মিহির

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ড: মিহির কুমার রায়: মানবাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয় যা মানুষের আইনগত অধিকার, নৈতিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকারের সমষ্টি। অর্থাৎ সকল আইনগত অধিকার, নৈতিক অধিকার ও মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বজুডে দিনটি পালিত হয়ে আসছে যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’ এবার মানবাধিকার এ বছর দিবসটির ৭৪তম বার্ষিকী এবং এ বছরের উদযাপনের মাধ্যমে জাতিসংঘ আগামী বছর ৭৫তম বার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে একটি বছরব্যাপী প্রচারণাও শুরু করবে যেখানে ইউডিএইচআরের প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহ্য এবং মানবাধিকারের জন্য নেয়া প্রচেষ্টা তুলে ধরা হবে।

এই দিবসটি উৎযাপন উপলক্ষে এলকপ ১০ই ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখ সকাল ১১ ঘটিকায় তাদের প্রধান কার্য়ালয়ে ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা শীর্ষক একটি গোলটেবিল বেঠক/মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। উক্ত মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ঠ শীক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, পরিবেশবীদ সহ আরও ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন এবং প্রধান বক্তা হিসাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডীন অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ। সার্বিক অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবীদ এলকপের সম্মানিত সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। 

প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের সংবিধানের মানবিক মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার ধারনা কি ভাবে উল্লেখিত হয়েছে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন যা প্রশংসনীয়। আলোচনায় উঠে এসেছে এবার দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে এমন একটি প্রেক্ষাপটে, যখন কিনা বিশ্ব একটি ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, শরণার্থী-সংকট, উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, জনরঞ্জনবাদের আবির্ভাব এবং জাতিগত বিভেদের দরুন বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর কেবলমাত্র রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক নীতি, ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদ, পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে যাওয়া জেনোফোবিয়া, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, কর্মক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং শ্রেণীবৈষম্য আমাদের মানবাধিকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এছাড়াও গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক উল্টোযাত্রা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ দৃশ্যমান হয়েছে। বিশ্বব্যাপী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং জনতুষ্টিবাদের রাজনীতি আগের চেয়ে আরও ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। ফলে সাদা চোখেই একটি উল্টোযাত্রা দৃশ্যমান হয়েছে। জন হপকিন্স স্কলার ইয়াশা মাউঙ্কও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের এমন উল্টোযাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। উদারবাদী মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি আমাদের সমাজকে আরও ক্ষতিগ্রস্থ করছে। সম্ভবত ইতিহাসে এটি একটি প্রথম ঘটনা, যেখানে মহান শক্তিগুলো তাদের দ্বন্দে মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, মার্কিন-চীন দ্বন্দ এবং বাইডেনের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা পররাষ্ট্রনীতি এমন দাবির প্রমাণ করে। এ ধরনের রাজনীতি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

জাতিসংঘ একটি আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠান যা বহুপাক্ষিকতার প্রচার করে এবং গোষ্ঠী রাজনীতি এবং পরাশক্তির দ্বন্দের বাইরে গিয়ে জাতিসংঘ তার সদস্যদের একত্রিত করে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে। বিগত সময়ে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে যে আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা গত কয়েক বছরে হুমকির মুখে পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং, এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় তাই আমাদের ন্যায্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। জাতিসংঘের সকল সদস্য যেহেতু ইউডিএইচআর গ্রহণ করেছে, তাই আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সচেষ্ট হতেই হবে। একটি বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, জেনোফোবিয়া, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের সংঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতাকে হরণ করছে। 

বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী একটি দেশ এবং তাই ১৯৭৪ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রায় সব সংস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য এবং ইউএনএইচসিআরের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখছে। মানবাধিকার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনের রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মানবাধিকারের বিভিন্ন নির্দেশকে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। বিশ্ব জনসংখ্যা পর্যালোচনা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২১ সালে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যথাক্রমে ব্রাজিল (৪৯,৪২৬ জন), যুক্তরাষ্ট্র (৩৭,০৩৮ জন) এবং মেক্সিকোতে (২২,১১৬ জন)। এই প্রতিবেদন অনুসারে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি দেশ হলো যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালো। মানবাধিকার রক্ষা, এর চর্চা ও বিকাশ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে মুক্তি সংগ্রাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার নির্মোঘ দাবি ও আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া এবং মুক্তি ও গণতন্ত্রকে জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ প্রমাণ করে বাংলাদেশ শুধু মানবাধিকারের প্রবক্তাই না, মানবাধিকার রক্ষক, প্রচারক। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদান, নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের সফলতা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বে আমাদের রোল মডেলের স্বীকৃতি বলে দেয় মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও প্রচেষ্টা।

গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১২ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে, শিশু অধিকারে এবং সম্ভবত হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকার করা গত দশকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের বহুদিনের দাবি-ভোটাধিকারও নিশ্চিত করেছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধিতেও সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, এছাড়াও একটি জাতি হিসেবে বাঙালি তার আতিথেয়তার জন্য পরিচিত এবং বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া, আধিপত্য ইত্যাদির মতো প্রথম বিশ্বের অনেক সমস্যা থেকেও মুক্ত। তবুও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি রাজনৈতিক সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন, নিম্নমানের শ্রম পরিস্থিতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি পুনরাবৃত্ত ঘটনা। একটি ব-দ্বীপ হিসেবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয় যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অভ্যন্তরীণভাবে বস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। এই প্রত্যেকটি বিষয়ে সরকার দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করছে যা দেশে বিদেশে প্রসংশিত হয়েছে। 

স্বাধীনতার গত ৫১ বছরে সাফল্য পর্যালোচনায় আসে আইনগত সংস্কার, প্রশাসনিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও চুক্তির প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার এবং প্রতিপালন প্রমাণ করে মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন বাঙালি জাতির সহজাত সংস্কৃতি। মানবাধিকার রক্ষা ও বিকাশে বাংলাদেশ আইনগত পদক্ষেপ ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন সাধনসহ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মানবাধিকার রক্ষায় ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা, তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ১০টি শ্রম আদালত স্থাপন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন, ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয়় লিঙ্গের স্বীকৃতিসহ বাংলাদেশ অনেক আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন করেছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচনে বাংলাদেশ পঞ্চমবারের মতো সাফল্যের সঙ্গে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। এর আগে বাংলাদেশ ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও জয়লাভ করে সদস্য নির্বাচিত হয়। এটি মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সুতরাং ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ মানবাধিকারের রক্ষক ও চর্চাকারী।

সর্বশেষে বলা যায়, বাংলাদেশকে অবশ্যই বহুত্ব ও বহুপাক্ষিকতার পথ বেছে নিতে হবে। এ উপলক্ষে আমাদের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে- মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নে বাংলাদেশ কাজ করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত রাখবে।  

সার্বিক আলোচনা শেষে এলকপের সম্মানিত সভাপতি ও আলোচনা সভার সঞ্চালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। তিনি তার সমাপনী বক্তব্যে মানবাধিকারের এবং আইনের শাসনের প্রতি দেশের ও জনগণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

লেখক: গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)