আরিফুল ইসলাম

পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়াঃ বিভিন্ন ফোরামে গত ৫০ বছরের বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি/উন্নয়নের সুফল কতটুকু দেশের মানুষ ভোগ করতে পারছে অদূর ভবিষ্যতে সুফল কতটুকু মানুষ ভোগ করতে পারবে এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। উন্নয়ন যতটুকু হয়েছে, তা কি কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্জন করা সম্ভব হয়েছে? কিংবা মাইলফলকের কোথায় স্পর্শ করতে পারতাম আমরা। যদি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পোঁছাতে না পারি তবে ব্যর্থতাগুলো কি কি? সাধারনতঃ প্রত্যেকটা সচেতন নাগরিকের তার চিন্তার জগতে সদা এই প্রশ্ন গুলো ঘুরে বেড়ায়। মানুষ আমাদের সমসাময়িক স্বাধীন দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের অগ্রগতির তুলনা করতে চায়। আসলে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আমাদের কার সঙ্গে তুলনা করা উচিত? আমরা কি শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের সাথে নিজেদের তুলনা করবো, না তুলনার পরিধি আরেকটু বিস্তৃত করতে পারি। আজকের লেখায় তুলনার জায়গাটা একটু বিস্তৃত করার চেষ্টা করবো। 

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশ টিকে থাকবে কিনা-তা নিয়েই সন্দেহ পোষণ করা হতো। তখন অনেকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা ভাবা তো দূরে থাক বাংলাদেশকে “তলা বিহীন ঝুঁড়ি” অথবা “উন্নয়নের পরীক্ষাগার” হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ভূখণ্ড থাকাকালে; দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ’কে। তবে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী আকারে ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নশীল প্রথম পাঁচটি দেশের একটি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমাদের অর্থনীতির আকার ৪৫ গুণেরও বেশি বড় হয়েছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়কালে ভাগ করা হলে একে ১. পুনর্নির্মাণ পর্যায় (১৯৭২-১৯৯০), ২. উত্থান প্রস্তুতি পর্যায় (১৯৯১-২০০৯) এবং ৩. উত্থানপর্ব (২০২১-বর্তমান) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (এইচএসবিসি) রিপোর্ট অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছর অর্থ্যাৎ ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ হারে। আগামী এক যুগ বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। আর বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের সব দেশের প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি হবে। 

আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান ও অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম হিসেবে চিহিৃত করেছে। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লীগ টেবিল ২০২১’ -এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অগ্রগতি একইভাবে অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামও একই পূর্বাভাস দিয়েছে। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল, ‘এমার্জিং টাইগার, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করছেন। ইতোমধ্যেই, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং নারী ক্ষমতায়নের মতো নানা সূচকে সফলতার প্রশংসা করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো। 

স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি, শিল্প উৎপাদন এবং স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়াও কৃষির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ শিল্প উৎপাদনে জোর দেয়া হয়। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬২৯ কোটি ডলার, মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার, রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। উক্ত সময়ে বাংলাদেশে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১১০ কোটি টাকা। আমদানি ব্যয়ের পরিমান ছিল ২২৬ কোটি ডলার, আর রাজস্ব আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা, তৎকালীন সময়ে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৭০ শতাংশ। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে দেশের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল মাত্র ৯০ ডলারের মতো, সেখানে ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৩ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ১৯৭৪ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৫৯ -যা এযাবৎ কালের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল যেখানে মাইনাস ১৩.৯৭ পয়েন্ট দিয়ে এবং তা ১৯৭৩ এ দাড়িয়েছিল ৩.৩৩; বৃদ্ধির পরিমান ১৭.৩। তবে ১৯৭৫ এর শেষ সময়ে এসে তা দাঁড়ায় মাইনাস ৪.০৯। স্বাধীনতার পর শুরুই হয়েছিল মাইনাস দিয়ে, সেক্ষেত্রে ১৯৭২ এর চেয়ে ১৯৭৫ এর অগ্রগতি ৯.৮৮। ১৯৭৬- ১৯৮১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ১৯৭৬ সালে ৫.৬৬, ১৯৭৭ সালে ২.৬৭ এবং ১৯৭৮ সালে ৭.০৭, ১৯৭৯ সালে ৪.৮, ১৯৮০ সালে ০.৮২ এবং ১৯৮১ সালে ৭.২৩। ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স ছিল এক কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

৫০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, দেশের রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। গত ৫০ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০.৫ (একক মাত্রিক) শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৪ সালে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রে দেশের কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। কিন্ত তৎকালীন সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনায় যা অতি দ্রুত সময়ে নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতি নানা চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয়েছে। এই সময়কে একটি ক্রান্তিকাল হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৩.০৮ শতাংশ। ক্রমান্নয়ে বিভিন্ন পট পরিবর্তন যেমন, গণতান্ত্রিক শাসক, সামরিক শাসক, স্বৈরশাসক অর্থাৎ রাজনৈতিক বিভিন্ন সরকারের আমলে অর্থনীতি উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি পথ পরিক্রমণ করেছে। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে এই দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের ৮০ শতাংশই বিদেশি সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে মেটানো হতো। কিন্তু বর্তমানে দেশের বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ে বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে উদ্বৃত্ত অংশ থাকে, তা বিনিয়োগ করা হচ্ছে উন্নয়ন খাতে। এখন উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ আসছে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। বাকি ৭০ শতাংশই নিজস্ব অর্থ থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। 

১৯৯০-এর দশকে গৃহীত অভ্যন্তরীণ আমদানি প্রতিস্থাপন নীতির পরিবর্তে একটি রপ্তানিমুখী বাণিজ্য নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গেম চেঞ্জার ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ৯০ এর পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত সরকার সমূহের বিভিন্ন বাণিজ্যিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। গত দুই দশকে তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে গত দুই দশকে অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার মাথাপিছু আয়ও দুই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি উন্মুক্ত করার ফলে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। উক্ত সময় থেকে দেশে একটি পরিপক্ক উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙা রাখার পাশাপাশি রপ্তানির পথও সুগম করে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মাঝে কখনোই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়নি। সবমিলিয়ে শেষ হওয়া এই দশকের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। এমনকি বিশ্বের কম দেশেই এই হারে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। দেশের প্রবৃদ্ধি দীর্ঘদিন ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল। বিদায়ী দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা আটকে ছিল ৬ শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর সর্ব শেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থ বছরের জিডিপি ৩৯,৭৬৫ বিলিয়ন টাকা (সাময়িক)। ২০২১-২২ অর্থ বছরের মাথাপিছু আয় হিসাব করা হয়েছে ২,৮২৪ মার্কিন ডলার (সাময়িক) এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৫%(সাময়িক); যা ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের জিডিপি ছিল ৩৫,৩০২ বিলিয়ন টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরের মাথাপিছু আয় ছিল ২,৫৯১ মার্কিন ডলার এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৪%। 

অর্থনীতির সূচকগুলো এখন যে জায়গায় আছে, তাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ বলে মনে করছেন না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ। তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন। তার ভাষায়, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভিকটিম (সুত্রঃ বিডিনিউজ২৪.কম,তারিখ ০৪ জুন ২০২২)। গত ৫ দশকে বাংলাদেশের যেসব অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেছে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উঠে আসা, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণ ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। জঙ্গীবাদ দমনে সাফল্যের দিকটিও প্রশংসা পেয়েছে বহুলাংশে। বিশ্বব্যাংক ১৯৯৫ সালেই ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন হবে, তার একটি ছক তৈরি করেছিল। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব কটি লক্ষ্যই অর্জন করেছে বাংলাদেশ, কিছূ কিছু সেক্টরে অনুমানের চেয়ে অনেক ভালো করেছে বাংলাদেশ। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ আনা-এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।


 


গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ শতাংশের হারে । করোনার আগে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৭ এবং পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্টসমুহের চেয়েও ভালো ফলাফল করেছে । বিশেষত শিক্ষা, মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, স্যানিটাইজেশন, টিকাদান কর্মসূচী, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, প্রবাসী আয়, রপ্তানী প্রবৃদ্ধি, মন্দা ও করোনা মোকাবেলায় সাফল্য ইত্যাদি ব্যাপকভাবে আলোচনার দাবী রাখে।

লক্ষনীয়ভাবে বাংলাদেশের উন্নতিগুলো সবার দৃষ্টি কাড়ে যেমন- যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, রপ্তানী প্রবৃদ্ধি, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, ব্যাপক দেশী বিদেশী বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশে ব্যাপক অংশগ্রহন এবং কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি। স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী এবং এর সাফল্য বাংলাদেশের সুনাম আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে অর্জনের যে বিষয়টি লক্ষনীয় তা হলো সরকার সমূহের দরিদ্র-বান্ধব কর্মসূচী এবং এর পরিকল্পনার কারনে দারিদ্রের হার কমার পাশাপাশি বৈষম্যও আনুপাতিক হারে হ্রাস পেয়েছে যা বিশ্বে একটি বিরল উদাহরন। বাংলাদেশে সামাজিক অগ্রগতিও চোখে পড়ার মত। গত ৩০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ১৫ বছর যা পাকিস্তানে বেড়েছে মাত্র ০৭ বছর। বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ভারতে গড় আয়ু ৬৯ বছর। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৪। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ভর্তির হার বেড়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বয়স বিবেচনায় শিশুদের ৭৩ শতাংশ এখন স্কুলে যায়। করোনা অতিমারীর কারণে গত দুই বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির বেশ কিছুটা অবনতি হলেও সাম্প্রতিক কিছু জরিপ বলছে, তার অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধারের পথে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ের বৈশ্বিক সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। সমস্যাগুলো বাস্তব তথ্যের নিরীখে ব্যবস্থাপনা করা গেলে সংকট কাটিয়ে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যেকোন দেশের উন্নতি একদিনে সম্ভব হয়না। উন্নয়নের জন্য বহুমাত্রিক পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন হয়। যেহেতু বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ কম এর ফলে রাতারাতি কাঁচা পয়সা দিয়ে দৃশ্যমান/চোখ ধাঁধানো উন্নতি করা অসম্ভব, তাই আমাদের প্রয়োজন সীমিত সম্পদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন। মানবসম্পদ, উর্বর জমিই আমাদের উল্লেখযোগ্য সম্পদ। মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদন কাজে সর্বাধিক করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মুন্সিয়ানা দেখানোর পাশাপশি ব্যাপক পারদর্শিতা অর্জন করেছে। ব্যয়ের অংক বেশী হলেও নিজেদের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু এখন দক্ষিন অঞ্চলের সমৃদ্ধির দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ শেষে এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ইজেডে উৎপাদন কাজও শুরু হয়েছে। আশির দশকে স্থাপিত ইপিজেড সমূহের সাফ্যলের কারনে ইজেড সমুহও ভালো করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগন।

গত বছর দ্য ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে পেরেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমডিজিতে দারিদ্র্যের হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি কমাতে সক্ষম হয় এবং এমডিজি অর্জনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের লক্ষণীয় অগ্রগতি রয়েছে। এবার আমরা বাংলাদেশের সাথে কয়েকটি দেশের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষন করে আমরা দেখতে পাই- যে সকল দেশের জন্ম বাংলাদেশের সমসাময়িক এবং আশির দশকেও যারা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের কাছাকাছি ছিল বর্তমানে কোন কোন দেশ ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক গুন। বাংলাদেশের বর্তমান উন্নতির ইনডিকেটরগুলোর তুলনা ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ থেকে আরেকটু প্রসারিত করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাতার, স্পেন এর সাথে হলে আমরা প্রকৃত বহুমাত্রিক উন্নয়নগুলোর বৈশ্বিক চিত্র পাবো। বাংলাদেশ, কাতার আর ভিয়েতনামের যাত্রা শুরু হয়েছিল কাছাকাছি সময়ে। কিন্তু বর্তমানে ভিয়েতনাম, কাতার এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। ভিয়েতনাম “ওপেন-ডোর” নীতি থেকে উপকৃত হয়েছে এবং দেশটি গত তিন দশকে একটি বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য বিদেশী ব্যবসা যেমন ইন্টেল, স্যামসাং, অ্যাডিডাস এবং নাইকি এরই মধ্যে উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করেছে। দেশটি এরই মধ্যে অন্যান্য পণ্যের মধ্যে টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক পণ্য এবং ফুটওয়্যার রফতানিকারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ভিয়েতনামের অর্থনীতির উন্নয়নের পেছনে তিনটি উদ্যোগ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, দেশটি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বাণিজ্য উদারীকরণকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এশিয়ান এবং পশ্চিমা উভয় দেশের সঙ্গে অনেক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর বাণিজ্যের ধীরে ধীরে দেশটির উদারীকরণের আভাস দেয়। ভিয়েতনাম ৭২টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করেছে এবং ১৬৫টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয়ত, ভিয়েতনাম বাহ্যিক উদারীকরণের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সমন্বয় করেছে। ২০০৭ সালে ভিয়েতনাম ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১০৪তম স্থানে ছিল।

ওই গবেষণা দেশটির কয়েকটি প্রধান সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছিল। সরকার এ সূচকগুলোকে নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করে সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে মনোযোগ দিয়েছে এবং ভিয়েতনাম ২০২০ সালে ডুয়িং বিজনেস জরিপে ৭০তম অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। তৃতীয়ত, ভিয়েতনাম মানবিক ও সামাজিক পুঁজিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ফলে একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ফলে ভিয়েতনামের শ্রমিক শ্রেণীর মজুরি ও উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। স্পেন ও কোরিয়া আপগ্রেডিংয়ের মাধ্যমে উন্নত দেশের মর্যাদায় পৌঁছেছে। দুটি দেশ ষাট এবং সত্তরের দশকে রাষ্ট্র নির্দেশিত চেষ্টায় শিল্পায়িত হয়েছিল, যা জাহাজ নির্মাণ, ইস্পাত, রাসায়নিক, ইলেকট্রনিকস এবং অটোমোটিভ শিল্পের মতো অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। আপগ্রেড করার জন্য এ শিল্প এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে গভীর, টেকসই সমন্বয় প্রয়োজন। স্পেন একটি পথ বেছে নিয়েছিল যা এফডিআই, প্রযুক্তিগত আউটসোর্সিং এবং ইউরোপের সঙ্গে একীকরণের ওপর ভিত্তি করে ছিল। এ পদ্ধতিটি ব্যাংকিং এবং টেলিকমিউনিকেশনের মতো জটিল পরিষেবা খাতে উন্নয়ন করলেও উৎপাদন ক্ষমতায় তীব্র হ্রাস ঘটায়। বিপরীতে কোরিয়া প্রযুক্তিগত স্বায়ত্তশাসন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর ভিত্তি করে একটি স্ট্রাটেজি অনুসরণ করেছে. যা উৎপাদন খাতে আপগ্রেডকে সমর্থন করে। কাতার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্র এবং পরিধির ব্যাপকতা বিস্তৃত করে আধুনিক এবং উন্নত রাষ্টের মর্যাদা পেয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর ২০২০এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মালয়েশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম এবং বিশ্বের ৩৬তম বৃহত্তম অর্থনীতিও বটে। অন্যদিকে চীন তার অতিরিক্ত শ্রমকে আধুনিক উৎপাদনশীলতায় কাজে লাগিয়ে দেশটি আজ পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। নানা কারণে বাংলাদেশের সম্পদের ব্যবহার সঠিকভাবে করা যায় না, যার ফলে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও কাজে লাগাতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বর্তমানে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ঋণ আদায়ের হার হ্রাস ও বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার অর্থনীতিকে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

আমাদের অর্থনীতি মূলতঃ (১) কৃষি অর্থনীতি (২) তৈরি পোশাক রপ্তানি (৩) বৈদেশিক রেমিটেন্স এই তিনটি সেক্টরের উপর সর্বাধিক নির্ভরশীল। তিনটি সেক্টরই আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিংও বটে। কৃষির উৎপাদন ভালো আবহাওয়া, প্রকৃতিক দুর্যোগ, সার কীটনাশক এর সরবরাহের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে তৈরি পোষাক বিদেশীদের ক্রয় ফরমাশ, বৈশ্বিক অর্থনীতির কারনে পণ্যটির রপ্তানী ব্যাহত হতে পারে। আর প্রবাসীদের আয়ের ধারা অব্যাহত থাকে বিদেশে ব্যাপক কাজের সুযোগ এবং ঐ সকল দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর। যদি ঐ সকল দেশের অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যায় তাহলে আমাদের প্রবাসী আয় হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রদানকারী যুক্তরাষ্ট, চীন, কাতার, দুবাই, ইউরোপ, কানাডা এই সকল দেশের মধ্যে শুধুমাত্র গুটিকতক রাষ্টের বাংলাদেশীদের কর্মস্থানের সুযোগ থাকার কারনে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম। আমাদের এই চ্যালেঞ্জসমূহের বিষয়ে ওয়াকিবহাল থেকে শুধুমাত্র একক তৈরি পোষাকের উপর নির্ভর কিংবা প্রবাসী রেমিটেন্স এর উপর ভরসা করে দেশের উন্নতির গতিধারা সম্মুন্নত রাখা সম্ভবপর হবে না। কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসীদের আয় (রেমিটেন্স) এর পাশাপাশি অন্যান্য বহুমাত্রিক শিল্প কিংবা সেবা এবং আধুনিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর অনেক বেশী জোর দিতে হবে।

দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিকল্প পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া মানে ডলার সরবরাহ আরও কমে গেছে। রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থাকায় রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য বেরিয়ে আসতে হলে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে এবং দক্ষ জনবল বিদেশে পাঠাতে হবে, এর ফলে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এসব কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে বিকল্প পথ বা নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমান উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো টেকসই নয়। কারন হলো যে মাত্র তিনটি ক্ষেত্র বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী রেখেছে এই তিনটি সেক্টর অনেকগুলো পারিপার্শ্বিকতার উপর ভর করে চালিত হয়। উন্নয়নের গতিধারা সমূহের বহুমূখীকরণ (বৈচিত্রতা) সম্ভব না হলে যে কোন প্রকার বৈশ্বিক/স্থানীয় সংকটে অর্থনীতি তার গতি হারাতে পারে। বাংলাদেশের দ্রারিদের হার এক কেন্দ্রীক হ্রাসের চেয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র হ্রাসের দিকে নজর দিতে হবে। তবেই দারিদ্র নির্মূল টেকসই হবে।

জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) কমিটি এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করাই এখন মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। ২০২৪ সালে সিডিপি আবার মূল্যায়ন করবে। তখনো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ চাইলে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার অনুমোদনের বিষয়টি আরও পিছিয়ে দিতে পারে। ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় রয়েছে তা অর্জনের জন্য লক্ষ্যমাত্রাগুলো সঠিকভাবে যথাসময়ে অর্জন করতে হবে। রূপকল্প ২০৪১ চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ যথাঃ সুশাসন, গণতন্ত্র, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

আর এ লক্ষ্য অর্জনের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় চারটি বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- ১. জিডিপিসহ মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা; ২. উচ্চতর আয়ের সুফল সবর্জনীন করা; ৩. টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ৪. সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, মূল্যস্ফীতি হৃাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্রের (বহুমাত্রিক) হার কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি লক্ষ্য গুলো ধারাবাহিকভাবে অর্জন এবং টেকসই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে আমাদের স্বপ্নের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপ নেবে। তবে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ আর্থিক কিংবা রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর অর্থপূর্ণ সমাধান যথাসময়ে করা না গেলে আমাদের কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় কর্মপরিকল্পনার দ্রুত অগ্রগতি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সময় করণীয় সম্পর্কে দ্রুত পরিকল্পনা ও তাৎক্ষণিক করণীয় ঠিক করে এর সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন। 

লেখকঃ আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, উপ-পরিচালক, বেপজা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
 

বিনিয়োগবার্তা/এআর/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)