বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো কৌশল বা দিকনির্দেশনা নাই: এম সাইফুর রহমান মজুমদার
শামীম-আল-মাসুদ, বিশেষ প্রতিবেদক, বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজার নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো কৌশল বা দিকনির্দেশনা এবারের বাজেটে নাই বলে মনে করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমান মজুমদার।
বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
সিএসইর এমডি বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা কিংবা কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। পুঁজিবাজারকে একটি সাসটেইনেবল জায়গায় দাড় করানো দরকার। আর সেটি করতে হলে নীতিনির্ধারনী মহল থেকেই কৌশল ঠিক করতে হবে। তবে সেটা হতে হবে স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নির্ধারণ। পুঁজিবাজারের জন্য এ ধরনের কৌশল শুধু এই বাজেটেই নয়, আগের কোনো বাজেটেই ওইভাবে দেখা যায়নি। বাজারের উন্নয়নে আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যেসব প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, তাও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বলুন। এ বাজার কি এখন স্থিতিশীল?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: আমি মনে করি, এখনও দেশের পুঁজিবাজার নিশ্চিন্ত স্থিতিশীল অবস্থানে আসেনি; স্বাভাবিক ট্রেড ভলিয়ম বাড়েনি। এ বাজারকে স্থিতিশীল করতে আরও নতুন প্রোডাক্ট আনতে হবে। গুণগত মানসম্মত কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। এগুলোর জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর পক্ষে এ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এজন্য সরকার, সব খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, দেশের সকল ট্রেড বডি, বড় শিল্পগ্রুপসহ সকলকে এক টেবিলে আনতে হবে। সকলের সমস্যা শুনে এবং বিবেচনায় নিয়ে একটি কাঠামো ঠিক করতে হবে। পরবর্তীতে সেই কাঠামো অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হলে এবং বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা বাড়লে বাজারে নতুন ফান্ড আসবে। এছাড়া বাজারে জনগনের অংশগ্রহন বাড়লে জিডিপিতেও এর অবদান বাড়বে।
বিনিয়োগবার্তা: প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বলুন। এ বাজেট কি পুঁজিবাজার বা বিনিয়োগবান্ধব বলে আপনি মনে করেন?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার : প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের পরিপন্থী কিছু নাই। আবার পুঁজিবাজারকে প্রণোদনা দেবার জন্যও ওইভাবে কিছু নাই। আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে পুঁজিবাজারকে একটি সাসটেইনেবল জায়গায় দাড় করানো দরকার। আর সেটি করতে হলে নীতিনির্ধারনী মহল থেকেই কৌশল ঠিক করতে হবে। তবে সেটা হতে হবে স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নির্ধারণ। আর সেটি করার জন্য গুনগত মানসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে হবে। এখানে তাদেরকে তালিকাভূক্ত করতে হবে। আর তার জন্য নীতি সহায়তা বা পলিসি নিধারনের প্রয়োজন রয়েছে। আর এ কাজটির জন্য বাজেট কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ন জায়গা। কিন্তু আমরা বাজেটে সেই রকম কিছু দেখছি না। এটি শুধু এই বাজেটেই নয়, আগের কোনো বাজেটেই ওইভাবে দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো বাজেট আমরা পাচ্ছিনা। পুঁজিবাজারকে সার্বিক উন্নয়নের একটি অংশ হিসাবে নিতে হবে। দেশের সব জায়গায় উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের উন্নয়ন হচ্ছে না। এক কথায় বলতে গেলে পুঁজিবাজার পরিপন্থী এমন কিছু এবারের বাজেটে নাই; আবার বাজার স্থিতিশীল হবে এমন কিছুও নাই। আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যেসব প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, তাও কোনোভাবেই বিবেচনায় আনা হয়নি।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে আপনার পরামর্শ কি?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: দেশের পুঁজিবাজারের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে একটি নির্ধারিত টাইমফ্রেম ঠিক করতে হবে। এই ফ্রেম অনুযায়ী বা ওই সময়ের মধ্যে আমাদের পুঁজিবাজারে কত কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে, কি ধরনের কোম্পানি আসবে, আমাদের বাজারে গভীরতা কত হবে, পুঁজিবাজারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে; স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে কি করতে হবে, অনান্য স্টেক হোল্ডারদের কি করতে হবে- এমন সুস্পষ্ট কৌশন নির্ধারণ করা দরকার। সুনির্দিষ্ট কৌশল বা দিকনির্দেশনা না থাকলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌছানো যায়না। তাই আমি বলবো, আগে একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করুন। তারপর ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাতে সুনির্দিষ্ট কৌশল নির্ধারণ করুন। এদেশের পুঁজিবাজারের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগান। পুঁজিবাজারকে ভালোভাবে বিবেচনায় নিন। আর বিবেচনায় নিলেই এখানে কি ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, তা বেরিয়ে আসবে। এ বাজারের জন্য আইনী সংস্কারের পাশাপাশি নীতি সহায়তার দরকার রয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু আইনি সংস্কার হয়েছে। যেমন- এক্সচেঞ্জগুলো ডি-মিউচ্যুয়ালাইজড হয়েছে, স্ট্যাটেজিক পার্টনার নেওয়া হচ্ছে, বিএসইসি অনেকগুলো আইনের সংস্কার করেছে, প্রতিনিয়ত আরও বিধিবিধান করছে- এসব সংস্কার বাজারের জন্য ইতিবাচক।
বিনিয়োগবার্তা: বর্তমান বাজারে কতগুলো কোম্পানির চাহিদা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: দেশে বর্তমানে কয়েক লক্ষ কোম্পানি লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত রয়েছে। এরমধ্যে মধ্যম ও বৃহদায়তনের কমপক্ষে কয়েক হাজার কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত করার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। এছাড়া দেশের বর্তমান জিডিপির হার, অর্থনীতির আকার এবং বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ি কমপক্ষে এক হাজার কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত থাকা উচিত ছিল। অথচ, আমাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত মাত্র শ’ তিনেক কোম্পানি। দেশের সার্বিক অর্থনীতির তুলনায় এই সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। সমসাময়িক বাজেটগুলোতে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা না থাকায় বড় কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে না। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিচক্ষনতা অারও বাড়াতে হবে। তাই বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর চিন্তা করা প্রয়োজন।
পুঁজিবাজারে বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বরং অনেক ক্ষেত্রে ছাড়ের ওপর আছে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, প্রয়োজনে আইনি সংস্কার করে এসব কোম্পানিকে বাজারে আনার ব্যবস্থা করা দরকার। বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পলিসি গ্রহন করা জরুরী। বাজারে এসব কোম্পানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরা লিস্টেড হলে বাজারের সাইজ বড় হবে এবং আমাদের বাজারটি আন্তর্জাতিক মানের হবে।
বিনিয়োগবার্তা: বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অনেকে মনে করছেন এখন মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে তা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে। আপনি কি মনে করছেন?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: আমি মনে করি, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর সঙ্গে পুঁজিবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাংকে চাইলে যে কউ টাকা রাখতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাজারে চাইলেই যে কউ বিনিয়োগ করতে পারে না। এজন্য তার শিক্ষার দরকার হয়। না বুঝে এখানে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। এ বাজার থেকে গেইনার হতে হলে বাজারের বিভিন্ন টার্ম, কোম্পানির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ জানতে হয়। ব্যাংকে টাকা আমানত রাখলে অতটা বিচার বিশ্লেষণের দরকার হয় না। তবে সরকারের সহায়ক নীতি বা পলিসি বাজারে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিনিয়োগবার্তা: ডিএসই’র তুলনায় সিএসইতে লেনদেনের পরিমান অনেক কম হয় কেন?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: দেখুন ডিএসইতে তালিকাভূক্ত কোম্পানি বা এর স্টেকহোল্ডার অনেক বেশি। সেই তুলনায় সিএসইতে লিস্টেড কোম্পানি বা এর স্টেকহোল্ডার অনেক কম। আর এ কারনে সিএসইতে লেনদেনের পরিমানও কম। তবে আমরা পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিভিন্ন সময় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে আসছে। কিভাবে সিএসইর কোম্পানি এবং লেনদেনের পরিমান বাড়ানো যায়, সেসব বিষয়গুলো আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। অচিরেই এসব সমস্যা কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি।
বিনিয়োগবার্তা: স্ট্রাটেজিক পার্টনার নেওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে বলুন?
এম সাইফুর রহমান মজুমদার: স্ট্রাটেজিক পার্টনার নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে। তবে এ বিষয়ে আমরা দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আগ্রহপত্র পেয়েছি। একটি বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও আগ্রহপত্র পেয়েছি। আমরা তাদের সব বিষয়াদি যাচাই বাছাই করছি। এছাড়া এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ৩০ জুনের মধ্যেই আমরা এ বিষয়ে একটি ইতিবাচক স্থানে পৌঁছাতে পারবো।
বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন। কেন তারা এ বাজারে বিনিয়োগ করবে?
মো: সাইফুর রহমান মজুমদার: পুজিবাজার শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের বিনিয়োগের জায়গা। এখানে বিনিয়োগের আগে বাজার সম্পর্কে জানতে হবে, বিভিন্ন টার্ম বুঝতে হবে। এছাড়া কোম্পানিগুলোর ভিত্তিসমূহ বিচার বিশ্লেষণও এ বাজারে বিনিয়োগের জন্য জরুরী। তাই জেনে, বুঝে তবেই এখানে বিনিয়োগ করতে আসবেন। পাশাপাশি নিজের এবং পরিবারের বরণ পোষণের পর অতিরিক্ত টাকা থাকলে, কেবল তা নিয়ে পুজিবাজারে বিনিয়োগে আসবেন। কখনোই ধার, কর্জ করে এখানে বিনিয়োগ করবেন না।
দেশে বর্তমানে ব্যাংকে আমানতে সুদ হার কম, সঞ্চয়পত্রেও আগের মতো লাভ নাই। আবাসন খাতের অবস্থাও ভাল নয়। অন্যদিকে দেশের পুজিবাজার এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সচ্ছ ও স্থিতিশীল। এছাড়া তালিকাভূক্ত অনেক কোম্পানিই ব্যাংকের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়। তাই সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনা করে মানুষ এখানে বিনিয়োগ করবে।
(শামীম/ ১৯ জুন ২০১৭)