাদ্য, ভেষজ খাদ্য, চিনিজাতীয় খাদ্য, মধু, মাছ ও অপ্রচলিত মাছজাতীয় খাদ্য, পোলট্রি ও দুধজাতীয় খাদ্য রফতানি করে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য উৎপাদনে ৫০০-এর অধিক ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা জড়িত। তার মধ্যে ১০০ -এর মতো কোম্পানি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকার কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার কৃষি পণ্য রফতানির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। আসলে দেশের কৃষি জমির আয়তনের তুলনায় কৃষিজাত রফতানির আয় তুলনামূলকভাবে এখনো নগণ্য। 

শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের আদর্শ মডেল। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।


Comment As:

Comment (0)