মিহির

পেট্রো পণ্য ও সারের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব

ড: মিহির কুমার রায়: গত ৬ আগস্টের মধ্যরাত থেকে  বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম যা প্রতি লিটার ডিজেল ৩৪, অকটেন ৪৬ এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা, যাতে দেখা যায় যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারে হয়েছে ১৩০ টাকা আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮ শতাংশ যা প্রতি লিটার কিনতে হবে ১৩৫ টাকায়। সরকারি মাধ্যম বলছে বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫-৮০ টাকা করে সরকার যেখানে অকটেন ও পেট্রোলের দাম অপরিবর্তিত ছিল। সব মিলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত, প্রায় ১৬ শতাংশ   কৃষি খাতে, ৭ শতাংশ শিল্প খাতে ও ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ খাতে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন গত ৬ মাসে জ্বালানি তেল বিক্রয়ে  ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

এতদিন বাংলাদেশ সরকার যে ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু রেখেছিল তা ক্রমেই সহনশীলতার বাইরে চলে যাওযায় প্রতিদিন এই ভর্তুকি বাবদ ৯০  কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল রাষ্ট্রের  কোষাগার থেকে এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। এর আগে গত নভেম্বরে সরকার ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর বাস ভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের  চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ। সরকারি কোম্পানিগুলোর আবেদনের পর গত ৫ জুন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়। গ্যাস বিল ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা  হয়। বিইআরসির কারিগরি কমিটি পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল গত মে মাসে, যার ওপর এ মাসেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। শক্তি সংক্রান্ত সব কিছুরই দাম বাড়াতে চলেছে সরকার ভর্তুকি তুলে দিয়ে।
 
বাংলাদেশের বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। গত মে মাসের পর ডলারের দাম  ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন অবস্থায় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মানুষকে বড় সংকটে  ফেলছে। উন্নয়নের মূল কথাই হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুৎ, তত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি কর্মসংস্থান, বেকারত্বের অবসান, উৎপাদন উন্নয়ন, সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি। করোনা ও বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক ধীর গতি, কর্মসংস্থানহীনতা, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি এর সঙ্গে উচ্চ মূল্য বৃদ্ধি এই নির্দেশনা দেয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই  স্থবিরতা থেকে বেরোতে চাইছে বাংলাদেশ। কিন্তু কিভাবে?

এখন আসা যাক কৃষি উৎপাদন নিয়ে যেখানে সরকার ঘোষণা দিয়ে সারের দাম বাড়িয়েছে প্রতি কেজি ১৬ টাকা থেকে ২২ টাকায় অর্থাৎ সারের দাম বাড়ার শতকরা হার ৩৭.৫ শতাংশ। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দেখানো হয় ইউক্রেন যুদ্ধর প্রভাব। পেট্রো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিটা সরাসরি বিরূপ প্রভাব ফেলবে দেশের কৃষকদের ওপর। প্রাকৃতিকভাবে সেচের ব্যবস্থা নেই। কৃষককে নির্ভর করতে হয় যান্ত্রিক সেচের ওপর। ভরা বর্ষা মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টি নেই, এ বছরের আমন চাষের আবাদটা যান্ত্রিক সেচ দিয়ে করতে হচ্ছে। কৃষকেরা এখন গরু দিয়ে জমি চাষ করেন না, চাষের জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করে থাকেন যা  ডিজেল চালিত,  ধান মাড়াই মেশিন ডিজেল চালিত এবং যে কোন কৃষি পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন ডিজেলে। তাই এই মূল্য বৃদ্ধিটা মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে কৃষি পণ্য উৎপাদনে। ডিজেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, গ্রামের হাটে ধান বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়, ডিজেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধানের দাম বাড়ানো যদি হত তাহলে, ধানের দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানো উচিত। এই  হিসেবে গ্রামের হাটে প্রতি মণ ধানের মূল্য হতে হবে ২ হাজার টাকা, বর্তমানে ১ হাজার টাকা ধানের দাম থাকার পরও মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে আর এই দাম যদি ২ হাজার টাকা হয়, তাহলে মোটা চাল কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি হয়ে যাবে। কারণ  দেশের নাজুক কৃষি অর্থনীতিতে ডিজেলের দাম বাড়ানোটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অর্থাৎ যখন ডিজেলের দাম ৪৪  টাকা করেছিল তখন এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হতো প্রায় ৮২০০ টাকা আর বিঘা প্রতি ফলন ১০-১২ মণ করে।  এখন ডিজেলের দাম হলো ১১৫ টাকা, অর্থাৎ আড়াই গুণ বাড়ল, বিঘা প্রতি খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ টাকা, ধানের দাম না বাড়লে কৃষক তার উৎপাদন খরচ কোন ভাবেই মেটাতে পারবে না। কারণ এক দিকে ইউরিয়া সারের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, মাঠ পর্যায়ের ডিলাররা সরকারি রেটের চেয়ে বেশি মূল্যে সার বিক্রি করে থাকে কৃষকদের কাছে।  মাঠ পর্যায়ের বিক্রির হিসাবটা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে সারের দাম ৬০-৭০ শতাংশই প্রায় বেড়ে গেছে। এই ইউরিয়া সারের  বেড়ে যাওয়া দামটাও যোগ হবে ধানের মোট উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে। সরকারিভাবে শিল্প পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয় তার  উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে। এই নির্ধারিত মূল্য মাঠ পর্যায়ে মানা হচ্ছে কিনা, তার তদারকির জন্য কাজ করে সরকারি বেশ  কয়েকটি দপ্তর। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেশের কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ অনুসারে তার মূল্য নির্ধারণটা সরকার করে না।  তবে শুধু ধানের ক্ষেত্রে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, তবে মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক কৃষকরা সরকারি নির্ধারিত ধানের মূল্য পাচ্ছে কিনা,  তা মনিটরিং করতে সরকারি টিমকে দেখা যায় না। দেশে প্রায়  দুই কোটির বেশি কৃষক পরিবার রয়েছে, যদি  প্রতিটি পরিবারে গড়ে চার জন করে সদস্য হয়, তাহলে দেথা যাবে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এই  হিসাবটা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে না। সরকার যাদের জন্য কাজ করছে তারা  মোট জনসংখ্যার সংখ্যালঘু। অথচ এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই সরকারি ব্যয়ভার মিটানো হয়। ডিজেলের দাম  বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। তাই শহরের পাইকারিরা কৃষকের উৎপাদিত শাক সব্জির মূল্য কমিয়ে দেয়। পাইকাররা ক্রয় মূল্যের  সঙ্গে পরিবহন খরচ যোগ করে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে বলেই কৃষক তার ন্যয্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।

গত ৬ আগস্ট গণমাধ্যমে  প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য  ব্যারল প্রতি দাঁড়িয়েছিল ১৩৯ ডলারে। অয়েল প্রাইস ডট কম জানায় আন্তর্জাতিক বাজারে উভয় প্রকার তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ৩০শে জুলাই ২০২২ তারিখে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেল বিক্রি করছে ৮৮.৪৩ ডলারে, অপরদিকে  ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি করছে ৯৩.৯৫ ডলারে। এই হিসাবে সরকার যে ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে তা ঠিক হয়নি। আরেকটি বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলেও দেশের বাজারে তা কমতে কখনো দেখা যায় না। ফলে মূল্য বৃদ্ধির চাপটা পরে দেশের  প্রান্তিক মানুষের ওপর। বর্তমানে মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হবে প্রান্তিক কৃষকরা। সরকারের ভাবা উচিত কৃষি পণ্যের মূল্য বেড়ে  গেলে মূল্যস্ফীতির হারও দ্রুত বেড়ে যাবে।

এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ৫২ বছরের বাংলাদেশ কতটা অর্থনৈতিক সম্পদ মজুত করতে পেরেছে? কারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট একটি আপদকাল। এই আপদকাল স্থায়ী হয় না। প্রশ্নটা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এসে কেন বাংলাদেশ আপদকালীন সময় মোকাবিলা করার মতো নিজস্ব সামর্থ তৈরি করতে পারেনি কেন? এটা সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। করোনা মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক কৃষকরা। বড় মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা পেয়েছেন করোনার প্রণোদনা। সরকারের  প্রণোদনা পাওয়ার পরও শিল্প মালিক ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা করোনার অজুহাতে নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রাখে।  ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা হয়ে যায় বেকার। এই বেকার হওয়া মানুষগুলো গ্রামে ফিরে আসে। এরা মূলত প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ও  কৃষি শ্রমিক।

বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সে শর্ত পূরণ করা হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে চীনের কাছে ঋণ।  আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি গাড়িতে ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আসবে। ভারতে ইতোমধ্যে ইলেকট্রিকাল ভেহিকল ইন্ডাস্ট্রি  খুব দ্রুত বাজার ধরে নিচ্ছে। ভারতে বিদ্যুৎচালিত ওজনে হালকা ছোট গাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ, জাপান বা  কোরিয়ার ব্যবহৃত ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের সময় হয়েছে দেশের মাটিতে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি  করার। কিন্তু পেট্রোল, ডিজেল, অকটেনের মূল্য বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী হলেও মুশকিল এক জায়গায়। কাজেই সবটাই নির্ভর করছে সরকারের  সদিচ্ছার ওপরে। আশা করা যায় এই গনমানুষের সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বাস্তব ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে সাধারন  কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)