কোভিড-১৯ ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ণ প্রসঙ্গ

ইংরেজী নতুন বছরের শুভেচ্ছা, শীতের কুয়াশা ও জীবনের গল্প

ড: মিহির কুমার রায়: শীতের পাতা ঝরার সঙ্গে সঙ্গে এই পৌষের হিমেল পরশে শুরু হলো খ্রিষ্টাব্দের নূতন বছর ইংরেজী নববর্ষ, ১লা জানুয়ারী, ২০২৩, ১৬ই পৌষ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, শুরু হয়েছে নতুন বছরকে বরণ করে নেবার অনুষ্ঠানাদি। কিন্তু  নতুনের কাছে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যখন সামনের দিকে তাকাই, তখন সঙ্গত কারণেই মনে পড়ে পেছনের কথা, কী পেযেছি,  কী পাইনি, সে হিসাব মেলাতে গেলে প্রাপ্তির পাল্লাটাই যে ভারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ তার ইতিহাসের ৫১টি  বছর অতিক্রম করেছে। আজ ২০২৩ সালে এসে বলতেই হয, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ যেখানে এসে পৌঁছেছে,  তা রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে দেখতে পারলে নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয।  কিন্তু নতুন বছরেও বিগত বছরের রেশ থেকেই যাবে, সব কিছু ফেলে যেতে পারব না, হিসাবের খাতায় যেমন বিগত বছরের দেনা-পাওনা লিপিবদ্ধ থাকবে, সমযের খাতায়ও থেকে যাবে বিগত বছরের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি,  অর্জন আর হারানোর অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা, যা পথ দেখাবে আগামীর দিনগুলোতে। আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল  বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ২০২৩ সালটি ভাল যাবেনা বিশেষত: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতির  অস্থিরতার কারনে এবং বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সময়োপযোগী প্রস্তুতি নিয়ে চলছে বিশেষত খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে।  বর্তমানে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট চলছে এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এবং উৎপাদন বাড়ানোর দৃঢ়  প্রত্যয়ে এবার উৎযাপিত হচ্ছে নবান্ন উৎসব ১৪২৯। অগ্রহায়ণ বা পৌষ মানেই আমন ধান কাটার মাস, ফলন ও উৎপাদনে  আমন বোরোর চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রতি বছর এর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০  সালে আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে বিধায় নবান্ন উৎসব তাই যথারীতি আনন্দঘন হচ্ছে যা ফলন বাড়িয়ে আনন্দকে আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা  হবে বলেও প্রত্যাশা। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ ও পৌষ শীতের মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। 

হাজার হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উৎযাপন হয়ে আসছে শীতের মৌসুমে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো, ফসল কাটার আগে  কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন, বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা  হতো। এছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো যেমন শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ  পদের তরকারি রান্না করা হতো কোনো কোনো বাড়িতে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে  ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন, পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্র মতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়, কে  চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ  করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন, নতুন চালের তৈরি  খাদ্য সামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। অন্য একটি আচার অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত  করা হয়, তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়, এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়,  সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাক বলী, লক্ষ্মী পূজা, পিতৃ শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে  খাওয়া-দাওয়া করেন বিধায় এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না।

পৌষ -মাঘ মাস জুড়ে শীতের হাড় কাপানো হিমেল বাতাস আমাদের কষ্ট দিলেও আনন্দও কম দেয় না। এই শীতেই গ্রাম  বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যের একটি খেজুরের রস। শীত যত বাড়তে থাকে, খেজুরের রসের চাহিদাও তত বাড়ে।   বর্তমানে গ্রাম ছাপিয়ে ঢাকার বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে খেজুরের রস। খেজুরের রস যেমন কাঁচা খাওয়া যায়,  তেমন এর রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন রকমের পাটালি ও নলেন গুড়। খেজুরের রস এবং গুড়ের  উপকারী দিকের লিস্টও বেশ লম্বা। এই রসকে বলা হয় প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংক। খেজুর রসে দ্রবীভূত গ্লুকোজের পরিমাণ প্রায় ১৫  থেকে ২০ শতাংশ। পাশাপাশি এতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, সহজপাচ্য ফ্যাট এবং খনিজ বা মিনারেল। খেজুরের রস থেকে তৈরি  গুড়ে প্রচুর পরিমাণে আয়রন বা লৌহ থাকে। নিয়মিত অল্প পরিমাণে খেজুর গুড় খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক  থাকে, এমনকি অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ হয়। খেজুর রসে পটাশিয়াম এবং সোডিয়ামও পাওয়া যায়, যা পেশিকে শক্তিশালী  করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম। ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে মানব দেহে ক্লান্তি এবং অবসন্নতা ভর  করে। তাই খেজুর রসকে বলা হয় মন ভালো করার পানীয়। পৌষ মাসে শেষ দিন যাকে বলা হয় পৌষ সংক্রান্তি এবং এই  দিনের আনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে প্রাত:স্নান, খরের আগুনে শরীর পোয়া, নূতন জামাকাপড় জুতা পরিধান, বিভিন্ন ধরনের পিঠা যেমন মালপা, পাটিসাপ্টা, সিদ্ধগুলি, পাটিবালা, ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশনা এবং তার সাথে যোগ হয় পালা গানের আসর যেন গ্রামীন জীবনে এক নূতন রুপে আবির্ভুত হয় সকলের কাছে। তার কিছুদিন পরেই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে শুরু হয়  বিদ্যা দেবীর আরাধনা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা যেন মনে হয় সেটাই বাংলার চিরাইত রূপ।

এখন আসা যাক জীবনের গল্পে যেখানে এ দেশের ১৭ কোটি মানুষ ২০২৩ সালের বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতির ভাবনায় সংশয়, সন্দেহ ও আতঙ্কের মধ্যে দিন গুনছে এবং এ বাস্তবতায় ২০২৩ সালকে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান,  সুষ্ঠু অভিবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন, পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ ও বসবাসের নিশ্চয়তাসহ সামাজিক সুরক্ষার প্রতি আমাদের যত্নবান হতে হবে। কেউ বলছে মন্দার সূচনা হবে ২০২৩ সাল থেকে, আবার কেউ কেউ বলছে ২০২৪  সালে বিশ্ব মন্দা প্রকট আকার ধারণ করবে। যাই হোক, আমরা যদি বিশ্ব মন্দার কাছে হেরে যাই সেক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের এ  পর্যন্ত অর্জিত অগ্রযাত্রার এক বিশাল ছন্দপতন হবে। ২০২৩ সাল বাংলাদেশের জন্য হবে একটি বিশেষ বছর। ফলে এই  সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। স্বপ্নের তিন মেগা প্রকল্প নিয়ে দেশের মানুষের অনেক আশা, উৎসাহ, উদ্দীপনা। এগুলো শুধু অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠবে না, এর সুফল দেশের অর্থনীতিতেও নুতন এক গতি নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দিগন্ত বদলে যাবে। এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। সেই সঙ্গে এগুলো বাড়িয়ে  দেবে দেশের মনোবল। ‘বাংলাদেশও পারে’- এমন সাহস সঞ্চার হবে মানুষের মধ্যে। এক ভিন্ন বাংলাদেশের উদয় হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর আগেই মহামারির ধকল সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আগে উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সে অবস্থায় ফিরে যাবে। আগের মতো ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বড় ধরনের  কোনো দৈব দুর্বিপাক দেখা না দিলে কয়েক বছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধি দুই অংকের ঘর ছাড়াবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। কিন্তু তৃপ্ত হবার সুযোগ নেই। এখনো জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি হীন ব্যক্তিস্বার্থ দলীয় সংকীর্ণতায়। আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা আমরা  ৫১ বছর পরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি, চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বটে কিন্তু গরিব মানুষের চিকিৎসা দেয়ার সংকুচিত সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত নয়, চিকিৎসকদের অধিকাংশই  অর্থলিপ্সায় নিমগ্ন, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে তারা অধিক আগ্রহী। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সন্দেহ নেই কিন্তু শিক্ষা এখন বাণিজ্য। শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে হবে সরকারি উদ্যোগ সফল হচ্ছে না, শুধু দুর্নীতির কারণে অর্থ-সম্পদে ধনী হলেও একটি জাতি সমৃদ্ধশালী হয় না। আমাদের শিক্ষার গলদ তথা উগ্র ভোগবাদী মূল্যবোধ থেকে বের হতে হবে মানবিক মূল্যবোধের পথ রচনা করতেই হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ৩০ লাখ শহিদের রক্তস্নাত এই মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময় এখন। আর আমাদের দেশে এই মন্দার প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন, যেমন দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি, দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া এবং রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যা মূলত এসবই মন্দা মোকাবেলার জন্য এ মুহূর্তে সর্বোৎকৃষ্ট পদক্ষেপ এবং সে কারণেই এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে এখন থেকেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারা যত দ্রুত এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ততই মন্দা মোকাবেলার কাজটি অনেক সহজ হবে। নতুন বছর নতুন কল্যাণময়ে শুরু হোক আমাদের পথ চলা। বিগত বছরের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা আর সাফল্যকে সংহত করার প্রত্যয় নিয়ে আমরা বরণ করছি নতুন বছরকে। আমরা চাই, উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক, নতুন বছর বাংলাদেশের জন্য হয়ে এসেছে অমিত সম্ভাবনার বছর, অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে দেশ, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ব্যবহার করতে পারবে মানুষ ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আশাও দেখাচ্ছে নতুন বছরটি। ২০২৩ সালের প্রতিটি দিন হোক সুন্দর ও কল্যাণময়।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, সাভার, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)