মিহির রায় ১

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

শহরের তুলনায় গ্রামে বাড়ছে ঋণ আমানত

ডঃ মিহির কুমার রায়: ইতালির রাজধানী রোমে আই.এফ.এ.ডি এর ৪১তম পরিচালন পর্ষদ সভায় উদ্বোধনী ভাষনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দারিদ্র ও ক্ষুধা দূর করতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি বিবেচ্য বিষয় যা অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। 

তিনি আরও বলেছিলেন দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় যার জন্য একটি ব্যাপক ভিত্তিক টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি প্রয়োজন। এখানে বিনিয়োগ বলতে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন সহযোগিদের আরও বেশী করে বিনিয়োগ নিয়ে এগিযে আসতে বলেছিলেন।

স্থিতিশীল দারিদ্র বিমোচন নিশ্চিত করার জন্য শুধু শহর নগর নয়, গ্রামীন অর্থনীতিতে বিনিয়োগও একটি বিবেচ্য বিষয় হওয়া বাঞ্চনীয়। বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এই অর্জন করা সম্ভব নয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক কালে দেশের দারিদ্যের হার ২০.৩ শতাংশে এবং চরমদারিদ্রের হার ১২ শতাংশে নেমে এসেছে যার মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলের অবস্থার উন্নতি শহরের তুলনায় বেশী। 

এখনও দেশের মোট জনসংখ্যা ৫৬ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে কিন্তু ক্রমাগত ভাবে গ্রামের সংখ্যা কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতির অবয়ব ক্রমেই কমে আসছে অব্যাহতভাবে নগরায়নের কারণে। একটি তথ্যে দেখা যায় যে, এক শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে যার সিংহ ভাগই হলো শিল্পায়নও বসতি স্থাপনের কারণে। 

বর্তমানে মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক ডেসিমেলের নীচে চলে এসেছে বিশেষত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও প্রকৃতি সৃষ্ট দূর্যোগে। গ্রামীন জনপদে বসতি স্থাপন করিরাা উন্নতর জীবন ধারণের জন্য শহরে চলে আসছে ক্রমাগত ভাবে। 

এখানে শহর বলতে সর্বনিম্ন যে সকল উপজেলা পৌরসভা কর্তৃক স্থানীয় ভাবে শাসিত এবং গ্রাম বলতে বুঝায় যে সকল উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক স্থানীয়ভাবে শাসিত যাদের সংখ্যা বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ ৪৫৪৩ ও গ্রাম ৮৭,৩২০
টি। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে সকল ম্যাগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাদের মধ্যে পদ্মাসেতু ছাড়া আর সব প্রকল্পেই দাতা গোষ্ঠীর অবদান রয়েছে যার ফল গ্রামীণ অর্থনীতিতে বসবাসকারী জনগণই সুবিধা পাচ্ছে।

সময়ের আবর্তে দেখা যাচ্ছে যে, দাতাদের বিনিয়োগ ক্রমশই কমছে যা বর্তমান বছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপিএর) মাত্র ১২ শতাংশ এর নিচে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩ শতাংশে নিয়ে আসার চিন্তা ভাবনা চলছে বিশেষত: স্বনির্ভর অর্থনীতির কথা চিন্তা করে। তার অর্থ এই দাড়ায় যে আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসাবে এরি মধ্যে অনেক অগ্রগতি সাধিত করেছি বিশেষত: অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি উদিয়মান অর্থনীতির তালিকায় স্থান পেয়েছে সত্যি কিন্তু স্থায়িত্বশীলতার জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এই দেশটির। 

এখন উন্নয়নে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই সত্যি কিন্তুু বিগত কয়েকবছর যাবত বেসকারী ও সরকইর বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে যা জি.ডিপি এর মাত্র ৩১.৫ শতাংশ। এর মূল কারণ হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছে অপর্য্যাপ্ত অবকঠামো, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জমির স্বল্পতা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত ও ঋণ দুই-ই বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই-এই ছয় মাসে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছে ২.১৭ শতাংশ এবং শহরে ১. ৯৮ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত বেশি বেড়েছে ০.১৯ শতাংশ।অপরদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে

জুলাইয়ে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৩ .২৫ শতাংশএবং একই সময়ে শহরে বেড়েছে ২. ৬৮ শতাংশ, ওই সময়েও শহরের চেয়ে গ্রামে আমানত বেশি বাড়ে ০.৫৭ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৩.৭৮ শতাংশ, একই সময়ে শহরে বেড়েছে ৩.৩৬ শতাংশ। ওই সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বেড়েছে ০. ৪২ শতাংশ, গত বছরের একই সময়ে গ্রামে ঋণ বেড়েছিল ১.৮৬ শতাংশ এবং শহরে ২.০৭ শতাংশ এবং এই সময়ে গ্রামের চেয়ে শহরে ঋণপ্রবাহ বেশি বৃদ্ধি পায়।

অবশ্য সরকার করোনার ক্ষতি মোকাবিলা এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গ্রামে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। যে কারণে এখন গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে। 

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকের সেবা গ্রামেও বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। শাখার প্রায় অর্ধেক এখন গ্রামে। গ্রামীণ শাখাগুলো থেকে আগে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কম থাকলেও এখন বেড়েছে। সারা দেশে ব্যাংকগুলোর মোট শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৭৯৩টি। এর মধ্যে শহরে শাখা ৫ হাজার ৫৫৪টি এবং গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ২৩৯টি। মোট শাখার সাড়ে ৫১ শতাংশ শহরে এবং গ্রামে সাড়ে ৪৮ শতাংশ। 

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট আমানত ও ঋণের সিংহভাই ঢাকা বিভাগে। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান।  মোট আমানতের ৭৯ শতাংশই শহরের, গ্রামের আমানত ২১ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬২, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১, খুলনা বিভাগে ৪ দশমিক ২২, রাজশাহী বিভাগে ৪, বরিশাল বিভাগে ১ দশমিক ৮৭, সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ৭৬ এবং রংপুর বিভাগে ২ শতাংশ আমানত রয়েছে। সবচেয়ে কম আমানত ময়মনসিংহ বিভাগে মাত্র দেড় শতাংশ। 

মোট ঋণের ৮৯ শতাংশই শহর এলাকায় বিতরণ করা হয়, গ্রামে মাত্র ১১ শতাংশ। ঋণের ৬৮ শতাংশই ঢাকা বিভাগে, চট্টগ্রামে সাড়ে ১৮, খুলনায় ৩.৮১, রাজশাহীতে ৩.৭১, সিলেটে ১.১৪, রংপুরে ২. ৩৮ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১.৩৬ শতাংশ। 
সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ করা হয় বরিশাল বিভাগে ১.১২ শতাংশ। 

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য হলো এটি আশার কথা যে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে ও এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গ্রামকে অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব হবে। 

বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় শহর থেকে যে কারণে শহরে ঋণ ও আমানত দুটোই বেশি। কিন্তু কৃষি বা
শিল্প উৎপাদন সবই গ্রামকেন্দ্রিক, কেননা শিল্পের বেশির ভাগ কারখানাই গ্রামে তথা কৃষি উৎপাদন তো পুরোটাই গ্রামভিত্তিক।’ আগে গ্রামে আমানত বেড়েছে; কিন্তু ঋণ বাড়েনি। ফলে গ্রামের টাকা শহরে চলে এসেছে। এখন গ্রামে আমানত বাড়ার পাশাপাশি ঋণও বাড়তে শুরু করায় গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়বে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়ক হবে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাড়নো যাচ্ছিল না। কারণ গ্রামে ঋণের চাহিদা কম। 

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণকরলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়, খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।এজন্য কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কম সুদে ঋণ দিতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তৈল বীজ উৎপাদনে গঠন করা হয়েছে আরও ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকার পল্লি ও কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আরও কিছু তহবিলের আওতায় গ্রামে
ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হচ্ছে। 

এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারী/ সরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হওয়ার ঘোষনা দিয়েছে । কাজেই এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি গ্রামীন অর্থনীতিতে কেবল দাতা সংস্থা কর্তৃক বিনিয়োগ কিংবা এর মাধ্যমে উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে যে উন্নয়ন সহযোগিরা তাদের মডেলের মাধ্যমে একটি সময়ের আবর্তে কাজকরে দেয়। কিন্তু চুক্তি
মোতাবেক কাজ সমাপনান্তে সরকারকেই তার প্রাতিষ্ঠানিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বা¯স্তায়নের দায়িত্ব নিতে হয়। আবার সেগুলো যদি বিনিয়োগ প্রকল্প হয় তখন ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসাবে সেগুলো কাজ করে থাকে। 

কিন্তু দেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে যে, যে গতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়ে উঠেনি কেবল উদ্যোক্তা সৃষ্টির দৈন্যতার কারণে। কারণ এই ধরনের অনেক বৈদেশিক সাহায্য পোষ্ঠ প্রকল্প মেয়াদ শেষে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রূপ নিয়েছে যেমন আর.ডি ১০ প্রকল্প বর্তমানে পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন, ক্ষদ্র কৃষক উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, একটি বাড়ী
একটি খামার প্রকল্প, বর্তমানে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি। 

কিন্তুু তাদের কার্য্যক্রম গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কি সুফল নিয়ে এনেছে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে । আবার পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পি.কে,এস.এফ) তাদের উন্নয়ন মেলায় দেখলাম সারা দেশ থেকে আগত তিনশতেরও বেশি পাটনার আর্গেনাইজেন তাদের উন্নয়নের সুফল মেলায় প্রদর্শিত করেছে যার বেশীর ভাগই শিল্প পণ্য তৈরীর আয়োজন যা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক দৃষ্টি থেকে পরিচালিত। 

কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন যার কতটুকু সেই সফল সহযোগি সংস্থা উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত করছে তা বুঝা যাচ্ছে না কিংবা উৎপাদনমুখী উদ্যোগক্তা উন্নয়নে তাদের কতটুকু অবদান তাও বুঝা যাচ্ছে না। আবার গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক প্রায় ৮৫ লাখ গরীব পরিবারকে ক্ষুুদ্র ঋণের মাধ্যমে যে তাদের কর্মক্ষমতার উন্নয়নে অবদান রাখছে যার সবটুকুই প্রায় বিনিয়োগ কর্মসূচী যা আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন তাদের স্থায়িত্বশীলতার অবস্থাটা কি হবে যদি গ্রামীণ ব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার দরজাটি বন্ধ করে দেয়। 

গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো শস্য উৎপাদন, পশু পালন, মৎস্য খামার তৈরী, বনায়ন ইত্যাদি। কিন্তু সনাতনী কায়দায় পরিবার ভিত্তিক কৃষি কাজে বিনিয়োগের তেমন খুব একটা সুযোগ থাকে না প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে। 

আবার গ্রীন হাউজ ভিত্তিক কৃষি কাজের অপূর্ব সূযোগ থাকলেও উদ্যোগক্তা যেমন পাওয়া দুষ্কর অপরদিকে বিনিয়োগের প্রাপ্তির
রাস্তাটিও খুব সহজতর নয় অথচ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডীয়া, মালয়েশিয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কাজ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সফরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা আমরা পাড়ছি না কেন? কারণ একটা উদ্যোগক্তা সৃষ্টি হচ্ছে না কিংবা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা আমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে বিরত থাকছে। 

তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা রূপান্তর এসেছে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং বাজারে এখন যে মাছের কেনাবেচা চলছে তার সিংহভাগ চাষকৃত মাছ, প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন হাওয়র, বাউঅর, বিল ইত্যাদি থেকে নয়। 

তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন সফলতা আসছেনা কেবল উদ্যোগক্তার অভাবে তা বলা যাবে না। তার সাথে যোগ হয়েছে সরকারী খাতে সহায়ক নীতিমালার অভাব। পশু খাদ্যের অত্যাধিক মূল্য, ঔষদের অপর্যাপ্ততা, ঘাস চাষের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতা, গোড়া দুধ আমদানী ইত্যাদির কারণে পশু সম্পদ খাতটি প্রতিযোগীতা মূলক বাজারে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। 

এ সকল সীমাবদ্ধতা থাকা সত্যেও সময়মত উদ্যোগ গ্রহণ ও তার সফলতার চিত্র আমরা চ্যানেল আইয়ের মাটি মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবহিত হয়ে থাকি যার একটা প্রাদর্শনীক প্রভাব অবশ্যি রয়েছে কিন্তু সামষ্টিক অর্থে তা খুবি কম।

আমাদের দেশে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রি নিয়ে উদ্যোগক্তা হতে আগ্রহী হয় না কিংবা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হতে স্বপ্ন দেখে না। এটা আমাদের ব্যবসা প্রশাসনে শিক্ষক-শিক্ষা-প্রশিক্ষণের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয় যা কেবল মজুরী নির্ভর চাকুরী বান্ধব, স্বনিয়োজিত কর্ম বান্ধব নয়। এখন আমাদের ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে যেতে জিডিপি প্রবৃদ্দি ৮.৫ শতাংশ থেকে ১০.০ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজন রয়েছে যা কেবল গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিচালিত গ্রাম্য পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমেই সম্ভব যার বেশীর ভাগ খাদ্য পণ্য যার সাথে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে।

এখন আমাদের সময় এসেছে বহুমাত্রিক চিন্তা ভাবনা করার এই সকল বিষয়গুলোতে যেমন এক: আমাদের নিবিড় চাষবাস বিশেষত: কৃষিযান্ত্রীকিকরণের মাধ্যমেই করতে হবে এবং এই দায়িত্বটি সনাতনী কৃষকের দ্বারা পালন সম্ভব হবে না। তাই কৃষি উদ্যোগক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে প্রশিক্ষিত হয়ে। শস্য কিংবা সব্জী উৎপাদনে গ্রীন হাউজ ভিত্তিক খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার মাধ্যমে সারা বছর জোড়েই সব্জী সরবরাহ ভোক্তাদের
মাঝে করা যাবে। 

এখন শহর ভিত্তিক ভোক্তাদের চাহিদা বিশেসত: বিদেশী শব্জীর প্রতি এবং ঢাকা সহ বিভাগীয শহরগুলোতে নূতন নূতন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর যেমন আগুরা, স্বপ্ন ইত্যাদিতে ভোক্তারা টাটকা উন্নত জাতের সব্জী খেতে চায় যা এই সকল পণ্যের জন্য একটি নির্ধারিত বাজার হতে পারে।

কিন্তু একটি গ্রীণ হাউজ তৈরী করতে মোটা অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন যা অনেকাংশে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে যদি সে ধরনের উদ্যোগক্তা পাওয়া যায়; দুই: শস্য বিশেষ করে খাদ্য শস্য (ধান) উৎপাদনের জাত, জমি কর্ষণ, সেচ সরবরাহ, কীট নাশকের ব্যবহার ইত্যাদিতে আধুনিকায়ন হয়েছে কিন্তু ব্যবসা ভিত্তিক যে একটি নীতিমালার মাধ্যমে প্রযুক্তির ফলে যে উৎপাদন বাড়ছে তার সুফল পাওয়ার জন্য যে একটি সুসংগঠিত বাজার ব্যবস্থার প্রয়োজন তা অনেকাংশে নেই যার সাথে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি জড়িত। তাই এ ধরনের বিনিয়োগ ভিত্তিক কৃষি ব্যবসা হতে হবে রপ্তানীমুখী যার জন্য যত ধরনের সহায়তা দরকার তা দিতে হবে সরকারের বাণিজ্য, অর্থ ও বিমান মন্ত্রণালয়কে। 

কৃষি পণ্যের ব্যবসা হতে হবে একটি সুসংগঠিত শিল্প যেখানে একদিকে থাকবে উৎপাদন এবং অন্যদিকে থাকবে বিপণন। সরকারের অর্থায়ণে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অনেক গ্রাম্য হাটবাজার তৈরী হলেও তাদের সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে তেমন স্থায়িত্ব পায় না যা প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা মাত্র, তৃতীয়ঃ গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে ষাটের দশকে সমবায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বিপণনের ক্ষেত্রে এবং সমবায় সমিতি গুলো ভ‚মিকা তখন দৃশ্যমানছিল। 

কিন্তু সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধশিল্পের প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা স্বাধীনতার ৫২ বছর পড়েও সাড়া দেশে তাদের শাখা প্রশাখা বিস্তার করতেপাড়েনি। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দুগ্ধ উৎপাদনকারীও জাতীয়ভাবে খুব যে রেকর্ড পরিমাণ দুগ্ধ খামারের মাধ্যমে উৎপাদন করতে পেড়েছে তাও বলা যাচ্ছে না অর্থাৎ সার্বিকভাবে বিষয়টি একটি বন্দাত্তের মধ্যে পড়ে রয়েছে। 

আশির দশকে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় কৃষি ব্যাংক তার পশু পালন শাখার মাধ্যমে দুগ্ধখামারীদের অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু সে সকল খামার লাভজনকভাবে প্রতিষ্ঠত হতে পাড়েনি উপকরণ খরচ ও উৎপাদিত দুধের মূল্যের ব্যবধানের কারণে।
এখানে প্রশ্ন আসে প্রযুক্তির এবং কেবল তরল দুধ বিক্রি না করে তা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যদি দুগ্ধজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণ করা যেত তাহলে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশী দেখা যেত।

কিন্তু কৃষি ব্যাংকের অর্থায়ন এই দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়েই খামার তৈরীতে অর্থায়ন করা হয়েছে যা সঠিক নয়। একি অবস্থা পোলট্রি শিল্পের সেখানে ঔষধ ও খাদ্যের দাম প্রবল হওয়ায় বিগত দু’বছরে প্রায় ১ হাজার খামারী ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে পোল্ট্রি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং আরও বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে ১ হাজার খামার।

এ খাটতি পূরনের জন্য সরকার ডিম ও মাংস আমদানী করে থাকে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় কিন্তু খামারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে কে? চতুর্থতঃ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে দাড়িয়েছে জমি ক্রয় বিশেষত: রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আয়কৃত গরীব মানুষের অর্থে যা একটি অনুৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগ। 

এই সময়ে উৎপাদনখাতে বিনিয়োগে পরামর্শ দেয়ার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান যদি থাকে তা এই বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে পারে; সর্বশেষে বলা যায় বিনিয়োগ অর্থনীতির প্রাণ কেন্দ্র এবং এই ধারাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধরে রাখা যায় তাহলে গ্রামীন অর্থনীতি থেকে আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি পাবে এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/কেএসকে/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)