মিহির

মাধ্যমিকের ফলাফল কি মেধার নিয়ামক

ড: মিহির কুমার রায়: গত ২৮শে নভেম্বর সোমবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে যেখানে এসএসসি সহ ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৭.৪৪ শতাংশ যা গত বছর ছিল ৯৩.৫৮ শতাংশ। আবার সর্বোচ্চ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী যা গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। ফলাফল মূল্যায়নে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে বেশি তবে গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে এবং এখানে উল্লেখ্য ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৩৪ হাজার ১৮ জন, পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন এবং পাস করেছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন।  তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে শুধু এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন, পাস করেছে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭১ জন,  মাদ্রাসায় পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ১৩২ জন, তাদের মধ্যে পাস করেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও দাখিল  ভোকেশনাল পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪৮ জন, তাদের মধ্যে পাস করেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন। মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছেলে ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩  জন ও মেয়ে পরীক্ষার্থী ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন। ২৯ হাজার ৬৩৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতভাগ পাস ছিল দুই হাজার ৯৭৫টি প্রতিষ্ঠানে, অন্যদিকে পাস করতে পারেনি  ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী। গত বছর এই পরীক্ষায় পাঁচ হাজার ৪৯৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতভাগ পাস ছিল, অন্যদিকে ১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। সে হিসেবে এ বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই হাজার ৫১৯টি কমেছে এবং শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে  ৩২টি। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৬৪ হাজার ৯৮৪ শিক্ষার্থী), রাজশাহী বোর্ডে (৪২ হাজার ৫১৭ জন), কুমিল্লা বোর্ডে  (১৯ হাজার ৯৯৮ জন), যশোর বোর্ডে (৩০ হাজার ৮৯২ জন), চট্টগ্রাম বোর্ডে (১৮ হাজার ৬৬৪ জন), বরিশাল বোর্ডে (১০ হাজার ৬৮ জন), সিলেট বোর্ডে (৭ হাজার ৫৬৫ জন), দিনাজপুর বোর্ডে (২৫ হাজার ৫৮৬ জন), ময়মনসিংহ বোর্ডে (১৫ হাজার ২১৬ জন) শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এছাড়া পরীক্ষায় ছাত্রদের থেকে  ছাত্রীদের পাসের হার বেশি, যেমন ছাত্রীদের পাসের হার ৮৭.৭১ শতাংশ অর্থ্যাৎ এবার ছাত্রদের থেকে ছাত্রীদের পাসের হার শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

১১টি শিক্ষা বোর্ডের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নেপথ্যে মোটা দাগে ৫টি দিক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, এগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, এছাড়া প্রশ্নপত্রে অধিক সংখ্যক বিকল্প থেকে পছন্দের সুযোগ, ৫০-এর মধ্যে দেয়া পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ১০০তে রূপান্তর, কঠিন বিষয়ে অবলীলায় ৯০ শতাংশের ওপরে নম্বর প্রাপ্তি এবং সাবজেক্ট ম্যাপিং। শিক্ষার্থীদের জীবনে মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাসের হার বাড়ানোর চেয়েও বেশি জরুরি শিক্ষার মান বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটা হচ্ছে তার যথাযথ নিরীক্ষা হওয়া দরকার। কারণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একটি বড় অংশ পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর আগেই ঝরে পড়ছে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমানে পরীক্ষায় নকলের প্রবণতা কমে গেছে- এটা ঠিক, তবে এখনো দেশে নোট-গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য, কোচিং বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি বন্ধ হয়নি যা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

নিকটতম অতীতে দেখা যায় যে দেশের অধিকাংশ কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার  স্কোরে যোগ হচ্ছে। ফলে কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থী মূল ভর্তি পরীক্ষায় অনেক সময় বেশি নম্বর পেয়েও মেধা স্কোরে টিকতে পারছেন না। কিন্তু কেন এই নিয়ম, তার সুনির্দিষ্ট সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কেউ দেয় নি। বরং এসব জিপিএ স্কোর থাকার কারণে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিশ বছর আগেও   যেখানে জিপিএ-৫ পাচ হাজারের ঘরে থাকত, সেটি প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ঘরে ঘরে জিপিএ-৫ এ ঠেকছে, যা দেশের শিক্ষার মানকে সংকুচিতই করছে না, বরং রাষ্ট্রকে ভুল  পথে পরিচালিত করার প্রয়াস জোগাচ্ছে। জিপিএ-৫ কে যে বা যাহারা মেধার মানদন্ড মনে করছেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, এই জিপিএ-৫ পাওয়া মানেই  মেধাবী নয়, এটি  কেবল একটি নির্দেশক হতে পারে, সেটি কিছুতেই একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম হতে পারে না। সৃজনশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী শিক্ষার্থী গড়ায় নজর না দিয়ে কেবল  নিয়মতান্ত্রিক প্রশ্ন আয়ত্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে জিপিএ-৫ বাগিয়ে নেওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটা কম জানেন, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন থাকছে, তেমনি দেশের  বাইরে যখন উচ্চ শিক্ষায় আসছেন তখন তাঁরা ঠিকই টের পাচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশ যেমন ভারত, নেপাল তারা তাদের উচ্চ শিক্ষার ভর্তির বিষয়টি খুবি মানসম্মত ভাবে নিয়ন্ত্রন করে থাকে যেখানে  মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হয়। তাহলে আমাদের যে সকল বিষয়ের উপর নজর দেয়া উচিত তা হলো ১.   বিশ্বের অনেক কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে  কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় পূর্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্ত জিপিএ মূল ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরে বিবেচনায় নেয় না অথচ বাংলাদেশে এই   নিয়ম চালু রেখেছে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়/বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন কিংবা কেউ এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেনি। এর মধ্য দিয়ে দেশে এক  শ্রেণি শিক্ষার্থীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বঞ্চিত হচ্ছে কম জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা অথচ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিযোগিতা করার অধিকার সব শিক্ষার্থীদের হওয়া উচিত, প্রকৃত মেধাবীদের বের করে আনার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিক। তারা যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে, সেই প্রতিযোগিতার আরও একটু আধুনিকায়নের সুযোগ নিক।; ২. করোনা মহামারীর পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রেণী কক্ষের মূল্যায়ন, অবিরত মূল্যায়ন বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। দেশের শিক্ষক,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পুরো ব্যবস্থা অবিরত মূল্যায়ন পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করতে হবে, উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যাতে বাস্তবধর্মী পরীক্ষা নেওয়া হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। কারন শিক্ষার্থীরা বহুদিন যাবৎ প্রকৃত লেখাপড়ার সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত নেই। পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল অর্জন করার মধ্যে যে আনন্দ উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সেটি যাতে বহাল থাকে সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে; ৩. পাসের হারে এক বোর্ড থেকে আরেক বোর্ডের এগিয়ে থাকা কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কোন বছরেই খতিয়ে দেখা হয় না যা সঠিক নয়। এ  ব্যাপারে প্রতিটি বোর্ডেই এজন্য একটি গবেষণা সেল থাকা উচিত; সর্বশেষে বলা যায় উচ্চ শিক্ষা উন্মুক্ত রাখা উচিত  কেবলমাত্র মেধাবিদের জন্য এবং অন্যান্যদের জন্য  কারিগরী/উদ্যোক্তা উন্নয়নে শিক্ষার প্রতি জোর দেয়া উচিত। 

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)